অপুর্ব ও তিশা দম্পত্তির একমাত্র সন্তান শায়ান (ছদ্মনাম) গত দুই মাস আগে ৬ বছরে পা দিয়েছে। সাধারণত এই বয়সের অন্যান্য শিশুরা হাঁটতে শিখে গেলেও ছোট্ট শায়ান এখনো একা একা হাঁটতে পারে না। অনেক কষ্টে হামাগুড়ি দিয়ে চলতে হয় তার। এছাড়াও নিজের খেলার সাথী ও পরিবারের লোকজনদের চিনতে পারলেও নিজের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ চিনে উঠতে পারছে না সে।
শায়ানের সমস্যা এখানেই শেষ নয়। অর্থবহ এবং সাধারণ মানুষের বোধগম্য ভাষায় কথা বলতেও শায়ানের খুব অসুবিধা হয়। কেবল ক্ষুধা লাগলে মুখ দিয়ে গোঁ গোঁ-গো শব্দ করে, যা শুনে অভিভাবকরা বুঝতে পারেন তার ক্ষুধা লেগেছে। যদিও এতদিন অপুর্ব ও তিশা তাদের আদরের সোনামানিকের এমন আচরণ “ঠিক হয়ে যাবে” এই আশ্বাসবাণীতে উড়িয়ে দিত। কিন্তু সময় গড়াতে গড়াতে শায়ানের ভিতরে যতই বাড়ছে অস্বাভাবিকতার প্রকোপতা। তার সাথে সাথে শায়ানের বাবা-মায়ের কপালেও পড়ছে দুশ্চিন্তার ভাঁজ।
ইমেজ সোর্স – google.com
তিশার আর অপুর্বের সাথে তাদের পরিবারের সদস্যদের সাথে অনেক বাদানুবাদের পর শায়ান কে পরিচিত এক শিশু বিশেষজ্ঞকে দেখানো হয়। শিশু বিশেষজ্ঞ নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে শায়ানের বাবা-মাকে জানালেন, তাদের সন্তান বুদ্ধিগত প্রতিবন্ধকতা নামক এক বিশেষ সমস্যায় আক্রান্ত এবং ছয় বছরের শায়ানের মস্তিষ্কের বিকাশ হয়েছে একজন এক বছর বয়সী শিশুর মত, অর্থাৎ শায়ান এক বছর বয়সী শিশুর সমান বুদ্ধির অধিকারী।
প্রতিটি মানুষের জন্মের পর থেকে প্রায় ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত একটি স্বাভাবিক প্রকৃয়ায় মানসিক ও শারীরিক বিকাশ ঘটে। যেমন- দেড় বছর বয়সের মধ্যেই শিশু অল্প কিছু শব্দ বলা শিখে ফেলে। এটি মানুষের একটি সহজাত এবং স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, যা না ঘটলে বুঝতে হবে যে শিশুটির মানসিক বৃদ্ধি বিকাশের ঘাটতি রয়েছে। এসকল শিশুরা বুদ্ধিগত প্রতিবন্ধকতার শিকার বলে ধরে নেওয়া করা যায়।
news.happyneuronpro.com
অনেকেই মানুষের এই বুদ্ধিগত প্রতিবন্ধকতা বা মেন্টাল রিটার্ডেশনকে পাগলামি বলে অভিহিত করেন। কিন্তু আপনাদের জেনে রাখা দরকার প্রথাগত পাগল এবং বুদ্ধি প্রতিবন্ধী এর ভিতর বিস্তর পার্থক্য আছে। বুদ্ধিগত প্রতিবন্ধকতা মানুষের এমন একটি মানসিক অবস্থা,যাতে মানুষের সহজাত মানসিক বৃদ্ধির বিকাশ খুব ধীর গতিতে হয়ে থাকে।বিশেষ করে কগনিটিভ অ্যাবিলিটি (পরিস্থিতি অনুযায়ী চিন্তা করার ক্ষমতা), মোটর স্কিল (অঙ্গ সঞ্চালনা),সোশ্যাল স্কিল (মানুষের সাথে যোগাযোগ করার ক্ষমতা) এবং ল্যাঙ্গুয়েজ ফাংশনিং (কথা বুঝতে বা বলতে পারা) সক্ষমতায় অনেক সমস্যা দেখা যায়।
বুদ্ধিগত প্রতিবন্ধকতা কোনো মানসিক রোগ নয়, মূলত মানসিক অক্ষমতা মাত্র। শিশুর বুদ্ধিগত প্রতিবন্ধকতা অনেক কারণে হতে পারে। এর ভিতর সব চেয়ে বড় কারণ গুলো নিয়ে আজ আমরা আলোচনা করবো।
বুদ্ধিগত প্রতিবন্ধকতা বা মেন্টাল রিটার্ডেশন রোগ হয় যদি শিশুর খাদ্যে আয়োডিন ও ফলিক অ্যাসিডের অভাব হয়,গর্ভাবস্থায় মায়ের রুবেলা,গর্ভাবস্থায় মায়ের অপুষ্টিতে ভোগার কারণে, গর্ভাবস্থায় মায়ের মাদকাসক্তি, নিকোটিন ও কোকেন সেবন, শিশুর মায়ের সিফিলিস এবং এইচআইভি’র মতো সমস্যা থাকলে।
বুদ্ধিগত প্রতিবন্ধকতা বা মেন্টাল রিটার্ডেশন হয় মূলত মানুষের ডাউন সিন্ড্রোম, প্রাডোর উইলি সিন্ড্রোম, রুবিস্টেইন টাবি সিন্ড্রোম, ডি ল্যাঞ্জ সিন্ড্রোম বা সিঙ্গেল জিন ডিজঅর্ডার,ফ্র্যাজাইল এক্স সিন্ড্রোমের মতো জিনগত ব্যাধি থাকলে বুদ্ধিগত প্রতিবন্ধকতা হতে পারে।
বুদ্ধিগত প্রতিবন্ধকতা বা মেন্টাল রিটার্ডেশন রোগ হয় যদি শিশুর প্ল্যাসেন্টাল ডিজফাংশন, মায়ের হৃদপিণ্ড বা কিডনিতে সমস্যার ফলে বুদ্ধিগত প্রতিবন্ধকতা হতে পারে। এছাড়া যেসকল শিশু নির্দিষ্ট সময়ের আগে জন্মগ্রহণ করে, যে সব শিশুর জন্মের সময় ওজন ২ কেজিরও কম থাকে বা জন্মের সময় শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যায় ভোগে তাদের বুদ্ধিগত প্রতিবন্ধকতা হবার সম্ভাবনা থেকে যায়।
শিশুর বিভিন্ন রোগ, যেমন- শ্বাসকষ্ট, জন্ডিস, হাইপোগ্লাইসেমিয়া, সেপ্টিসেমিয়া, টিবি, মেনিনজাইটিসের মতো রোগ; বিষাক্ত রাসায়নিক ধাতু (যেমন সীসা) এবং ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ফলে বুদ্ধিগত প্রতিবন্ধকতা হতে পারে।
বুদ্ধিগত প্রতিবন্ধকতা রোগের কিছু লক্ষন মূলত জন্মের পরই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এবং লক্ষন গুলো ৬-১২ মাস বয়সের মধ্যে উপসর্গগুলো আরও স্পষ্ট হয়ে যায়। আবার অনেক সময় ২ বছর বয়সের আগে কিছু না-ও বোঝা যেতে পারে। অধিকাংশ শিশুরই জন্মগতভাবে এই রোগ হয়ে থাকে। কিন্তু মস্তিষ্কে আঘাতজনিত কারণে অনেকের ক্ষেত্রে উপসর্গগুলো দেরিতে প্রকাশ পেতে পারে। এই রোগের খুব সাধারণ উপসর্গগুলো হলো–
ইমেজ – specialolympics.org
বুদ্ধিগত প্রতিবন্ধকতার রোগীদের অন্তত ১০% ঠিকমতো শুনতে বা দেখতে পান না। হিয়ারিং এইড, চশমা এবং কারেক্টিভ আই সার্জারির সাহায্যে তা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। এছাড়াও কথা বলতে অসুবিধা, সেরিব্রাল পলসি এবং অটিজমের মতো সমস্যা থাকতে পারে।
শিশুর বুদ্ধিগত প্রতিবন্ধকতা সম্পূর্ণ ভাবে নিরাময় অসম্ভব একটি ব্যাপার। কিন্তু যদি পর্যাপ্ত সাহায্য ও যত্নের ব্যাবস্থা করা যায়, তবে শিশুটি তুলনামূলক সুস্থ জীবনযাপন করতে পারে। মনে রাখবেন, অযত্ন ও অবহেলার ফলেই বুদ্ধিগত প্রতিবন্ধকতার রোগীরা অস্বাভাবিক জীবনযাপন করতে হয়। এক্ষেত্রে অাক্রান্ত শিশুদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে অানতে সহায়ক কিছু থেরাপি হলো-
শিশুর বুদ্ধিগত প্রতিবন্ধকতা কোনো ব্যাধি নয়, এটি যাস্ট প্রতিবন্ধকতা মাত্র। তাই বুদ্ধি প্রতিবন্ধীদের প্রতি অভিভাবক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং সমাজের কিছু করণীয় রয়েছে,এবং তা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলা অত্যন্ত জরুরী-
বুদ্ধিগত প্রতিবন্ধকতায় আক্রান্ত হবার ঝুকি কমাতে কিছু পরামর্শ মেনে চলা খুব জরুরী। এতে বুদ্ধিগত প্রতিবন্ধকতায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেকাংশে কমানো যায় ।
শিশুর বুদ্ধিগত প্রতিবন্ধকতা একটি দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা। এই ধরণের রোগীর যত্ন নেওয়াটাও রীতিমতো কঠিন একটি কাজ। তবে আপনাদের মনে রাখা দরকার, বুদ্ধিগত প্রতিবন্ধী শিশুরা লজ্জার কোন কারণ নয়। পর্যাপ্ত সহযোগিতা এবং যত্ন পেলে বুদ্ধিগত প্রতিবন্ধীরাও সমাজে মাথা উঁচু করে সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে।
This article is in the Bangla language. It discusses Intellectual Disability. Necessary references have been hyperlinked.
তথ্য সুত্রঃ
Leave a Reply