কন্সপিরেসি থিওরী কি? কাকে বলে? কন্সপিরেসি থিওরীর ইতিহাস ও উৎপত্তি নিয়ে আমার একটি দীর্ঘ লেখা আছে (লিংক) কিন্তু আমি আজকের আলোচনায় সেই প্রসঙ্গে নয় বরং আমাদের মাঝে বিরাজ করা কিছু অদ্ভুত কন্সপিরেসী থিউরী নিয়ে আজ আলোচনা করবো। আমাদের চারপাশে অনেক সন্দেহ বাতিকগ্রস্ত লোকেরাই বাস করেন, তাদের সেই সব সন্দেহ গুলো এক হয় মাঝে মাঝেই জন্ম দেয় যারা নানান কন্সপিরেসি থিওরীর। আর সেই সব কন্সপিরেসী থিওরী তে এরা বিশ্বাসও করে থাকেন। এই সব লোক গুলো ধারণা করে থাকেন, আমাদের পৃথিবীতে ঘটা আলোচিত ঘটনাগুলোর কথা মানুষ যেভাবে জানেন, ঘটনাটি আসলে সেভাবে ঘটেনি। বরং এর পেছনে রয়েছে অন্য রকম বিশেষ কিছু! শুধু কি তাই, প্রচন্ড সন্দেহবাতিক স্বভাবের এই লোক গুলো তাদের নিজেদের বক্তব্যের স্বপক্ষে নানান ধরণের তথ্যপ্রমাণও হাজির করতে প্রস্তুত থাকেন! সাম্প্রতিক কালের যেসব ঘটনা নিয়ে আমাদের মাঝে এরকম বেশ কিছু কন্সপিরেসি থিওরী বা ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ছড়িয়েছে, এর ভিতর অন্যতম হলো ২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর মাসে যুক্তরাষ্ট্রে চালিত সন্ত্রাসী হামলা বা “টুইন টাওয়ার হামলা” !
২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর মাসে যুক্তরাষ্ট্রে উগ্রবাদী সন্ত্রাসীরা ৪টি যাত্রীবাহী বিমান ছিনতাই করে,যার দুটি আঘাত করে যুক্তরাস্টের নিউইয়র্ক সিটির ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ভবনে, একটি যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসি তে অবস্থিত পেন্টাগনে। আর বাকিটি পেনসিলভানিয়ার একটি মাঠে বিধ্বস্ত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের সব চেয়ে ভয়াবহ এই সন্ত্রাসি হামলায় সব মিলিয়ে প্রায় ৩ হাজার লোক নিহত হয়। আর এই হামলা নিয়ে মানুষের ভিতর বিচিত্র সব কন্সপিরেসি থিওরী’ প্রচলিত আছে। কোনো কোনোটিতে বলা হয়েছে, মার্কিন সরকার নিজেই ওই ঘটনায় জড়িত ছিলো। কেউ বলেন, মার্কিন কর্মকর্তারা ইচ্ছে করেই আক্রমণটি ঘটতে দিয়েছেন। অন্য অনেকে বলেন, ঘটনার পরিকল্পনাতে ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা জড়িত ছিলো…
চলুন আজ আমরা এমনই কিছু চিত্তাকর্ষক কন্সপিরেসি থিওরীর কথা জানি, যা নিয়ে ১৬ বছর পরও আলোচনা বিতর্ক শেষ হয়নি !
২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর মাসে যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ার হামলার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই প্রথম কন্সপিরেসি থিওরীটি ছড়ায়। ঐ দিন ডেভিড রস্টচেক নামের এক ইন্টারনেট ব্যবহারকারী লিখেছিলেন, “কেউ কি খেয়াল করেছেন যে ওয়ার্ল্ড টেড সেন্টার ভবনটি বিমানের আঘাতে ধ্বংস হয়নি? নাকি শুধু আমিই এটা বুঝেছি?”
পেট্রনাস টুইন টাওয়ার ধ্বসের ভিডিওচিত্র পর্যবেক্ষণ করলে দেখতে পারবেন, দুটি বিমান টুইন টাওয়ারের দুটি ভবনে আঘাত হানার পর প্রায় ৪০ মিনিটের মত ভবন দইটি দাঁড়িয়েছিল। এর পর ভবন দুটি পুরোপুরি ধ্বসে পরে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ভবন দুটি ধ্বসে পড়তে এত সময় কেনো লাগলো?
বিশেষজ্ঞরা বলেন, বিমান টুইন টাওয়ারের দেয়ালে ক্র্যাশ করার পর বিমানের ভিতরে থাকা ২০ হাজার গ্যালন জেট ফুয়েল ও বিস্ফোরিত হয়, এর ফলে এত বেশি পরিমাণ তাপ উৎপন্ন করে যে সেটি ভবনের গাঁথুনির রড গলিয়ে দেয় এবং ভবনটি ধ্বসে পড়ে। আর সেখানেই যত আপত্তি ! কেননা জেট ফুয়েলের দহন সর্বোচ্চ ৮১৫° ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা সৃষ্টি করতে পারে। কিন্তু লোহার গলনাঙ্ক প্রায় ১৫০০° ডিগ্রি সেলসিয়াস। রস্টচেকের বক্তব্য ছিলো, ভবন দুটিতে বিমান আঘাত করেছে এবং প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে এটা ঠিক কথা। কিন্তু যেভাবে টাওয়ার দুটি ভেঙে পড়েছে, তার জন্য এর ভেতরে সঠিক জায়গায় বিস্ফোরক বসাতে হত। তাহলে কি টুইন টাওয়ার ধ্বংস হয়েছিল বিমানের আঘাতে নয় বরং বোমার বিস্ফোরণে?
মার্কিন যুক্তরাস্টের প্রতিরক্ষা বাহিনী টুইন টাওয়ারের ধ্বংসাবশেষ তল্লাশির সময় মূল ঘটনাস্থলের অদূরে একটি পাসপোর্ট খুঁজে পায়, তাদের ভাষ্যমতে এটি টুইন টাওয়ারের হামলাকারী দলের নেতার ব্যবহার করা পাসপোর্ট। এই প্রমাণের ওপর ভিত্তি করেই মূলত ৯/১১ হামলার সাথে আরবের জঙ্গিদের হামলার সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ তোলা হয়।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ঘটনাস্থলে এত বেশি পরিমাণ তাপ উৎপন্ন হয়েছিলো যে, সেটি ভবনের গাঁথুনির রড গলিয়ে দেয় এবং ভবনটি ধ্বসে পড়ে। কিন্তু এত উত্তপ্ত তাপমাত্রার মধ্যেও কিভাবে একটি পাসপোর্ট অক্ষত থাকলো?
অবশ্য এই তত্ত্ব প্রদানের পর মার্কিন প্রতিরক্ষা মহল এবং জনগণের মাঝে যে বিদ্রুপ ছড়িয়ে পড়ে তা হলো, সৌদি আরবের ‘পাসপোর্টটি যদি এতই তাপসংকুল হয়, তবে এখন থেকে মার্কিন প্রতিরক্ষা বাহিনীর ইউনিফর্ম ওই পাসপোর্টের চামড়া দিয়েই বানানো উচিত’ !
পেন্টাগনের হামলার ভিডিওচিত্র এবং পেন্টাগনের ক্ষয়প্রাপ্ত ভবনের ছবি বিশ্লেষণ করে বিশেষজ্ঞরা দেখতে পান যে, ১২৪ ফুট প্রশস্ত বিশালকার বোয়িং-৭৫৭ বিমানের আঘাতে ভবনের যে পরিমাণ ক্ষতি হওয়ার কথা ছিল,কিন্তু পেন্টাগনের হয়েছে তারচেয়ে অনেক কম।
যে ভবনে বিমানটি আঘাত করেছে বলে দাবী করা হয়, সে ভবনে সৃষ্টি হওয়া গর্তের মাপ ছিল মাত্র ৬৫ ফুট। ১২৪ ফুট বিমানের আঘাতে ৬৫ ফুট গর্ত সৃষ্ট হওয়া কি বিজ্ঞানসম্মত কোনো দাবী?
টুইন টাওয়ারে ৯/১১ এর হামলা নিয়ে সৃষ্ট ষড়যন্ত্র তত্ত্বগুলোর মধ্যে সম্ভবত এটিই সব চেয়ে জনপ্রিয় এবং বিতর্কিত একটি তত্ত্ব। ইহুদিদের দায়ি করা এই কন্সপেরিসি থিউরীটি আক্ষরিক অর্থেই যে কারো মনে সন্দেহের উদ্রেক ঘটাতে বাধ্য। আপনার বিশ্বাস করতে কষ্ট হলেও এ কথাটি সত্য যে যেদিন হামলা হয়, অর্থাৎ সেপ্টেম্বরের ঠিক ১১ তারিখে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের প্রায় ৪ হাজারের মত ইহুদী কর্মকর্তা কর্মচারি এক যোগে ছুটি নিয়েছিলেন! আরো বিস্ময়ের ব্যাপার হল টুইন টাওয়ারে বিমানের আঘাতের একেবারে প্রথম দিককার ভিডিওগুলোও যে সব লোক জন করেছিলেন তাদের কিছু সংখ্যাক ছিল সংখ্যক ইহুদী !
টুইন টাওয়ারে হামলার পর পরই আল কায়েদা নেতা লাদেন এই হামলার দায় অস্বীকার করেন। এর কিছুদিন পর মার্কিন প্রতিরক্ষা বাহিনীর কর্তৃপক্ষ একটি ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ করে যেখানে দেখা যায় বিন লাদেনকে ঘটনার দায় স্বীকার করতে ।
কিন্তু বিন লাদেনের ভিডিওটি ভালোভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়,যে ব্যক্তিকে হামলার দায় স্বীকার করতে দেখা যায়, সেই ব্যাক্তির সাথে বিন লাদেনের চেহারার কোনো মিল নেই ! আরো মজার ব্যাপার হচ্ছে, কথা বলার সময় লোকটিকে সর্বদা ডান হাত নেড়ে কথা বলতে দেখা যায়। কিন্তু এফবিআই এর ওয়েবসাইটে বিন লাদেনের তথ্য ঘেটে জানা যায় তিনি বাঁহাতি। তাই অনেকেই প্রকাশিত সেই ভিডিও ফুটেজটিকে ভুয়া বলেই দাবি করেন ।
টুইন টাওয়ারে হামলার দুবছর আগে গঠিত হয় আমেরিকার আকাশ প্রতিরক্ষা বিষয়ক সংগঠন “নর্থ আমেরিকান অ্যারোস্পেস ডিফেন্স কমান্ড” বা ‘নোরাড’। আকাশে যেকোনো ধরণে অবাঞ্ছিত বিমানকে গুলি করে ধ্বংস করার অধিকার রয়েছে নোরাডের। ২০০১ সালের মে মাসে নোরাডের ক্ষমতা থেকে জেনারেলদের সরিয়ে তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট ডিক চেনিকে নোরাডের প্রধান করেন প্রেসিডেন্ট বুশ। ৯/১১’র পর জানা যায় নোরাড অনেক আগেই এই হামলার আভাস পেয়েছিলো। তারপরও তারা কেনো আক্রমণ চালানেন না? তাহলে কি ভাইস প্রেসিডেন্ট ডিক চেনি নিজে নোরাডের জেনারেলদেরকে হামলাকারিদের বিরুদ্ধে আগে থেকে ব্যবস্থা গ্রহণ করা থেকে বিরত রেখেছিলেন?
আমেরিকায় দীর্ঘ সময় ধরে চলা অ্যানিমেটেড কমেডি কার্টুন গুলোর একটির নাম হল The Simpsons । ডার্ক কমেডি আর নানা ভবিষ্যত বাণীর জন্য সিম্পসন কার্টুনটি আমেরিকানদের মাঝে বেশ জনপ্রিয়তা পায়।
প্রেট্রনাস টুইন টাওয়ারে হামলার চার বছর আগে সিম্পসন কার্টুনের “The City of New York vs. Homer Simpson” নামক পর্বে এর অন্যতম চরিত্র বার্ট সিম্পসনের হাতে একটি ম্যাগাজিন দেখা যায়, যাতে লেখা ছিলো, “New York 9” শুধু তাই নয় লেখাটির পাশে থাকা দুইটি ভবনকে অনেকটা “11” সংখ্যার মতো দেখাচ্ছিলো।
অনেক কন্সপিরেসি থিওরিস্টের মতে, এই পর্বে ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরে ঘটতে চলা এই মর্মান্তিক হামলার ইঙ্গিত দেয়া হয়। প্রশ্ন হচ্ছে, একটি কার্টুন প্রতিষ্ঠান কিভাবে আন্দাজ করতে পারলো, এমন একটি আক্রমণ ঘটতে চলেছে?
ইমেজ সোর্স — burrosabio.net
৯/১১ এর হামলার আগে মার্কিন যুক্তরাস্টের স্টক মার্কেটে হঠাৎ করেই আমেরিকান এয়ারলাইন্সের বিমানগুলোর শেয়ারের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বেঁড়ে যায়। আরো জেনে আশ্চর্য হবেন, সেই বিমানগুলোর মধ্যে বিধ্বস্ত প্রতিটি বিমানই ছিল! তাহলে কি স্টক মার্কেটের ভেতরের লোকজন আগে থেকে এই হামলার কথা জানতেন, যে আমেরিকান এয়ারলাইন্সের কোনো একটি বিমান দুর্ঘটনা ঘটতে চলেছে?
৯/১১ এর হামলায় বিধ্বস্ত প্রতিটি বিমানের মধ্যে থেকেই এক বা একাধিক ফোন কল আসার কথা সকলেই জানেন। তার মধ্যে ফ্লাইট-৯৩ থেকে একাধিক যাত্রী তাদের পরিবারের কাছে ফোন করেছিলো বলে দাবী করা হয়। কিন্তু এখানেও সন্দেহবাদীদের যত সন্দেহ ! সন্দেহবাদিরা প্রশ্ন তোলেন যে, বিমানটি যে উচ্চতায় ছিল এবং যে গতিতে বিমান চলছিল, তাতে করে বিমানের ভেতর থেকে এই ফোন দেয়া কি আদতেই সম্ভব ছিল?
মানুষের মাঝে কেনো এত ষড়যন্ত্র তত্ত্ব? এর কারণ নিয়ে বিশেষজ্ঞ থেকেই জানা যাক। বিশেষজ্ঞরা বলেন, ষড়যন্ত্র তত্ত্বগুলো ছড়িয়েছে এই জন্য যে, মাত্র কয়েকজন লোক মিলে অতিসাধারণ অস্ত্র দিয়ে এরকম ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ ঘটাতে পারে, তা লোকে বিশ্বাসই করতে পারে না।
কেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কারেন ডগলাস বলেন, “যখন কোন একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে তখন লোকেরা এর একটি সুস্পষ্ট একটি ব্যাখ্যা পেতে চায়, কিন্তু অনেক সময়ই দেখা যায় সরকারি ব্যাখ্যা শুনে লোকজনকে সন্তুষ্ট হতে পারে না। মানুষ জানতে চায়, ঘটনা যে মাপের, ব্যাখ্যাটাও সেই মাপের হতে হবে। সেটা না পেলেই ষড়যন্ত্র তত্ত্বের জন্ম হয়।”
অন্যদিকে অনলাইন জগতে এসব তত্ত্ব ক্রমাগত প্রচার হতে থাকে। তাই এগুলো এত দিন পরও মানুষের মন থেকে মুছে যায়নি।
Leave a Reply