সোলায়মান জুয়েলঃ বাংলার ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ যা বাংলার মন্মন্তর বা পঞ্চাশের মন্মন্তর নামে পরিচিত সেই দুর্ভিক্ষ এর বড় কারণ ছিল তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের কিছু ভুল নীতি। আর তারা এই ভুল ইচ্ছাকৃত ভাবে করেছিলেন- তার প্রধান কারন গুলো নিয়েই আজকের পোস্ট মর্টেম –
সাম্প্রতিক কালে এক গবেষণা দেখা গেছে, ১৯৪৩ সালে বাংলায় যে দুর্ভিক্ষ হয়েছিল তা শুধুমাত্র খরার কারণে হয়নি। বাংলার মন্বন্তর নামে পরিচিত এই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ বা খাদ্যাভাবের ঘটনার পিছনে ততকালিন উপনিবেশিক ব্রিটিশ সরকারের নীতির বড় ধরনের ভূমিকা রয়েছে। সম্প্রতি ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গবেষকদের যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত এক গবেষণা পত্রে এই সংক্রান্ত বৈজ্ঞানিক প্রমাণ হাজির করা হয়েছে। গত উনিশ শতকের ৭০ এর দশক থেকে বিশ শতাব্দীর ৪০ এর দশক পর্যন্ত হওয়া প্রায় ৬টি দুর্ভিক্ষের সময় মাটির আদ্রর্তার পরিমাণ পরিমাপ করে তুলনামূলক ভাবে বিশ্বাসযোগ্য তথ্য বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে ওই গবেষণা কর্ম সম্পন্ন হয়েছে বলে জানা যায়। উল্লেখ্য, যে আগেও ১৩৫০ বঙ্গাব্দের ভয়াবহ ওই দুর্ভিক্ষের কারণ হিসেবে তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইন্টার চার্চিলের নীতির প্রত্যক্ষ ও প্রত্যাক্ষ ভূমিকার কথা উঠে এসেছে।
আমার লেখা ব্লগ গুলো পরতে লিংক গুলোতে ক্লিক করুন –
১৮৭৩ সাল থেকে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত হওয়া এই ৬টি দুর্ভিক্ষের সময়ে বাংলার আবহাওয়া ও জলবায়ু সংক্রান্ত তথ্যের ভিত্তিতে ওই গবেষণা সম্পন্ন হয়েছে। গবেষক গন কোন দুর্ভিক্ষের সময় মাটির আর্দ্রতার পরিমাণ কেমন ছিল, তার ভিত্তিতেই গবেশক গন তাদের গবেষণার সিদ্ধান্ত টেনেছেন। এবং এতে দেখা গেছে, ওই ৬ দুর্ভিক্ষের মধ্যে ৫টির প্রধান কারণ মাটির আদ্রতার পরিমাণ ভয়াবহভাবে কমে যাওয়া, যা তাদের গবেষণায় ধরা পড়ে। যেমন ১৮৯৬-৯৭ সালে ব্রিটিশ শাসিত উত্তর ভারতের মাটির আদ্রতার পরিমাণ ১১ শতাংশ কমে যায় এর ফলে যে খাদ্য সংকট বা দুর্ভিক্ষ হয়েছিল, তাতে প্রাণ হারিয়েছিল প্রায় ৫০ লাখ মানুষ।
তবে ওই গবেষণার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বাংলায় ১৯৪৩ সালের যে দুর্ভিক্ষ হয়েছিল তার প্রধান কারণ খরা নয়। যদিও দুর্ভিক্ষের তিন বছর আগেই তৎকালীন ভারতের পূর্বাঞ্চল যা ১৯৪০ সালের বেশিরভাগ সময় ছিল খরার কবলে ছিল এবং ১৯৪১ সালে এসে সেই অবস্থার ভয়াবহ রূপ নেয়। পত্রিকাগুলো তখনকার উপনিবেশিক ব্রিটিশ সরকারের দেওয়া নিষেধাজ্ঞা ভেঙে পত্রিকার পাতায় ছাপতে শুরু করে দুর্ভিক্ষের খবর, ছাপাতে থাকে কলকাতার রাস্তায় পড়ে থাকা না খেয়ে মরা মানুষের ছবি। কিন্তু গবেষণায় দেখা যায় যে, যে বছর বাংলায় ওই দুর্ভিক্ষ প্রবল আকার নেয় বলে প্রচলিত আছে, সেই বছর মানে ১৯৪৩ সালে গড়পড়তা বৃষ্টির পরিমাণ স্বাভাবিকই ছিল। তা হলে প্রশ্ন আসে কেন হয়েছিল এই মর্মান্তর?
এই বিষয়ে গান্ধীনগরের ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অব টেকনলজির অধ্যাপক যিনি এই গবেষণার প্রধান গবেষক হিসেবে দায়িত্ব প্রাপ্ত ছিলেন সেই বিমল মিশ্র ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানকে দেওয়া এক সাক্ষাৎ কারে বলেছেন, এটা ছিল এক অভাবনীয় দুর্ভিক্ষ; এর জন্য বৃষ্টিপাত কম হওয়া যতোটা দায়ী করা যায়, তার চেয়ে ঢের বেশি দায়ী ব্রিটিস সরকারি নীতির ব্যর্থতাকেই বেশি দায়ী করা উচিৎ । তিনি বলেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ফসলে পোকার আক্রমণের বিস্তৃতি হয়ত তখন হয়েছিল কিন্তু তার পরিমান খুব বেশি ছিল না,যতটা বেশি ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তখন কার নাম বার্মা বর্তমান নাম মিয়ানমার ব্রিটিশদের হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার কারণে বাংলায় খাদ্য তথা নিত্য প্রয়োজনিয় দ্রবাদীর যে সরবরাহ ব্যবস্থায় তীব্র ধস নেমে আসে ফলে,মুলত এই দ্বিমুখী কারন এক সাথে যুক্ত হবার ফলেই বাংলায় সেই সময় দুর্ভিক্ষের থাবা নেমে আসে।
এই প্রসঙ্গে অবশ্য ভারতের নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন ভিন্ন মতমত দ্যান। তিনি মানে অমর্ত সেন ১৯৮১ সালে বলেছিলেন যে, ৪৩ এর মন্মান্তর বা ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের সময়ও তৎকালীন বাংলা অঞ্চলে পর্যাপ্ত পরিমানে খাদ্যের যোগান ছিল। কিন্তু যুদ্ধকালিন মুদ্রাস্ফীতি আর কিছু ফটকা ক্রেতা এবং কিছু সার্থেন্নসি মজুদদারদের মিলিত দৌরত্বের কারণে ঐ সময় খাদ্যের দাম সাধারন মানুষ তথা গরীব মানুষের ক্রয়সীমার বাইরে চলে যায় । বিখ্যাত বই ‘চার্চিলস এম্পায়ার’ এর লেখক জনাব রিচার্ড টয়ীও মনে করেন যে, বাংলার এই দুর্ভিক্ষ জনাব চার্চিলের জীবনের সবচেয়ে বড় খারাপ রেকর্ডগুলোর একটি। তার মতে, “ইউরোপে জার্মানির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তখন তিনি এতই ব্যস্ত ছিলেন যে, বাংলার এই দুর্ভিক্ষ নিয়ে লোকজন তার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা বারবার করে গেলেও তিনি এটাকে একেবারেই পাত্তা দেননি।”
এদিকে জার্মানিবাসী বাঙালি গবেষক মধুশ্রী মুখার্জি এবং তার সহযোগীদের নিয়ে ৭ বছর ধরে অনেক নথিপত্র ঘেঁটে ২০১০ সালে একটি বই লেখেন, যার নাম দেন ‘চার্চিলস সিক্রেট ওয়ার’ বা ‘চার্চিলের গোপন যুদ্ধ’৷ গবেষক মধুশ্রী মুখার্জি এবং তার সহযোগীরা দাবি করেন যে,প্রধান মন্ত্রী চার্চিল নিজে সরাসরি বাংলার মন্বন্তরের জন্য দায়ী ছিলেন৷ যে হুতু বাংলায় যখন খাদ্য সংকট চলছে তার মোকাবেলা করা জনাব চার্চিলের কর্তব্যের ভিতরে ছিল, কিন্তু সেটা মোকাবেলায় তিনি কোনই পদক্ষেপই নেন নি। বরং তার যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভা তাদের দেশ তথা ইউরোপের বেসামরিক মানুষদের জন্য খাদ্য মওজুদ গড়ে তোলার নির্দেশ দিয়েছে। ভাবতে অবাক লাগে ভারতে যখন খাদ্যের অভাবে মানুষ মরছে, ঠিক তখনই বাংলাকে পাশ কাটিয়ে অস্ট্রেলিয়া থেকে এক লাখ সত্তর হাজার টন গম বহনকারী জাহাজ গেছে ইউরোপে। বাংলায় ত্রাণ সাহায্য পাঠানোর জন্য হাজার আবেদন সত্ত্বেও জনাব চার্চিল তার সর্বশক্তি প্রয়োগ করে বাংলায় সাহায্য পাঠানোর ব্যাবস্থা বন্ধ করেছেন বা করতে দেন নি৷ বাংলার অবস্থা খারাপ দেখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়া বাংলায় যে ত্রাণ পাঠানোর উদ্যোগ নিয়েছিল জনাব চার্চিল ও তাঁর মন্ত্রীরা সেই সময় তার বিরধিতা করে বাংলায় ত্রান পাঠাবার অনুমতি দেন নি৷
Leave a Reply