1. sjranabd1@gmail.com : Rana : S Jewel
  2. solaimanjewel@hotmail.com : kalakkhor : kal akkhor
পিগম্যালিয়ন ইফেক্ট: প্রাথমিক ধারণা থেকে জন্ম নেওয়া ভবিষ্যৎ নিয়ে মনস্তাত্তিক দন্দের সাইকোলজি - কালাক্ষর
বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০২:২৪ অপরাহ্ন

পিগম্যালিয়ন ইফেক্ট: প্রাথমিক ধারণা থেকে জন্ম নেওয়া ভবিষ্যৎ নিয়ে মনস্তাত্তিক দন্দের সাইকোলজি

  • Update Time : সোমবার, ৭ জুন, ২০২১
পিগম্যালিয়ন ইফেক্ট: প্রাথমিক ধারণা থেকে জন্ম নেওয়া ভবিষ্যতের মনস্তাত্তিক সাইকোলজি
মডেল - তানজিন তিশা। ছবি - কালাক্ষর ডেক্স

আপনার জীবনে এমন কি কখনো হয়েছে? দিনের শুরুতে আপনি যেমনটা ভেবেছিলেন, দিনের শেষে ঠিক তেমনটাই হয়েছে? অথবা প্রথম দেখাতেই আপনার কাছে যে মানুষটিকে ভাল অথবা খারাপ বলে মনে হয়েছিল, তাকে খুব ভালো ভাবে চেনার পর দেখা গেছে সে আসলেই খানিকটা আপনার তাকে দেখে প্রথমে যে উপলব্ধি হয়েছিল সে তেমন প্রকৃতির ই? কিংবা রোজ যে মেয়েটিকে আপনি বাসার ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে স্কুলে যেতে দেখেন, প্রথম দিন থেকেই তাকে খানিকটা অমনোযোগী স্বভাবের বলে মনে হয়েছিল,তার স্কুলের পরিক্ষাগুলোর রেজাল্ট শুনে জানতে পারলেন মেয়েটি সত্যি সত্যিই পরীক্ষায় ডাব্বা মারে?

বারবার আপনার ধারনা প্রসূত ভবিষ্যদ্বাণী ফলে যাওয়ার ফলে আপনার কি কখনো মনে হয়েছে যে, আপনার মধ্যে মানুষ চেনা কিংবা ফলাফল অনুধাবন করার এক অসাধারণ ক্ষমতা রয়েছে? বিষয়টি নিয়ে আপনি মনে মনে কিংবা পরিচিত দের কাছে বুক ফুলিয়ে গর্ব করতে যাবার আগে আজ একটি সত্য জেনে নিয়ে যান তা হল এই ভবিষ্যৎ বানী করার ক্ষমতা শুধু মাত্র আপনার একার নয় প্রায় সব মানুষের ভিতরেই কম বেশি থাকে, তাই যারা নিজেদেরকে শার্লক হোমস কিংবা ব্যোমকেশ বক্সি এর স্তরে নিজের অবস্থান ভাবতে শুরু করে দিয়েছেন, তারা তাদের চিন্তাধারায় খানিকটা জল ঢেলে দিন। সৃজন শীল ব্লগ “কালাক্ষর” এ আজ আমরা আলোচনা করবো, মানুষ যখন মাঝে মধ্যে নিজেদের বা অন্য কারো সম্পর্কে যা অনুধাবন করে, তা কেন বাস্তবে পরিণত হয়? 

পিগম্যালিয়ন ইফেক্ট: ধারণা থেকে জন্ম নেয়া ভবিষ্যৎ

শিক্ষকের ভূমিকায় মডেল হয়েছেন – অর্শা। ছবি – কালাক্ষর ডেক্স

বিষয় টি ভাল ভাবে বোঝাতে একটি ঘটনার কথা বর্ণ্না করা যায়। ধরুন, আপনি একটি বাসায় গিয়ে একই ক্লাসের দুই ভাইকে টিউশন দেন। মনে করুন, প্রথম জনের নাম রাব্বি আর দ্বিতীয়জনের নাম রোকন। টিউশানির প্রথম দিনই আপনার মনে হলো,রাব্বি খুবই চটপটে, পড়াশোনায়ও বেশ ভালো হবে। অন্যদিকে রোকন এর হাল হকিকত আপনার কাছে খুব একটা সুবিধার মনে হলো না। হয়তোবা প্রথম দিন রোকন কে আপনি যে সব প্রশ্ন করেছিলেন সে সেই সব প্রশ্নের কোনো প্রশ্নের উত্তর ঠিক মতো বলতে পারেনি, কিংবা আপনার নির্দেশে তার প্রতিক্রিয়াও তেমন একটা দ্রুত ও তৎপর নয়। সেই থেকেই আপনি ভাবতে আরম্ভ করলেন যে, রোকনের চেয়ে রাব্বি ছাত্র হিসেবে অনেক ভালো। আপনি যদি ঠিক ঠাক রাব্বি কে গাইড করেন তবে রাব্বি পরীক্ষায় আশানুরূপ একটা ভাল ফলাফল করতে সক্ষম হবে। আর রোকনের ব্যাপারে আপনার ধারণা রাব্বিরর ঠিক উলটো। রোকন কে নিয়ে আপনি রাব্বির মত আশাবাদী নন।

সৃজন শীল বাংলা ব্লগ কালাক্ষর এ আমার লেখা পুরাতন লেখা গুলো পড়ার জন্য অনুরোধ রইল 

এর ফলাফল কি হবে জানেন? আপনি নিজের অজান্তেই রোকনের চেয়ে রাব্বির দিকে  বেশি মনোযোগী হয়ে উঠবেন। রাব্বির প্রতি আপনার আকাঙ্ক্ষা অবশ্যই রোকন অপেক্ষা বেশি হবে। এর ফলে রাব্বির সাথে আপনি যে আচরণ করবেন, রোকনের সাথে সে আচরণ করবেন না! 

এর ফলাফলস্বরূপ দেখা যাবে রোকন যদি মেধাবী ছাত্র হয়েও থাকে, আপনার আচরণের প্রভাবে সে ধীরে ধীরে অমনোযোগী হয়ে উঠবে, পড়াশোনায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। আর এতে করে রোকনের পরীক্ষার ফলাফলও বাজে হতে শুরু করবে। অপরদিকে,রাব্বির প্রতি আপনি তুলনামূলক যত্নশীল ও আশাবাদী হওয়ায় তার পড়াশোনারও দিন দিন উন্নতি হতে থাকবে। আপনি যে তার প্রতি সহানুভূতিশীল, সেটা বুঝতে পেরে রাব্বি নিজে থেকে কর্মোদ্যম হয়ে উঠবে। এতে করে দেখা যাবে যে, রাব্বি আপনার প্রত্যাশাস্বরূপ রোকনের চেয়ে সব পরিক্ষায় ভালো রেজাল্ট করতে শুরু করেছে!

সবশেষে আপনি আবিষ্কার করবেন তাদের দুজনের প্রতি আপনার ধারণাই ঠিক ছিল। রোকনের চেয়ে রাব্বি তুলনামূলক ভালো ছাত্র এবং এই ধারণা তাদের প্রতি আপনার পূর্ব ধারণাকে জোরদার করবে। আর আপনিও আপনার দুই ছাত্রের প্রতি আপনার পূর্বের আচরণ বজায় রাখবেন, এবং আপনার এই আচরনের বিষয়টি পর্যায়ক্রমে অনির্দিষ্ট কাল অব্ধি চলতেই থাকবে।

আপনি একবার ভাবুন তো, দুজন ছাত্রের প্রতি আপনার এই দুরকম ধারণা কিভাবে তাদের ভবিষ্যতকে প্রভাবিত করার প্রভাবক হিসেবে কাজ করছে? বিষয়টি এক দুই দিন কিংবা এক দুই মাসের জন্য হলে হয়ত মানা যেত কিন্তু আপনি জেনে অবাক হবেন তাদের ভিতর চলা এই ব্যাপারটি সবসময় অপরিবর্তনীয় থাকবে, তার কারণ আপনি নিজে। কারন আপনার এই দুই ছাত্রের প্রতি আপনার যে দৃষ্টিভঙ্গি তা কখনো বদলাবে না আর তাই তাদের কাজের ফলাফলও কখনো বদলাবে না। দেখা যাবে যে, বিষয়টি একটি চক্রের মধ্যে আটকে গেছে এবং আপনি কিংবা আপনার ছাত্ররা কেউ ই এই চক্র থেকে সহজে বের হতে পারবেন না!

মনোবিজ্ঞানের ভাষায় এই চক্রটিকে বলা হয় ‘পিগম্যালিয়ন ইফেক্ট’ (Pygmalion effect) বা ‘রোজেনথাল ইফেক্ট’। আর যে চক্রটিতে আপনারা আটকে গেছেন তাকে বলা হয় ‘পিগম্যালিয়ন সার্কেল’। এই পিগম্যালিয়ন সার্কেলের মোট ৪ টি ধাপ রয়েছে, যে চারটি ধাপের মধ্যেই চক্রটি ঘুরতে থাকে।

পিগম্যালিয়ন ইফেক্ট: ধারণা থেকে জন্ম নেয়া ভবিষ্যৎ

পিগম্যালিয়ন সার্কেলের ছবি। Image source: everydaymanagement.com

  • ধাপ১: অন্যের সম্পর্কে আপনার ধারণা তার প্রতি আপনার আচরণকে প্রভাবিত করে থাকে।
  • ধাপ২: তার প্রতি আপনার আচরণ তার নিজের প্রতি নিজের ধারণাকে প্রভাবিত করে থাকে ।
  • ধাপ৩: তার নিজের প্রতি নিজের ধারণাই বা  তার কর্ম ও এর ফলাফলকে প্রভাবিত করে থাকে ।
  • ধাপ৪: তার কর্ম ও এর ফলাফল তার প্রতি আপনার ধারণাকে আরও জোরদার করে থাকে।

তাহলে আমরা কি দেখতে পেলাম? কারো সম্বন্ধে আপনার ধারণা ফলে যাওয়ার ব্যাপারটা আপনার কোনো বিশেষ ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ নয়, বরং আপনার নিজের কাজেরই একটি ফলাফল! এ ব্যাপারটি যে শুধুমাত্র অন্য কারো ক্ষেত্রে ঘটতে পারে তা নয়, আপনার নিজের সাথেও কিন্তু এমনটা ঘটতে পারে। আত্মবিশ্বাস যে আমাদের কাজে অনেক বড় প্রভাব ফেলতে পারে, সেটা আমরা সকলেই জানি। কোন বিষয় কিংবা কাজ নিয়ে আপনি যদি আগে থেকেই ভেবে বসে থাকেন, যে আপনি কাজটি করতে পারবেন না, তাহলে দেখবেন যে আপনাকে দিয়ে সত্যি সত্যি কাজটি করা সম্ভবপর হচ্ছে না। এর ফলে আপনার তখন আরো বেশি করে মনে হতে থাকবে যে আপনি কাজটি করার উপযুক্ত নন!

কালাক্ষর ব্লগে আমার লেখা পুরাতন পোস্ট গুলো পড়ার অনুরোধ রইল 

মানুষের অবচেতন মনে প্রভাব বিস্তার করা পিগম্যালিয়ন ইফেক্টের ব্যাপারটি অনেকটাই স্ব-নিয়ন্ত্রিত। কেউ কখনো এই চক্রের মধ্যে ঢুকে গেলেও মোটেই টের পাবে না যে সে নিজে থেকেই কোনো একটা ঘটনার ফলাফলকে নিয়ন্ত্রণ করছে।মানুষের চরিত্রের মধ্যে লুকিয়ে থাকা এই মজার বিষয়টি প্রথম নজরে আসে জার্মান বংশোদ্ভূত আমেরিকান সাইকোলজিস্ট রবার্ট রোজেনথাল -এর।  সাইকোলজিস্ট রবার্ট রোজেনথাল বিষয়টি নিয়ে আরো বেশি খুঁটিয়ে দেখতে হার্ভার্ড বিশ্ব বিদ্যালয়ে একটি গবেষণা করেন। সাইকোলজিস্ট রবার্ট রোজেনথাল  তার গবেষণায়  দুজন স্বেচ্ছাসেবক নিযুক্ত করে তাদেরকে সমান সংখ্যক ইঁদুর দিয়ে সেই ইঁদুর গুলোকে প্রশিক্ষণ দিতে বলেন। ইঁদুর গুলো দেবার সময় সাইকোলজিস্ট রবার্ট রোজেনথাল তার দুই স্বেচ্ছাসেবকের একজনকে বলে দেন যে, তাকে যে ইদুরগুলো দেওয়া হয়েছে সেই ইঁদুরগুলো বেশ চটপটে এবং পরিশ্রমী। আর অন্য স্বেচ্ছাসেবক কে বলে দেন, তাকে যে ইঁদুর দেওয়া হয়েছে সেই ইঁদুরগুলো অলস এবং খুব একটা সক্রিয় নয়। এখানে উল্লেখ করে রাখি, আসল সত্য হল দুইজন স্বেচ্ছাসেবক কে যে ইঁদুর দেওয়া হয়েছিল  সেই ইঁদুর গুলোর ভিতর কোনো তফাৎ ছিল না। কিন্তু তাদের দুজনকে ইঁদুর সম্পর্কে সাইকোলজিস্ট রবার্ট রোজেনথাল দুরকম তথ্য দেয়ায় তাদের দুজনেরই নিজেদের ইঁদুর সম্পর্কে দুরকম মনোভাব তৈরি হয়।  এতে স্বেচ্ছাসেবকের একজন ভাবতে থাকেন তাকে দেওয়া ইঁদুরগুলো সত্যিই অনেক সক্রিয় এবং তুলনামূলক ভালো ফলাফল করবে। আর অপর স্বেচ্ছাসেবক ভাবতে থাকেন প্রথম জনের ঠিক উল্টো,তার কাছে মনে হয় তাকে যে ইঁদুরগুলোকে প্রশিক্ষণ দিতে দেওয়া হয়েছে তাদের প্রশিক্ষণ দিলেও ইঁদুর গুলোর তেমন কোনো উন্নতি হবে না। স্বেচ্ছাসেবক দুই জন বুঝতেই পারেন নি, তাদের এই ভাবনা যে তাদের কাজে প্রভাব ফেলছে, সেটা ঘটছে তাদের অলক্ষেই। স্বেচ্ছাসেবক দ্বয়ের ভাবনা তাদের অবচেতন মনের অন্তরালেই তাদের কাজকে দু-রকমভাবে প্রভাবিত করছে।

সাইকোলজিস্ট রবার্ট রোজেনথাল নির্দিস্ট সময় পর স্বেচ্ছাসেবকদ্বয় কে দেওয়া ইঁদুরগুলোকে পরীক্ষা করে দেখলেন। এর পর  রবার্ট রোজেনথাল লক্ষ্য করলেন যে, তার অনুমানই সঠিক। স্বেচ্ছাসেবক দ্বয়ের ভিতর যাকে ইঁদুর সম্পর্কে ইতিবাচক তথ্য দেয়া হয়েছিল, তার ইঁদুরগুলো খুব ভালো ফলাফল করেছে। আর যার ইঁদুরগুলো সম্পর্কে নেতিবাচক তথ্য দেয়া হয়েছিল, তার ইঁদুরগুলো তুলনামূলক বাজে ফলাফল করেছে।

পরবর্তী কালে ১৯৬৮ সালে রোজেনথাল ক্যালিফোর্নিয়ার একটি স্কুলের শিক্ষার্থীদের মধ্যেও একই ধরনের একটি গবেষণা করলেন। রোজেনথালের করা এই এক্সপেরিমেন্টটিতে তার সহযোগী হিসেবে ছিলেন স্যান ফ্র্যানসিসকোর একটি স্কুলের প্রধান-শিক্ষক লেনোর জ্যাকবসন,একারণেই এই এক্সপেরিমেন্টটিকে ‘রোজেনথাল-জ্যাকবসন এক্সপেরিমেন্ট‘ নামেও ডাকা হয়।

রোজেনথাল-জ্যাকবসন এক্সপেরিমেন্ট‘ এ প্রথমেই স্কুলের সকল শিক্ষার্থীদের IQ (Intelligence Quotient) পরীক্ষা করা হয়। এতে স্কুলের সকল শিক্ষার্থীর IQ’র একটি রেকর্ড পাওয়া যায়। তবে সেই বিষয়টি স্কুলের শিক্ষকদের জানানো হয় না। তাদের কিছু নির্দিষ্ট সংখ্যক শিক্ষার্থীদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয় এবং বলা হয় যে তারা স্কুলের অন্যান্য শিক্ষার্থীদের তুলনায় অনেক মেধাবী। স্কুলের শিক্ষার্থীরা ছিল নতুন, তাই শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কে আগে থেকে কিছু জানতেন না।তারা ধরে নিলেন যে, আসলেই সেই নির্দিষ্ট সংখ্যক শিক্ষার্থীরা অন্যান্য শিক্ষার্থীদের তুলনায় বেশি মেধাবী। স্কুলের শিক্ষা-কার্যক্রম শুরু করা হলো। বছর শেষে আবারো সকল শিক্ষার্থীর IQ পরীক্ষা করা হলো। রোজেনথাল ও জ্যাকবসন যেমনটা ভেবেছিলেন, তেমনটাই হলো। এবার পিগম্যালিয়ন ইফেক্টের প্রভাব লক্ষ্য করা গেলো শিক্ষার্থীদের মধ্যে। বছরের শুরুতে যে শিক্ষার্থীদের সম্পর্কে শিক্ষকদের ইতিবাচক তথ্য দেয়া হয়েছিল, তারা অন্য শিক্ষার্থীদের তুলনায় ভালো ফলাফল করলো, যদিও বছরের শুরুতে তাদের IQ’র ফলাফল তেমন বিশেষ কিছু ছিল না। 

পিগম্যালিয়ন ইফেক্ট: ধারণা থেকে জন্ম নেয়া ভবিষ্যৎ

শিক্ষা ক্ষেত্রে পিগম্যালিয়ন ইফেক্ট; Image courtesy: clasesderefuerzoenvalencia.es

এবার আসি বাস্তব জীবনে পিগম্যালিয়ন ইফেক্ট নিয়ে আলোচনায়। রোজেনথাল ও জ্যাকবসনের গবেষণায় বাস্তব জীবনে পিগম্যালিয়ন ইফেক্ট হিসেবে শিক্ষা-ব্যবস্থার কথাই বারবার উঠে এসেছে। ওপরে যে গবেষণার কথা বলা হয়েছে, সেটিও ছিল শিক্ষাব্যবস্থাকে ঘিরেই। তবে শুধু ক্যালিফোর্নিয়ার ওই স্কুলটির জন্যে নয়, পৃথিবীর যেকোনো স্কুলের জন্যেই ওপরের ব্যাপারটা সত্য। একজন শিক্ষক হয়তো ক্লাসে ঢুকেই তার প্রতিবেশীর ছেলের সাথে কুশল বিনিময় করলেন। কিংবা ক্লাসের ফার্স্টবয়ের সাথে পরিচয় থাকায় তিনি হয়তো তাকেই বারবার পড়া জিজ্ঞেস করলেন। খুব সামান্য মনে হলেও এধরনের ব্যাপারগুলোই একটি ক্লাসে পিগম্যালিয়ন সার্কেল সৃষ্টির পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তবে শিক্ষকরা যে ইচ্ছে করে শিক্ষার্থীদের প্রতি বৈষম্যমূলক ধারণা পোষণ করেন তা নয়। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর অবচেতনেই ব্যাপারটি ঘটে যায়, কেউ টেরই পায় না। ফলাফলস্বরূপ, কিছু শিক্ষার্থী সবসময়ই সবার সুনজরে থাকে এবং কিছু শিক্ষার্থীর ভাগ্যে তা কখনোই জোটে না। 

শিক্ষক, বন্ধুবান্ধব কিংবা মা-বাবার কাছ থেকে কোন ছাত্র যদি এমন আচরণ পায়, যাতে তার মনে হবে যে, সেই ছাত্র টি পড়াশোনা করে জীবনে অনেকদূর যেতে পারবে, তাহলে অবশ্যই সেই ছাত্রটি তার পড়াশোনার আরো বেশি উন্নতি করতে চাইবে। তার প্রতি করা তার আশেপাশের মানুষের এই সব ইতিবাচক আচরণ এবং দৃষ্টি ভঙ্গী থেকেই ছাত্রটির নিজের প্রতি ইতিবাচক ধারণার জন্মায়। যা তাকে সফলতার পথে ধাবিত করতে সাহায্য করে।

আবার যদি কোনো ছাত্রের বাবা-মা কিংবা শিক্ষকরা কোনো কারণে ভাবেন যে, তাদের সেই ছাত্রটিকে দিয়ে তেমন কিছু হবে না; তবে তারা সে ছাত্রটির পেছনে যতই লেগে থাকুক না কেন, ছাত্রটি কোনোদিনই উন্নতির ছোঁয়া পাবে না। আমার কাছে তাই খুব হাস্যকর লাগে যখন আমরা আমাদের দেশের হাজার হাজার শিক্ষার্থীর সফলতার গল্পের পেছনের গল্প বলি, তাদের কেউ ই এই কঠিন সত্যটি উচ্চারণ ই করি না, বা করা হয় না। তাদের সফলতার পেছনে যেমন অবদান আছে ঠিক সেই সফল স্টুডেন্ট দের সফলতার পিছনে তাদের চারপাশের মানুষদেরও অবদান আছে, এর ফলে কি হয় জানেন? আমাদের দেশের হাজার হাজার শিক্ষার্থীর অকালে ঝরে পড়ার দায়ভার ও আমাদের কাঁধে চেপে যায় কিন্তু এমনটা হয়ত হত না যদি  সবার ভিতর পিগম্যালিয়ন ইফেক্ট সম্পর্কে সু স্পস্ট ধারণা থাকতো।

পিগম্যালিয়ন ইফেক্ট প্রয়োগের আরেকটি উৎকৃষ্ট ক্ষেত্র হচ্ছে রাজনীতি এবং নেতৃত্ব। একজন নেতা সবসময়ই ভেবে থাকেন যে, তার অনুসারীদের সম্পর্কে তার সম্পর্কে কার বেশি স্বচ্ছ ধারণা রয়েছে। তাই তিনি তার অনুসারীদের মধ্যে কাউকে নিয়ে খানিকটা সন্দিহান থাকেন আবার কাউকে তিনি তার যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে আগে থেকেই ভেবে রাখেন, বিষয় টি যে তারা সব সময় চিন্তা ভাবনা করেই ঠিক করে রাখেন তা নয় মাঝে মাঝে অনেক নেতা নিজের মনের অজান্তেই ঠিক করে রাখেন। আর এর প্রভাব পড়ে সেই নেতার অনুসারীদের কর্ম ও তার ফলাফলের উপর।

এছাড়াও আমাদের চারপাশে পিগম্যালিয়ন ইফেক্টের আরও অনেক উদাহরণ রয়েছে। ব্যক্তিগত পছন্দ, কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা, চারিত্রিক অন্তর্মুখিতা, মানসিক বয়স- এরকম নানান বিষয়ের পেছনে পিগম্যালিয়ন ইফেক্ট কলকাঠি নাড়ছে। আমরা চাইলেই যে সবসময় পিগম্যালিয়ন ইফেক্ট এড়িয়ে যেতে পারি তা নয়, তবে পিগম্যালিয়ন ইফেক্টের কথাটি মাথায় রাখলে বা অন্যের আচরণিক বহিঃপ্রকাশ দ্বারা ধারণা পোষণ বা প্রভাবিত হওয়া থেকে বিরত থাকতে পারলে বিষয়টি অনেকটাই আমাদের নিয়ন্ত্রণে এসে যাবে।

‘পিগম্যালিয়ন ইফেক্ট’ নিয়ে এত আলোচনার করলাম সর্বশেষে যদি ‘পিগম্যালিয়ন ইফেক্ট’ এর নামের সার্থকতা নিয়ে কিছু বলি তবে কিছুটা অপুর্নতাই থেকে যাবে আজকের আলোচনায়। প্রখ্যাত রোমান কবি ‘ওভিদ‘ এর ‘মেটামরফোসিস‘ গ্রন্থ থেকে একটি রোমান পৌরাণিক উপাখ্যান পাওয়া যায়। বিখ্যাত রোমান মিথ এ, সাইপ্রাস নামক একটি দ্বীপে  এক যুবক ভাস্কর ‘পিগম্যালিয়ন‘ বসবাসের কথা উল্লেখ আছে।  পিগম্যালিয়ন‘ এর মনে নারীদের প্রতি তার ছিল প্রবল বিতৃষ্ণা। এই বিতৃষ্ণার মূল কারণ ছিল সাইপ্রাস দ্বীপেরই ‘প্রোপিওটিডাস‘ নামে পরিচিত কিছু রমণী ছিল, যারা ভালোবাসার দেবী ‘ভেনাস‘কে (গ্রীক মিথলজি অনুসারে ‘আফ্রোদিতি’) অমান্য করার স্বভাব। আর এই কারণে নারীদের প্রতি  পিগম্যালিয়ন‘ এর মনে যে বিদ্বেষ জন্মে সেই কারণে যুবক পিগম্যালিয়ন কখনো বিয়ে থা করেননি। যাই হোক যুবক পিগম্যালিয়ন‘ একদিন মনস্থির করলেন,তিনি একটি নারীমূর্তি তৈরী করবেন। পিগম্যালিয়ন‘ সে অনুসারে কাজ শুরুও করলেন, তবে মূর্তিটি তৈরী করার সময় থেকেই এক অভাবনীয় জিনিস ঘটতে লাগলো। নারী-বিদ্বেষী পিগম্যালিয়ন নিজের তৈরী মূর্তিটির প্রতি দিন দিন আকৃষ্ট হয়ে পড়তে লাগলেন। এবং মূর্তি বানানোর কাজ সম্পূর্ণরূপে শেষ হওয়ার সময়ের মধ্যেই যুবক পিগম্যালিয়ন‘ গভীরভাবে প্রেমে পড়ে গেলেন তার নিজের হাতে গড়া সেই অসাধারণ সুন্দর নারীমূর্তিটির।

Pygmalion effect

ছবি – পায়েল। ইমেজ সোর্স – ফেসবুক

তবে বিধি বাম! পিগম্যালিয়ন‘ যার প্রেমে পরলেন সেটা তো পাথরের মূর্তি, মানুষ নয়, তাই মুর্তির সামনে দাঁড়িয়ে পিগম্যালিয়ন‘ যখন তার ভালবাসার কথা বলেছিল তখন মুর্তি এর কাছ থেকে নিজের ভালোবাসার যথাযথ প্রতিক্রিয়া না পেয়ে চরম হতাশার মধ্যে দিন কাটাতে লাগলেন পিগম্যালিয়ন। পিগম্যালিয়নের মনে ধারণা জন্মেছিল, মূর্তি হোক, তাতে কী হয়েছে? একদিন ঠিকই সে তার ভালোবাসার প্রতিক্রিয়া ঠিক ই জানাবে। আমরা মাঝে মাঝে ভালবেসে পাথরে ফোটাবো ফুল বলে মেয়েদের পটাতে চাই বিষয় টা তার চেয়েও জটিল ছিল। কারন পিগম্যালিয়ন‘ সমস্ত ধ্যান জ্ঞ্যান তখন সেই মুর্তি কেন্দিক হয়ে গিয়েছিল।

যখন কোন কিছুতেই কিছু হচ্ছে না তখন পিগম্যালিয়ন দেবী ভেনাসে কাছে প্রার্থনা জানালেন মূর্তিটিকে জীবন্ত করে দেয়ার। দেবী ভেনাস পিগম্যালিয়ন‘ এর সেই কথা রাখলেন। পিগম্যালিয়নের বানানো জড়-মূর্তি ভেনাসের কথায় পরিণত হলো এক সুন্দরী রমণীতে, পিগম্যালিয়ন পরে যার নাম রেখেছিলেন ‘গ্যালাতিয়া’। গল্পটি আমাদের এই শিক্ষা দেয় যে, পিগম্যালিয়নের জোর ধারণা অলীক হওয়া সত্ত্বেও বাস্তবে পরিণত হয়েছিল।তবে মানুষের কোনো দৃঢ় ধারণা কি অলীক হওয়া সত্ত্বেও সত্যি সত্যি ঘটে যেতে পারে? সে এক রহস্য বটে !

It’s a Bengali article on The Pygmalion effect, which is also known as the Rosenthal effect. This effort explains that people tend to perform up to the level that others expect of them.

 

Please Share This Post in Your Social Media

Leave a Reply

More News Of This Category
©2021 All rights reserved © kalakkhor.com
Customized By BlogTheme
error: Content is protected !!

Discover more from কালাক্ষর

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading