চেঙ্গিস খানের হাত ধরে মহা প্রতাপশালী মঙ্গল বাহিনীর উত্থান ইতিহাসের এক কাল উত্তির্ণ কাল অধ্যায়ের ঘটনা। চেঙ্গিস খানের মোঙ্গল বাহিনী যে খানে গিয়েছে সেখানকার সব কিছু তছনছ করে দিয়েছে। বইয়ে দিয়েছে রক্ত গঙ্গা। চেঙ্গিস খানের মৃত্যুর পর তার বংশধরেরা ও সেই ধ্বংস লীলায় যোগ দিয়েছে। চেঙ্গিস খানের নাতি হালাকু খান এর ভিতর ঘটিয়ে ফেলে ইতিহাসের সব চেয়ে নিসঃসংস ঘটনা। তৎকালীন সময়ের জ্ঞ্যান বিজ্ঞানের আঁতুড়ঘর বাগদাদে হালাকুখানের বাহিনী চালায় এক রক্তের হলি খেলা, ফেরাত নদী হয়ে যায় রক্ত স্নাত। এর সাথে সাথেই পতন হয় আব্বাসীয় খিলাফতের। রক্তপিপাসু হালাকু বাহিনী সেদিন বাগদাদকে রক্তগঙ্গায় পরিনত করে। হালাকু খানের বাগদাদ আক্রমনের কথা আমরা প্রায় সকলেই জানি, কিন্তু এই আক্রমনের পিছনে যে কারণটি সবার অলক্ষ্যেই রয়ে গেছে এতকাল, তা নিয়েই সৃজনশীল বাংলা ব্লগ “কালাক্ষর” এ আজকে আলোচনা।
সর্বশেষ আব্বাসীয় খলিফা ছিলেন আল মুসতাসিম বিল্লাহ। মুসতাসিমের শাসনকালের শেষদিকে মিশরে সর্বশেষ আইয়ুবি সুলতান আল মালিকুস সালিহ নাজমুদ্দীন আইয়ুব ইন্তেকাল করেন। ক্ষমতায় বসেন তার বিধবা স্ত্রী শাজারাতুদ দুর। আর এভাবেই মিশরে সূচনা হয় মামলুক শাসনের।
মুসতাসিম যদিও ব্যক্তিগত জীবনে অনেক গুণের অধিকারী ছিলেন; কিন্তু শাসক হিসেবে ছিলেন অযোগ্যদের শিরমনি। একটি পতনান্মুখ সাম্রাজ্যকে নিয়ন্ত্রণ করার কৌশল তার জানা ছিল না। তার উজির ছিল আলকামি। আলকামী ছিল কট্টর শিয়া মতবাদের অনুসারী। মুলত তার উসকানিতেই সেই সময় একবার বাগদাদে শিয়া-সুন্নি দাঙ্গা শুরু হয়। আর এই দাঙ্গার ফলে বাগদাদের জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। খলিফা তার বাহিনী দিয়ে কোন ভাবে দাঙ্গা থামায়। আর দাঙ্গার রেশ যখন কমে এসেছে তখন আলকেমি শুরু করেন আর এক কুটচাল। এই সময় আলকামি খলিফা মুস্তামিম কে পরামর্শ দেয় তাদের এত বড় সেনাবাহিনী লালন করার কোনো দরকার নেই। এই সেনাবাহিনী পালতে অযথাই অটেল অর্থ ব্যয় হচ্ছে। সেনাবাহিনীর পিছনে অযথা খরচ না করে তা দিয়ে অন্য কোন জন কল্যাণ কর কাজ করা উচিৎ। সেনাবাহিনীর সংখ্যা কমিয়ে সেই অর্থ বাচিয়ে জনকল্যান কর কাজ করা হয়ত ভাল পড়ামর্শের পর্যায়ে পড়ে, কিন্তু কোন দেশ টিকিয়ে রাখতে সেনাবাহিনীর কতটা দরকার তা অযোগ্য খলিফার মাথাতেই আসেনি। আর তাই আলকামির পরামর্শে খলিফা সেনাবাহিনীর সদস্যসংখ্যা হ্রাস করেন। এটি ছিল খলিফা মুনতাসিমের নেওয়া একটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত, যা শত্রুদের বাগদাদ আক্রমনের কাজ সহজ করে দিয়েছিলো। আলকেমী কেন খলিফাকে সেনাবাহিনীর সংখ্যা কমাতে বলেছিলেন? আর এর পিছনে কি ছিল তা খলিফা বুঝতে পারেন নি। অদুর্দশি খলিফার সেই চিন্তা করার ক্ষমতাও ছিল না। তবে ঐতিহাসিক দের মতে ঐ সময় শিয়া আর সুন্নি মতবাদের সাংঘর্ষিক অবস্থাই এর মুল কারণ, শিয়ারা কোন ভাবেই চাচ্ছিল না বাগদাদের নিয়ন্ত্রন সুন্নি খলিফার হাতে বহাল থাকুক। আর আলকেমী যখন দেখলো নির্বোধ খলিফাকে সে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। তখন সে বাগদাদের খলিফার শাসন ধংসের জন্য উঠে পড়ে লাগে, তার ধারাবাহিকতা তেই খলিফার সেনাবাহিনীর সংখ্যা হ্রাস করতে খলিফার মগজ ধোলাই করা হয়।
আলকামি শিয়া হলেও খলিফার উজির ছিল এবং খলিফা তার পরামর্শ মেনে নিতেন; কিন্তু খলিফা আলকেমি কে পছন্দ করলেও শিয়াদের খুব একটা পছন্দ করতেন না। খলিফা আবু বকর এবং আমির রুকনুদ্দীন কারখের মহল্লায় শিয়াদের একটি বসতিতে হামলা করেন। আলকামি এতে প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হয়। সে সিদ্ধান্ত নেয়। আব্বাসিদের হটিয়ে আলাবিদের শাসন প্রতিষ্ঠিত করবে। সেনাবাহিনীর অবশিষ্ট অংশকেও ভেঙে দেয়।
খলিফা যখন আলকেমীর কথায় তার সেনাবাহিনীর সংখ্যা একেবারে হ্রাস করে ফেললেন তখন আলকেমী যোগাযোগ করলেন চেঙ্গিস খানের নাতী হালাকু খানের সাথে। আলকেমী হালাকু খানের কাছে পত্র লিখে বাগদাদের অবস্থা এবং খলিফার বাহিনীর সকল খবর দিয়ে তাকে বাগদাদ আক্রমণের পরামর্শ দেয়। আবুল ফিদা লিখেছেন, আলকামি হালাকু খানের কাছে পত্র লিখে বাগদাদ আক্রমণ করতে বলে এমন কি সে তার নিজের ভাইকে মৌখিক বার্তা দিয়ে হালাকু খানের কাছে পাঠায়। ঐতিহাসিক জালালুদ্দীন সুয়ুতি বাগদাদ আক্রমনের ঘটনা নিয়ে লিখেছেন, খলিফা তার শিয়া উজির আলকামির উপর খুব ভরসা করতেন। সে যেভাবে চাইত খলিফাকে ব্যবহার করত। গোপনে সে তাতারদের (মোঙ্গলদের অপর নাম) সাথে বার্তা বিনিময় করে। তার এই যোগাযাগ সম্পর্কে খলিফা কিছুই জানতেন না। হালাকু খান আলকামির পত্র পেতেই আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু তার মনে কিছুটা দ্বিধাও ছিল। আব্বাসি খিলাফতে আক্রমণ করলে পুরো মুসলিম বিশ্ব ফুসে উঠবে। এই ঝুঁকি নিবে কিনা তা নিয়ে হালাকু খান দ্বিধান্বিত ছিল। এ সময় হালাকু খানের দরবারে শিয়া জ্যোতির্বিদ নাসিরুদ্দীন তুসির খুব প্রভাব ছিল। হালাকু খান কোন কাজ করার আগে তার পরামর্শ নিতেন। সে হালাকু খানকে বাগদাদ আক্রমণের পরামর্শ দেয়।
মঙ্গোল আক্রমন
৬৫৫ হিজরির জিলহজ মাসে হালাকু খান তার বাহিনী নিয়ে রওনা হয়। এ সময় আব্বাসি খলিফা ছিলেন আমাদ-প্রমাদে ব্যস্ত। এখানে একটি ঘটনা বলা যায়। হালাকু খানের বাগদাদ আক্রমণের আগে মোসুলের ( বর্তমানে সিরিয়ার অন্তর্গত) আমির বদরদ্দীন লুলুর কাছে দুটি পত্র এসেছিল। একটি পাঠিয়েছিলেন খলিফা মুসতাসিম। তিনি একজন ভাল গায়িকার সন্ধান চেয়েছিলেন। অপর পত্র অসেছিল হালাকু খানের পক্ষ থেকে। সে চেয়েছিল ভাল একটি মিনজানিক। এই দৃশ্য দেখে বদরুদ্দীন লুলু বলেছিল, ইসলাম এবং তার অনুসারীদের জন্য কাঁদো। আমির বদরদ্দীন লুলুর এ কথা থেকে বুঝা যায় হালাকু খান যখন বাগদাদ আক্রমণের পরিকল্পনা সাজাতে ব্যস্ত, খলিফা তখন বিনাদনে মত্ত। ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় যে রাজা তার রাজ দায়িত্ব অবহেলা করে আমোদ প্রমদে মেতে থেকেছে তার ধ্বংস খুব তারা তারি হয়েছে। আর কোন রাজার রাজত্তে বহিঃশত্রুর আক্রমন হলে সেই রাজ্যের জনগন কে তার চরম মুল্য দিতে হয়েছে। সে জাতির ধ্বংস হয়ে গেছে নয়ত বিদেশীর গোলামীতে পরিনিত হয়েছে, তাই খলিফার ভাগ্যে দুর্যোগ আসবে এটাই স্বাভাবিক।
মঙ্গোল আক্রমনে জলছে বাগদাদ । সোর্স – গুগুল
হালাকু খানের বাহিনী বাগদাদের কাছাকাছি চলে এল। এদিকে খলিফা তার সেনাবাহিনী আগেই ছোট করে ফেলেছেন। মোঙ্গলদের প্রতিরোধ করার কেউ নেই। সে সময় মঙ্গোলদের প্রতিহত করার জন্য আব্বাসিয় খলিফা মুনতাসিমের একটি ক্ষুদ্র বাহিনী এগিয়ে গেলেও মঙ্গোল রা তাদের সহজেই তাদের পরাজিত করে। হালাকু খানের বাহিনী এগিয়ে এসে বাগদাদ অবরাধ করে। তখনো আলকামির প্রতিশোধের নেশা থামেনি। সে খলিফা এবং শহরের গণ্যমান্যদের আশ্বাস দিয়ে বলে হালাকু খান কারো কোন ক্ষতি করবে না। এমনকি নিজের মেয়ের সাথে খলিফার ছেলে আবু বকরের বিয়ে দিবে। এই বলে সে খলিফা, আমির ও আলেমদের এক বিশাল জামাতকে হালাকু খানের কাছে নিয়ে যায়। হালাকু খান তাদের সবাইকে হত্যা করে। এমনকি খলিফাকে চটের নিচে ফেলে তার উপর ঘোড়া ছোটানো হয়। নির্মম ভাবে অত্যাচার করে হত্যা করা হয় খলিফাকে। হত্যার পর তার দাফন-কাফনও করা হয়নি।
এর পর মঙ্গোলরা বাগদাদে প্রবেশ করে টানা কয়েকদিন তারা এখানে নির্মম গণহত্যা চালায়। ইবনে খালদুনের বর্ণনামতে এই সময় মঙ্গোল রা বাগদাদে ১৬ লক্ষ মানুষকে হত্যা করে। বাগদাদের সমৃদ্ধ লাইব্রেরী গুলোর সব বই তারা দজলা নদীতে ফেলে দেয়। হালাকু খান লাইব্রেরী পোড়াচ্ছিল আর বলছিল এমন বিদ্যার কি প্রয়োজন যে বিদ্যা তাদের মাতৃভূমিকে শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করতে পারে না? মুসতাসিমকে হত্যার মধ্য দিয়ে আব্বাসিদের পাঁচশো বছরের শাসনের অবসান ঘটে। সমৃদ্ধ শহর বাগদাদকে নির্জন কবরস্থানে পরিণত করে তবেই তাতাররা বাগদাদ ত্যাগ করে। বের হয় মুসলিম রাজ্য গুলো দখল করতে। এক এক করে সব দেশ দখল করে মঙ্গল রা মধ্যপ্রাচ্যে মুসলিম দের শেষ ভুমি মিশরের প্রান্তে এসে পৌছায়।
তথ্যসূত্রঃ
১. সিয়ার আলামিন নুবালা– ২২/১৭৫
২. আব্বাসীয় খিলাফাহ– ইমরান রাইহান – পৃঃ ২৭৫–২৭৬
৩. তারিখে ইবনে খালদুন – ৩/৪৫৩
৪. দাওয়ালুল ইসলাম – ২/১১৯
Leave a Reply