স্বপ্ন দেখা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। আর তাই জীবনে চলার পথে আমরা রোজ স্বপ্ন দেখি। বাড়ি, গাড়ি, সফলতা, কাঙ্খিত মানুষ কত কিছুই না থাকে সেই স্বপ্নে। থাকে দুনিয়ার এক মাত্র সুপার পাওয়ার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ার আশাও! আবার অনেকের স্বপ্ন থাকে একদম সহজ সরল। তাদের স্বপ্ন থাকে দুইবেলার খাবার, মাথার উপরে একটা ছাদ আর সম্মানের সাথে বেঁচে থাকার মতো একটা সম্মান জনক জীবিকা। এর পর সেই স্বপ্নের পেছনে ছোটা। কেউ সফল, আবার কেউবা ব্যর্থতার ফাঁদে পড়ে ছেড়ে দেয় সব। একসময় মূল্যবান এই জীবনটাও!
সৃজনশীল ব্লগ কালাক্ষর এ আজ আপনাদের একজনের গল্প জানাবো,যে ব্যাক্তি একটা মাত্র পরিকল্পনাতেই ৩০০ বারের বেশি প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলেন। তবুও হাল ছাড়েননি। আবার নতুন করে স্বপ্ন দেখেছেন, পরিকল্পনা সাজিয়েছেন। এগিয়ে গেছেন। অবশেষে হয়েছেন সফল। অবিশ্বাস্য লাগছে না?
ওয়াল্টারের জন্ম ১৯০১ সালের ৫ ডিসেম্বর, শিকাগো শহরের এক দরিদ্র পরিবারে। ওয়াল্টার জার্মান-আমেরিকান মা আর আইরিশ-আমেরিকান বাবার পাঁচ সন্তানের একজন ছিলেন তিনি। দরিদ্রতার কারণে শহর ছেড়ে গ্রামে চলে যেতে বাধ্য হয় তার পরিবার। ওখানে ওয়াল্টারের বাবা ইলাইয়াস একটা খামারে কাজ নেন। সেই খামারের পশুপাখিদের সাথেই ওয়াল্টারের গড়ে ওঠে সখ্যতা। আর একটা পর্যায়ে সেই সখ্যতা থেকেই শুরু করেন আঁকাআঁকি। ছোটখাটো বন্ধুত্বপূর্ণ প্রাণীগুলো কেমন যেন হাসিখুশি রূপ পেতো তার হাত ধরে। বিশেষ করে ইঁদুর আঁকার প্রতি প্রচন্ড ঝোঁক ছিল তার দরিদ্র সংসার তাই গ্রামের লোকজনের কাছে সামান্য কিছুর বিনিময়ে ওয়াল্টার সেই কার্টুন ছবিগুলো বিক্রি করতেন।
ওয়াল্টারের বাবা একদিন অসুস্থতার কারণে খামারের কাজটা ছেড়ে দেন। ফলে তাদের পরিবারের সবাই ক্যানসাসে চলে আসে। এখানে ইলাইয়াস সংবাদপত্রের ব্যবসা শুরু করেন। আর ওয়াল্টার নিয়োজিত লেগে পড়েন সেই পত্রিকা বিক্রির কাজে।
ওয়াল্টার ও তার ভাই রয় রোজ ভোর সাড়ে চারটায় ঘুম থেকে উঠে সংবাদপত্র নিয়ে বেড়িয়ে পরতেন। এরপর যেতেন স্কুলে। সেখান থেকে ফিরে আবার একই কাজ। ক্লান্তিতে ক্লাসে মনযোগ দিতে পারতেন না। এভাবে কেটে যায় অনেকগুলো বছর। ওয়াল্টারের পড়াশোনা আর হলো না। তাই ওয়াল্টার তাঁর ১৬ বছর বয়সে সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে ঘর ছাড়েন। কিন্তু কপাল মন্দ বয়স কম থাকার কারণে বাদ পড়েন।
এর পর ওয়াল্টার স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে আন্তর্জাতিক রেড ক্রসে যোগ দেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ফ্রান্সে টানা এক বছর অ্যাম্বুলেন্স চালিয়েছিলেন তিনি। তারপর দেশে ফিরে এসে ক্যানসাসের একটা আর্ট স্টুডিওতে চাকরি নিলেন।কিন্তু কিছুদিনের মাঝেই সেই চাকরি থেকে বরখাস্ত হন।
চাকরীদাতার ভাষ্যমতে, ওয়াল্টারের কল্পনাশক্তির ঘাটতি রয়েছে। নেই ভালো কোন বুদ্ধিও।
কিন্তু ওয়াল্টার তাতেও দমে গেলেন না। নতুন উদ্যমে আব আইওয়ার্কস নামক এক সহকর্মীকে নিয়ে নিজের বাণিজ্যিক কোম্পানি গঠন করলেন। অবশ্য গ্রাহকদের আকর্ষিত করতে পারলেন না তারা। ব্যর্থ হলেন।
এবার ওয়াল্টার তার ভাই রয়কে নিয়ে মনযোগ দিলেন কার্টুন তৈরিতে। শুরু হলো নতুন কোম্পানি, লাফ-ও-গ্রাম (Laugh-O-Gram)। তাদের তৈরি কার্টুন জনপ্রিয়তাও পেল বেশ, তবে যথেষ্ট অর্থ উপার্জন করতে পারলো না। ফলাফলে কোম্পানিটি দেউলিয়া হলো। কিন্তু তিনি ভেঙে পড়লেন না।
মাত্র ২০ ডলার পকেটে নিয়ে এবার পথ ধরলেনর। চেষ্টা করলেন অভিনেতা হওয়ার। ব্যর্থ হলেন প্রচন্ডভাবে। ভাইকে ধরলেন আবার। এরপরই Oswald the lucky Rabbit নামক কার্টুনের হাত ধরে প্রথম সফলতার মুখ দেখলেন তিনি। তবু ভাগ্য সহায় হলো না তার। সাময়িক সফলতা কেটে গেলো। নিজের সৃষ্ট চরিত্রের উপর থেকে নিজেই অধিকার হারালেন ওয়াল্টার।
কিন্তু তা নিয়ে মোটেও দুঃখ করে সময়ক্ষেপণ করলেন না। ওয়াল্টার তার সেই পুরোনো সহকর্মী আব আইওয়ার্কসকে নিয়ে সৃষ্টি করলেন নতুন আরও একটি কার্টুন চরিত্র- মর্টিমার। কিন্তু এতে স্ত্রী লিলি বাধ সাধলেন। তিনি ভাবলেন নামটায় কেমন যেন ভিলেন ভাব আছে। তাই লিলির পরামর্শে মর্টিমার নামটা বদলে হয়ে যায় ‘মিকি মাউস’।
মিকি মাউচ। ছবি successconsciousness.com
ছোট বেলায় মিকি মাউস দেখেননি বা মিকি মাউস সম্পর্কে একেবারেই জানেন না বোধ করি এমন মানুষ বোধ হয় ধরাধামে খুঁজে পাওয়া যাবে না। কিন্তু এই মিকি মাউসের জনক ওয়াল্ট ডিজনিকে কয় জন ই বা জানেন? হ্যাঁ এতক্ষণ তার কথা বলছিলাম তিনি ওয়াল্টার ইলাইয়াস ডিজনি। সংক্ষেপে ওয়াল্ট ডিজনি।
এবার গল্পে ফেরা যাক, মিকি মাউস ওয়াল্টকে বিশাল সফলতা এনে দিলো৷ তারপর খুব একটা পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। এগিয়ে গেছেন ধীরে ধীরে।
প্রায় পুরোটা জীবন জুড়ে ওয়াল্টার একের পর এক ঝুঁকি নিয়েছিলেন। সফলতার আশায় বিশাল সব নিয়োগ করেছিলেন বিভিন্ন কাজে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ২ মিলিয়ন ডলার খরচ করেছিলেন তিনি Snow White মুভিটার উপর। প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য কার্টুন চলচ্চিত্র ছিলো এটি। সবাই তখন তাকে বাধা দিয়েছিলো। বলেছিলো সাবধান হতে। এতগুলো টাকা সব হারাতে পারেন তিনি৷ কিন্তু ওয়াল্ট সাহেব একটা কথা খুব বিশ্বাস করতেন। ‘যদি তুমি স্বপ্ন দেখতে পারো, তবে তা সত্যও করতে পারবে।’ তাছাড়া নিজের সৃষ্টির প্রতি প্রচন্ড বিশ্বাসী ছিলেন তিনি। যার ফলও পেয়েছিলেন। Snow White অসাধারণ সফলতা বয়ে আনে।
ডিজনি স্টুডিও এর লোগো
এখানেই কিন্তু থেমে যাননি ওয়াল্ট। একে একে উপহার দেন Pinocchio, Fantasia, Dumbo, Bambi, Cinderella, Mary Poppins সহ ৮১টি চমৎকার সব চলচ্চিত্র। এরমাঝে নতুন আরেকটি পরিকল্পনা এলো। ‘পৃথিবীর সবচাইতে আনন্দের স্থান’ এর পরিকল্পনা। বিশ্বাস করুন আর নাই-বা করুন, ‘ডিজনিল্যান্ড’ এর এই পরিকল্পনা ৩০০ বারের বেশি প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলো। যদি তাতে তিনি হাল ছেড়ে দিতেন, তবে কি ১৯৫৫ সালের ১৭ জুলাই ঐ মায়াবী কল্পনাজগতের বাস্তব রূপটা উদ্বোধিত হতো?
ওয়াল্ট ডিজনির কল্পনাশক্তি, কর্মক্ষমতা আর পরাক্রমশালী মানসিকতা ইতিহাস মনে রাখবে সবসময়। তিনি আমাদের দেখিয়ে গেছেন, শুধুমাত্র বিশাল সব স্বপ্ন দেখাই যথেষ্ট নয়, যতক্ষণ না পর্যন্ত আপনি অধ্যবসায়ী হয়ে কঠোর পরিশ্রম করে সেই স্বপ্ন আর পরিকল্পনাগুলোকে প্রাণ দিচ্ছেন।
জীবনে আপনি যদি স্বপ্ন দেখতে পারেন, আর যদি সেই স্বপ্নের পিছনে ঠিক মত সময় দেন তবে তা এক সময় বাস্তবায়নও করতে পারবেন। আর আপনি যদি ব্যর্থ হন। সাহস করে ভুল করুন। আপনি যদি আপনার পুরো জীবন ভুলের ভয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাপারগুলো এড়ানোর মাঝেই শেষ করে ফেলেন, তাহলে আপনি হয়ত ব্যর্থতা এড়াতে পারবেন। কিন্তু তাতে আপনার সফলতাও হাত ফসকে বেরিয়ে যেতে পারে।
ওয়াল্ট ডিজনি দরিদ্র সংসারে জন্মেছিলেন। কিন্তু কঠোর পরিশ্রমের প্রতি ভীত ছিলেন না তিনি৷ চাকরিচ্যুত হয়েছিলেন, হয়েছিলেন দেউলিয়া আর কপর্দকহীন। ব্যর্থ হয়েছিলেন শতশতবার। প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলেন অসংখ্য পরিকল্পনায়। কিন্তু কখনও থেমে যাননি। এগিয়ে গেছেন। সব নতুন করে শুরু করেছেন বারবার। ফলাফলে ২৬টি অস্কার (২২টি প্রতিযোগিতামূলক, ৪টি অনারারি), ৩টি গোল্ডেন গ্লোভ অ্যাওয়ার্ড, ১টি এমি অ্যাওয়ার্ড।
.
References:
Leave a Reply