1. sjranabd1@gmail.com : Rana : S Jewel
  2. solaimanjewel@hotmail.com : kalakkhor : kal akkhor
বুদ্ধিগত প্রতিবন্ধকতা: পাগলামি নাকি অসুস্থতা? - কালাক্ষর
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৩:৪৩ পূর্বাহ্ন

বুদ্ধিগত প্রতিবন্ধকতা: পাগলামি নাকি অসুস্থতা?

  • Update Time : সোমবার, ২১ জুন, ২০২১
বুদ্ধিগত প্রতিবন্ধকতা পাগলামি নাকি অসুস্থতা
Image scorch - www.cdc.gov

অপুর্ব ও তিশা দম্পত্তির একমাত্র সন্তান শায়ান (ছদ্মনাম) গত দুই মাস আগে ৬ বছরে পা দিয়েছে। সাধারণত এই বয়সের অন্যান্য শিশুরা হাঁটতে শিখে গেলেও ছোট্ট শায়ান এখনো একা একা হাঁটতে পারে না। অনেক কষ্টে হামাগুড়ি দিয়ে চলতে হয় তার। এছাড়াও নিজের খেলার সাথী ও পরিবারের লোকজনদের চিনতে পারলেও নিজের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ চিনে উঠতে পারছে না সে।

শায়ানের সমস্যা এখানেই শেষ নয়। অর্থবহ এবং সাধারণ মানুষের বোধগম্য ভাষায় কথা বলতেও শায়ানের খুব অসুবিধা হয়। কেবল ক্ষুধা লাগলে মুখ দিয়ে গোঁ গোঁ-গো শব্দ করে, যা শুনে অভিভাবকরা বুঝতে পারেন তার ক্ষুধা লেগেছে। যদিও এতদিন অপুর্ব ও তিশা তাদের আদরের সোনামানিকের এমন আচরণ “ঠিক হয়ে যাবে” এই আশ্বাসবাণীতে উড়িয়ে দিত। কিন্তু সময় গড়াতে গড়াতে শায়ানের ভিতরে যতই বাড়ছে অস্বাভাবিকতার প্রকোপতা। তার সাথে সাথে শায়ানের বাবা-মায়ের কপালেও পড়ছে  দুশ্চিন্তার ভাঁজ।

বুদ্ধিগত প্রতিবন্ধকতা পাগলামি নাকি অসুস্থতা

ইমেজ সোর্স – google.com

তিশার আর অপুর্বের সাথে তাদের পরিবারের সদস্যদের সাথে অনেক বাদানুবাদের পর শায়ান কে পরিচিত এক শিশু বিশেষজ্ঞকে দেখানো হয়। শিশু বিশেষজ্ঞ নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে শায়ানের বাবা-মাকে জানালেন, তাদের সন্তান বুদ্ধিগত প্রতিবন্ধকতা নামক এক বিশেষ সমস্যায় আক্রান্ত এবং ছয় বছরের শায়ানের মস্তিষ্কের বিকাশ হয়েছে  একজন এক বছর বয়সী শিশুর মত, অর্থাৎ শায়ান এক বছর বয়সী শিশুর সমান বুদ্ধির অধিকারী।

বুদ্ধিগত প্রতিবন্ধকতা কী?

প্রতিটি মানুষের জন্মের পর থেকে প্রায় ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত একটি স্বাভাবিক প্রকৃয়ায় মানসিক ও শারীরিক বিকাশ ঘটে। যেমন- দেড় বছর বয়সের মধ্যেই শিশু অল্প কিছু শব্দ বলা শিখে ফেলে। এটি মানুষের একটি সহজাত এবং স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, যা না ঘটলে বুঝতে হবে যে শিশুটির মানসিক বৃদ্ধি বিকাশের ঘাটতি রয়েছে।  এসকল শিশুরা বুদ্ধিগত প্রতিবন্ধকতার শিকার বলে ধরে নেওয়া করা যায়।

বুদ্ধিগত প্রতিবন্ধকতা পাগলামি নাকি অসুস্থতা

news.happyneuronpro.com

অনেকেই মানুষের এই বুদ্ধিগত প্রতিবন্ধকতা বা মেন্টাল রিটার্ডেশনকে  পাগলামি বলে অভিহিত করেন। কিন্তু আপনাদের জেনে রাখা দরকার প্রথাগত পাগল এবং বুদ্ধি প্রতিবন্ধী এর ভিতর বিস্তর পার্থক্য আছে। বুদ্ধিগত প্রতিবন্ধকতা মানুষের এমন একটি মানসিক অবস্থা,যাতে মানুষের সহজাত মানসিক বৃদ্ধির বিকাশ খুব ধীর গতিতে হয়ে থাকে।বিশেষ করে কগনিটিভ অ্যাবিলিটি (পরিস্থিতি অনুযায়ী চিন্তা করার ক্ষমতা), মোটর স্কিল (অঙ্গ সঞ্চালনা),সোশ্যাল স্কিল (মানুষের সাথে যোগাযোগ করার ক্ষমতা) এবং ল্যাঙ্গুয়েজ ফাংশনিং (কথা বুঝতে বা বলতে পারা) সক্ষমতায় অনেক সমস্যা দেখা যায়।

বুদ্ধিগত প্রতিবন্ধকতা রোগে কারণ 

বুদ্ধিগত প্রতিবন্ধকতা কোনো মানসিক রোগ নয়, মূলত মানসিক অক্ষমতা মাত্র। শিশুর বুদ্ধিগত প্রতিবন্ধকতা অনেক কারণে হতে পারে। এর ভিতর সব চেয়ে বড় কারণ গুলো নিয়ে আজ আমরা আলোচনা করবো। 

পরিবেশগত কারণ

বুদ্ধিগত প্রতিবন্ধকতা বা মেন্টাল রিটার্ডেশন রোগ হয় যদি শিশুর খাদ্যে আয়োডিন ও ফলিক অ্যাসিডের অভাব হয়,গর্ভাবস্থায় মায়ের রুবেলা,গর্ভাবস্থায় মায়ের অপুষ্টিতে ভোগার কারণে, গর্ভাবস্থায় মায়ের মাদকাসক্তি, নিকোটিন ও কোকেন সেবন, শিশুর মায়ের সিফিলিস এবং এইচআইভি’র মতো সমস্যা থাকলে।

জিনগত কারণ

বুদ্ধিগত প্রতিবন্ধকতা বা মেন্টাল রিটার্ডেশন হয় মূলত মানুষের ডাউন সিন্ড্রোম, প্রাডোর উইলি সিন্ড্রোম, রুবিস্টেইন টাবি সিন্ড্রোম, ডি ল্যাঞ্জ সিন্ড্রোম বা সিঙ্গেল জিন ডিজঅর্ডার,ফ্র্যাজাইল এক্স সিন্ড্রোমের  মতো জিনগত ব্যাধি থাকলে বুদ্ধিগত প্রতিবন্ধকতা হতে পারে।

জন্মগত কারণ 

বুদ্ধিগত প্রতিবন্ধকতা বা মেন্টাল রিটার্ডেশন রোগ হয় যদি শিশুর প্ল্যাসেন্টাল ডিজফাংশন, মায়ের হৃদপিণ্ড বা কিডনিতে সমস্যার ফলে বুদ্ধিগত প্রতিবন্ধকতা হতে পারে। এছাড়া যেসকল শিশু নির্দিষ্ট সময়ের আগে জন্মগ্রহণ করে, যে সব শিশুর জন্মের সময় ওজন ২ কেজিরও কম থাকে বা জন্মের সময় শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যায় ভোগে তাদের বুদ্ধিগত প্রতিবন্ধকতা হবার সম্ভাবনা থেকে যায়।

রোগের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াজনিত কারণ 

শিশুর বিভিন্ন রোগ, যেমন- শ্বাসকষ্ট, জন্ডিস, হাইপোগ্লাইসেমিয়া, সেপ্টিসেমিয়া, টিবি, মেনিনজাইটিসের মতো রোগ; বিষাক্ত রাসায়নিক ধাতু (যেমন সীসা) এবং ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ফলে বুদ্ধিগত প্রতিবন্ধকতা হতে পারে।

বুদ্ধিগত প্রতিবন্ধকতা রোগের উপসর্গ

বুদ্ধিগত প্রতিবন্ধকতা রোগের কিছু লক্ষন মূলত জন্মের পরই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এবং লক্ষন গুলো ৬-১২ মাস বয়সের মধ্যে উপসর্গগুলো আরও স্পষ্ট হয়ে যায়। আবার অনেক সময় ২ বছর বয়সের আগে কিছু না-ও বোঝা যেতে পারে। অধিকাংশ শিশুরই জন্মগতভাবে এই রোগ হয়ে থাকে। কিন্তু মস্তিষ্কে আঘাতজনিত কারণে অনেকের ক্ষেত্রে উপসর্গগুলো দেরিতে প্রকাশ পেতে পারে। এই রোগের খুব সাধারণ উপসর্গগুলো হলো

  • যদি শিশুটি হাঁটা শিখতে, হামাগুড়ি দিতে বা কথা বলা শিখতে অনেক বেশি সময় নেয়।
  • যদি শিশুটি ৪-৫ বছর বয়সেও নিজে নিজে গোসল করতে, খেতে বা টয়লেটে যেতে না পারে।
  • যদি সময়ের সাথে সাথে শিশুটির মানসিক পরিবর্তন না আসে।
  • যদি শিশুটির ভাষা শিখতে এবং গণনা করতে অসুবিধা হয়।
  • যদি শিশুটির দুর্বল স্মৃতিশক্তি এবং সামাজিক নিয়মকানুন মনে রাখতে অসুবিধা হয়।
  • যদি শিশুটি নিজের যত্ন নেওয়া শিখতেও সময় নেয়।
  • যদি শিশুটি ঠিকমত শুনতে বা দেখতে না পারে।
  • যদি শিশুটির গোটা শরীর জুড়ে, কিংবা বিশেষ কোনো অংশে খিঁচুনি দেখা দ্যায়।
  • যদি শিশুটি সামান্য ঝাঁকুনিতেই ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে বা পড়ে যায়।
বুদ্ধিগত প্রতিবন্ধকতা পাগলামি নাকি অসুস্থতা

ইমেজ – specialolympics.org

বুদ্ধিগত প্রতিবন্ধকতা রোগের জটিলতা 

বুদ্ধিগত প্রতিবন্ধকতার রোগীদের অন্তত ১০% ঠিকমতো শুনতে বা দেখতে পান না। হিয়ারিং এইড, চশমা এবং কারেক্টিভ আই সার্জারির সাহায্যে তা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। এছাড়াও কথা বলতে অসুবিধা, সেরিব্রাল পলসি এবং অটিজমের মতো সমস্যা থাকতে পারে।

বুদ্ধিগত প্রতিবন্ধকতা রোগের চিকিৎসা

শিশুর বুদ্ধিগত প্রতিবন্ধকতা সম্পূর্ণ ভাবে নিরাময় অসম্ভব একটি ব্যাপার। কিন্তু যদি পর্যাপ্ত সাহায্য ও যত্নের ব্যাবস্থা করা যায়, তবে শিশুটি তুলনামূলক সুস্থ জীবনযাপন করতে পারে। মনে রাখবেন, অযত্ন ও অবহেলার ফলেই বুদ্ধিগত প্রতিবন্ধকতার রোগীরা অস্বাভাবিক জীবনযাপন করতে হয়। এক্ষেত্রে অাক্রান্ত শিশুদের স্বাভাবিক জীবনে  ফিরিয়ে অানতে সহায়ক কিছু থেরাপি হলো-

ফিজিক্যাল থেরাপি

  • এর ফলে শিশুটি নিজের শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখতে সক্ষমতা অর্জন করে।
  • শিশুর হাঁটাচলা এবং নড়াচড়ায় অসুবিধা দূর হয়।
  • এতে ইন্দ্রিয়ের সচেতনতা (যেমন: দৃষ্টি, শ্রবণ ও স্পর্শক্ষমতা) বৃদ্ধি পায়।

স্পিচ থেরাপি

  • এতে শিশুর যোগাযোগ দক্ষতার উন্নতি ঘটে।
  • এতে শিশুর ভাষাগত উৎকর্ষতা বৃদ্ধি পায়।
  • এতে শব্দভান্ডার বৃদ্ধি পায়।

অকুপেশনাল থেরাপি

  • এতে শিশুটি নিজে নিজে বিভিন্ন অর্থপূর্ণ কাজ করতে শেখে।
  • এতে শিশুটি নিজের যত্ন নিজে নিতে শেখে।
  • এতে শিশুটি গৃহস্থালীর কাজ (যেমন রান্না করা, কাপড় ধোয়া) করতে সক্ষম হয়।
  • এতে শিশুটি বিনোদনমূলক কাজে উৎসাহী হয়।

বুদ্ধিগত প্রতিবন্ধকতা রোগের হলে করণীয়

শিশুর বুদ্ধিগত প্রতিবন্ধকতা কোনো ব্যাধি নয়, এটি যাস্ট প্রতিবন্ধকতা মাত্র। তাই বুদ্ধি প্রতিবন্ধীদের প্রতি অভিভাবক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং সমাজের কিছু করণীয় রয়েছে,এবং তা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলা অত্যন্ত জরুরী-

  • চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে শিশুটির সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবগত হওয়া।
  • বুদ্ধিগত প্রতিবন্ধকতায় আক্রান্ত অন্যান্য রোগীদের পরিবারের সাথে যোগাযোগ করা।
  • অবৈজ্ঞানিক চিকিৎসা পদ্ধতি পরিহার করে চলা।
  • শিশুকে অযথা বকাঝকা, তাচ্ছিল্য কিংবা বিদ্রূপ না করা।
  • বিশেষ পদ্ধতিতে শিশুকে লালন-পালনের নিয়ম সম্পর্কে প্রশিক্ষণ নেয়া।
  • শিশুর সমস্যাগুলো অনুধাবনের চেষ্টা করা।
  • শিশুকে বেশি আগলে না রাখা।

বুদ্ধিগত প্রতিবন্ধকতা রোগের প্রতিরোধ

বুদ্ধিগত প্রতিবন্ধকতায় আক্রান্ত হবার ঝুকি কমাতে কিছু পরামর্শ মেনে চলা খুব জরুরী। এতে বুদ্ধিগত প্রতিবন্ধকতায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেকাংশে কমানো যায় । 

  • বুদ্ধিগত প্রতিবন্ধকতা রোগ এড়াতে গর্ভাবস্থায় মায়ের যথাযথ পুষ্টিকর (আয়রন ও ক্যালরিযুক্ত) খাদ্য গ্রহণের দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে।
  • নিউরাল টিউব ডিফেক্ট এড়াতে ফলিক অ্যাসিড ও ট্যাবলেট সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে।
  • মা এবং শিশুর খাবারের সঙ্গে আয়োডিন যুক্ত লবণ এবং অ্যান্টি অক্সিডেন্ট গ্রহণ করতে হবে।
  • মায়ের সিফিলিসের মতো যৌনবাহিত রোগের সংক্রমণ এড়াতে নিয়মিত পরীক্ষা এবং যত্ন গ্রহণ করতে হবে।
  • প্রথম গর্ভাবস্থায় অ্যান্টি ডি ইমিউনোগ্লোবিন সম্বন্ধে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
  • ২১ বছর বয়সের আগে বা ৩৫ বছর বয়সের পরে গর্ভবতী হওয়া এড়িয়ে চলতে হবে।
  • গর্ভাবস্থায় মদ, নিকোটিন বা কোকেনের মতো ক্ষতিকর পদার্থ এড়িয়ে চলতে হবে।
  • মায়ের রক্তের গ্রুপ Rh -ve হলে Rh ISO টিকা নেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।

শেষের কথা

শিশুর বুদ্ধিগত প্রতিবন্ধকতা একটি দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা। এই ধরণের রোগীর যত্ন নেওয়াটাও রীতিমতো কঠিন একটি কাজ। তবে আপনাদের মনে রাখা দরকার, বুদ্ধিগত প্রতিবন্ধী শিশুরা লজ্জার কোন কারণ নয়। পর্যাপ্ত সহযোগিতা এবং যত্ন পেলে  বুদ্ধিগত প্রতিবন্ধীরাও সমাজে মাথা উঁচু করে সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে।

This article is in the Bangla language. It discusses Intellectual Disability. Necessary references have been hyperlinked.

তথ্য সুত্রঃ

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

More News Of This Category
©2021 All rights reserved © kalakkhor.com
Customized By BlogTheme
error: Content is protected !!

Discover more from কালাক্ষর

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading