শুধুমাত্র কারও রূপ-সৌন্দর্যই তার প্রতি মানুষের ভালবাসা বা প্রেমের মাপকাঠি হতে পারে না। হয়তবা আকর্ষণীয় দেহের সুন্দর আবরণ কারো কারো মনে ক্ষনিকের জন্য যৌনতার সুড়সুড়ি এনে দিতে পারে ঠিকই, কিন্তু বাস্তবতা হল এই যে, আজীবন পারস্পরিক বোঝাপড়ার সম্পর্কে শুধুমাত্র বাইরের খোলসটা প্রাধান্য পায় না। এ ব্যাপারে অবশ্য এক এক জনের মতামতের ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয় তার পরেও আসল সত্য হল, মানুষের সেক্সুয়ালিটি বিভিন্ন বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। কেউ কারো সুন্দর মুখশ্রী বা চেহারা দেখে তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হন, কেউবা সঙ্গীর সুন্দর গুণ এ মুগ্ধ হয়ে আকৃষ্ট হন,আবার কারও পছন্দ হয় পার্টনারের পোশাকের রুচি, চলন-বলন দেখে, এ সবের বাইরে কেউ কেউ আছেন যারা পছন্দ করেন পার্টনারের বুদ্ধিমত্তা বা ইনটেলিজেন্স। আর যে সব মানুুষ পার্টনারের মেধা বা বুদ্ধি দেখে তাদের মনের ভিতর আকুলিবিকুলি পরিলক্ষিত করে, প্রেমে টইটম্বুর হয়ে যাদের মন,এমন মানুষের সংখ্যা অবশ্য হাতে গোনা। তবে আছে। আমাদের চারপাশেই আছে।এইসব মানুষজনদের নিয়ে মনোবিদরা তাদের মতামত জানিয়েছেন। গত কয়েক বছর ধরে বিষয়টি নিয়ে নতুন একটি শব্দবন্ধ তৈরি হয়েছে। যা স্যাপিও সেক্সুয়ায়াল (Sapiosexual) নামে পরিচিত।
অর্থাৎ স্যাপিও সেক্সুয়ায়াল (Sapiosexual) বলতে আমরা তাদেরকেই বুঝি যারা মানুষের জ্ঞ্যান বা মেধার উপর ক্র্যাস খেয়ে আকৃষ্ট হয়।
হোমোসেক্সুয়াল (Homosexual) বা হেটেরোসেক্সুয়াল ( Heterosexual) কিংবা বাইসেক্সুয়াল (Biosexual) শব্দের সঙ্গে আমরা কম বেশি পরিচিত। এখন প্রশ্ন এসে যায় বহুল চর্চিত স্যাপিওসেক্সুয়াল (Sapiosexual) ব্যাপারটা কী তা নিয়ে ?
হিউম্যান সাইকোলজি নিয়ে আমার অন্য লেখা গুলো পড়তে চাইলে নিচের লিংক গুলোতে ক্লিক করুনঃ
ওই যে বললাম, চেহারা নয়, বুদ্ধিতেই যখন কারো ঘায়েল হয় মন। সঙ্গীর বাকচাতুর্যেই যার মনে প্রেমের সুড়সুড়ি এনে দ্যায়। সেখানে তার পোশাক, চেহারার গড়নটা জাস্ট সেকেন্ডারি ব্যাপার হয়ে যায়, স্রেফ মেধার টানে যদি প্রেম জমে ক্ষির হয়ে যায়, তাহলে মনোবিজ্ঞানের ভাষায় তাকে বলে স্যাপিওসেক্সুয়ালিটি (Sapiosexuality)। এই মন দেওয়া নেয়ার খেলায় মাথায় বুদ্ধির হাওয়া বাতাস যত খেলবে, প্রেমও ততটাই জমাটি হবে। স্যাপিওসেক্সুয়ালরা আর পাঁচজনের থেকে একটু আলাদা হয়। কারণ তাদের প্রেম বা যৌনতার মাপকাঠি হয় শুধু মাত্র বুদ্ধিমত্তা দিয়ে। এখানে মস্তিষ্কের উৎকর্ষতাই আকর্ষণের কারণ। সঙ্গী ইনটেলিজেন্ট হলে তবেই মন উচাটন হবে, না হলে সিম্পলি ‘প্রেমে পড়া বারণ’ সাইন বোর্ড গলায় ঝুলবে।
মডেল – জয়া আহসান। ছবি – ফেসবুক
স্যাপিওসেক্সুয়াল (Sapiosexual) ব্যাপারটা যারা এখনো বোঝেন নাই, তাদের জন্য আরও একটু খোলসা করে বলা যাক। ধরুন, এমন একজন কাউকে আপনার পছন্দ হল যার কথা বলার ধরনই আপনাকে মুগ্ধ করে। সে দেখতে যেমনই হোক না কেন সাম্প্রতিক বিষয়ে তাঁর জ্ঞানের নাড়ি বেশ টনটনে। ফটাফট আপনাকে রাজনীতি, কূটনীতি, খেলা, জ্ঞানবিজ্ঞান বুঝিয়ে দেবে। জেনারেল নলেজ তাঁর একেবারে ঠোঁটস্থ। আপনার সঙ্গে জমিয়ে বুদ্ধিবিত্তিক তর্ক করতে পারবে। অহেতুক কৌতুক করবে না, সামান্য ব্যাপার নিয়ে হাসি-মস্করাও করবে না। তার মানে সবসময় গুরুগম্ভীর কথা বলবে তা নয়, তবে বেশ গুছিয়ে টানটান করে নিজেকে পরিবেশন করবে। আপনিও বেশ বুঝবেন,সে পাকা মাথার মানুষ। তাঁর বুদ্ধি-বিবেচনা আছে, পাঁচজনের সামনে সে সুন্দর করে কথা বলতে জানে। মানে মানুষ টির মস্তিষ্ক একেবারে নিরেট নয়, মাথায় ষোলো আনা মাল মশলা আছে। তেমন কাউকে যদি আপনার মনে ধরে, তাহলে আপনি স্যাপিওসেক্সুয়াল (Sapiosexual) হতেই পারেন। না হলে অন্তত, সে দিকে একধাপ এগিয়েছেন।
মনোবিদ দের মতে, হোমোসেক্সুয়াল হোক বা হেটেরোসেক্সুয়াল, সঙ্গীর ‘আইকিউ’ যদি ভাললাগার কারণ হয়, তাহলে তিনি স্যাপিওসেক্সুয়ালই বটে। এখন তো আবার ‘ওপেন রিলেশনশিপ’ বা মুক্ত সম্পর্কের দিকে ঝুঁকছে জেন এক্স-জেন ওয়াই। কোনও রাখঢাক না করেই একাধিক সম্পর্কে দিব্যি ফুরফুরে মেজাজে থাকার বাসনা থেকেই এমন করছে মানুষ। প্রেমিক-প্রেমিকা বা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেও এমন সম্পর্কের সমীকরণ তৈরি হচ্ছে। যেখানে সঙ্গীর প্রয়োজনটুকুই প্রাধান্য পাবে, জোর খাটানো চলবে না। মোদ্দা কথা, কোনও বাঁধন থাকবে না। এমন সম্পর্ক কতটা টেকসই বা মজবুত হয় আমি আজ সে কথায় আসবো না, তবে আজাকাল ওপেন রিলেশনশিপেও মেধা, বুদ্ধি, বাকচাতুর্য এগুলো প্রাধান্য পাচ্ছে অনেকের কাছেই। তাই এমন সম্পর্কেও স্যাপিওসেক্সুয়ালিটি সমান প্রাসঙ্গিক।
সম্পর্ক যেমনই হোক না কেন, আপনার মন কী চায় সেটাই বড় ব্যাপার। পাড়া কিংবা মহল্লা কিংবা বিশব্বিদ্যালয়ের গন্ডি কাঁপানো সুন্দরীর থেকে শান্ত-শিষ্ট পড়ুয়া মেয়েটির দিকেও মন ঝুঁকতে পারে কোন ছেলের,অপর দিকে সুপুরুষ, কেতারদুস্ত পোশাক আর আকর্ষণীয় স্টাইল স্টেটমেন্টে মহিলাদের বুকে আলোড়ন তোলা ছেলেটির তুলনায় সুন্দর কথা বলতে পারা কাউকে আপনার মনে ধরতেই পারে।
মনোবিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখেছেন, এমন অনেক স্যাপিওসেক্সুয়াল (Sapiosexual) পুরুষ বা মহিলা রয়েছেন, যাঁরা বিপরীত লিঙ্গের মেধা দেখেই তাদের ভিতর তীব্র যৌনতার শিহরণ অনুভব করেন। সেই সব ছেলে অথবা মেয়ে শুধুমাত্র তেমন মানুষের সঙ্গেই শারীরিক সম্পর্কে যেতে চান, যাদের ভিতর আইকিউ লেভেল বেশি আছে। যাদের ভিতর ক্ষুরধার বুদ্ধি আর চৌকস রসবোধ আছে।
স্যাপিওসেক্সুয়াল (Sapiosexual) শব্দটি ২০০২ সাল থেকে সোসাল মিডিয়াতে ভাইরাল হতে শুরু করেছিল। বুদ্ধির টানে প্রেম নতুন কিছু নয়। বুদ্ধিমান মানুষকে জীবনসঙ্গী বেছে নিতে চান অনেকেই। এতদিন শুধু গালভরা এই শব্দটা পরিচিতির আড়ালে ছিল। এখন স্যাপিওসেক্সুয়ালিটি তরুণ প্রজন্মের কাছে বেশ পরিচিত শব্দ হয়ে উঠেছে। স্যাপিওসেক্সুয়ালকে আবার স্যাপিওফাইলদের সঙ্গে গুলিয়ে ফেললে চলবে না।
স্যাপিওসেক্সুয়াল (Sapiosexual) রা একইসঙ্গে মানসিক ও শারীরিক সম্পর্কের প্রতি আকৃষ্ট হন। কিন্তু স্যাপিওফাইলরা (Sapiofilel) শুধুমাত্র যৌনতায় আগ্রহী। সেখানেও বুদ্ধিমত্তা প্রাধান্য পায়, তবে মনের টান থাকে না। এখন যে প্রশ্নটা মনে ঘুরপাক খাচ্ছে তা হল, এখন প্রশ্ন রাখা যায়,আপনি স্যাপিওসেক্সুয়াল কিনা বুঝবেন কীভাবে? দেখুন তো আপনার ভিতর এই ব্যাপারগুলো মিলে যায় কিনা?
মডেল – মৌসুমি হামিদ এবং অর্শা । ছবি – কালাক্ষর ডেক্স
আপনি আপনার পছন্দের মানুষটার কথা বলা, উপস্থিত বুদ্ধি, ‘সেন্স অব হিউমার’, আর পাঁচজনের সঙ্গে মেলামেশার দক্ষতা-এইসব কিছু তাঁর প্রতি আপনাকে আকর্ষণ করে। আপনি ছ্যাবলামি নয় স্মার্ট কথোপকথন পছন্দ করেন। আপনার রসিকতা ভাল লাগে তবে চটুল রসিকতা নয়, অহেতুক কৌতুক এর চেয়ে কারো বুদ্ধিদীপ্ত কথাবার্তা মনে ধরে। যা হোক কিছু একটা বলে দিলাম এই সব নয়, কারো ভিতর পরিবেশ-পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে গুছিয়ে কথা বলার যোগ্যতাই পছন্দ আপনার। আপনি আপনার সঙ্গীর মধ্যেও এই গুণটাই চান। ডিনার ডেটে সেই মানুষ টি কী পোশাক পরে আসছে সেটা আপনার কাছে বড় কোন ইস্যু নয়, নানান বিষয়ে সেই মানুষটি কেমন জ্ঞান রাখে, আপনার সাথে সে কতটা খোলামেলা আলোচনা করতে পারে সেটাই আপনার কাছে বড় কথা। আর এমন সঙ্গীর সঙ্গে যদি জমিয়ে একটা ডিবেট সেশন করা যায়, তাহলে তো জমে ক্ষীর। আপনি চান আপনার সঙ্গী কখনওই আপনার চেহারা বা মেকআপ নিয়ে কথা বলবে না, বরং আপনি কোন কোন বিষয় রুচি রাখেন সেই বিষয় হবে তাঁর আলোচনার বিষয়বস্তু।
সঙ্গী আপনার মন বোঝার চেষ্টা করবে, ভাইটাল স্ট্যাটিসটিক্স নয়। বোকা বোকা আচরণ করবে না, মার্জিত-রুচিশীল ভাব থাকবে। আপনার মুখের গড়নের চেয়ে বুদ্ধির চাকচিক্যকে গুরুত্ব দেবে বেশি। আপনি যদি স্যাপিওসেক্সুয়াল হন, আর আমার বর্নানার বিষয়গুলো যদি আপনার সেই মানুষের সাথে মোটামুটি মিলে যায়, তাহলে আপনার মন ক্র্যাস খেয়ে বলতে বাধ্য,
“কতবার ভেবেছিনু আপনা ভুলিয়া /তোমার চরণে দিব হৃদয় খুলিয়া/ চরণে ধরিয়া তব কহিব প্রকাশি/ গোপনে তোমারে, সখা, কত ভালোবাসি।”
Leave a Reply