আমি বাস্তব জীবনে খুব একাকীত্বে ভোগা একজন মানুষ। মিডিয়াতে কাজ করতে গিয়ে বলার মত উপার্জন করতে পারিনি তাই বলতে খারাপ লাগলেও বাস্তব সত্য হল, জন্মদাতা বাবা ও আমায় আর ছেলে হিসেবে পরিচয় দিতে চান না। মায়ের আদর ফিকে হয়ে গেছে বহুকাল আগেই। ভাই বোন যার যার জীবন নিয়ে ব্যাস্ত। আর বউ পালতে পারবো না বলে বিয়ে টাও করিনি। শেষ মেষ চোল্লিশের কোটায় প্রবেশ করে ব্যার্থ জীবনের একাকিত্বের ভার বয়ে চলছি। আর তাই মাঝে মাঝেই আমার ফেসবুকের স্ট্যাস্টাস দেই “ যে আগুনে আমি পুড়ি। তাঁর নাম নিঃসঙ্গতা”। আমি না হয় একা থাকি তাই নিঃসঙ্গবোধ থেকে বাস্তবিক অর্থেই একা লাগে বলে এই জাতীয় কথা বলি, কিন্তু আমাদের চার পাশে অনেক লোক কে আমি চিনি যাদের ফ্যামিলী আছে। বাবা মা হাজবেন্ড, বউ বাচ্চা সবই আছে কিন্তু তাঁর পরেও তারা নিজেরা নিঃসঙ্গ বোধ করে। জীবন নিয়ে তাদের হতাশাবোধ দেখে আর আমার নিজের জীবনের অভিজ্ঞতার যোগফল মিশিয়ে আজ মানুষের নিঃসঙ্গতাবোধ ও বিচ্ছিন্নতাবোধ নিয়ে সৃজনশীল ব্লগ “কালাক্ষর” এ আজকের লেখাটি লিখতে বসলাম। আজ আমরা পৃথিবীর বিখ্যাত দার্শনিকরা মানুষের নিঃসঙ্গতাবোধ নিয়ে যে সব ব্যাখ্যা দিয়েছেন তা নিয়ে বিষদ আলোচনা করবো।
নিঃসঙ্গতা
বাস্তব জীবনে আমাদের চারপাশের প্রচুর লোক জন কে বলতে শুনি, ‘ভালো লাগছে না’, ‘একা একা লাগছে’ এই ধরনের কথা বলতে। আমরা যে কেবল শুনি সেটা কিন্তু না, আমরা নিজেরাও হরহামেশাই এই ধরনের কথা বলে থাকি। এমন অনেক সময় আমরা পার করি যে সময়টায় আমাদের কিছুই ভালো লাগে না, আবার ভালো না লাগার কারণটাও আমরা জানি না। এমন না যে কেবল একা থাকার সময়েই আমাদের মাঝে একাকিত্ব ভর করে, বরং চারপাশে জনারণ্যের মাঝেও আমরা একাকিত্বে আক্রান্ত হই। এই ‘একা একা লাগছে’ এরকম চিন্তার গোড়ার জায়গাটা হচ্ছে নিঃসঙ্গতাবোধ (Loneliness)। নিঃসঙ্গতাবোধের সৃষ্টি হয় বিচ্ছিন্নতাবোধ (Alienation) থেকে। প্রচণ্ড নিঃসঙ্গতাবোধ একজন মানুষকে মারাত্মক ডিপ্রেশনে নিয়ে যেতে পারে। এই ডিপ্রেশনকে আমরা কেবল বিষণ্ণতা বলে চালিয়ে দিতে পারি না। এটি সাধারণ বিষণ্ণতার চেয়েও অনেক বেশি যন্ত্রণাদায়ক।
মানুষের মনে বিচ্ছিন্নতাকে পুঁজিবাদী সমাজ ব্যাবস্থা একটি সামাজিক-মনস্তাত্বিক সমস্যা হিসেবে দেখে। সমাজবিজ্ঞানের ভাষায় বিচ্ছিন্নতার সংজ্ঞা হিসেবে বলা হয় –
“Alienation is a social-psychological condition of the individual which involves his estrangement from certain aspects of his social existence.”
(সমাজবিজ্ঞানের ভাষায় বিচ্ছিন্নতাবোধকে সামাজিক-মনস্তাত্বিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করার ব্যাপারটি কার্ল মার্কস এর মাধ্যমে প্রভাবিত হয়েছে।) তবে আধুনিক সমাজে মানুষের মনে জেকে বসা বিচ্ছিন্নতা বোধ নিয়ে সর্বপ্রথম আলোচনা করেন জ্যাঁ জ্যাক রুশো। পরবর্তীতে দার্শনিকরা এই আলোচনাকে আরো প্রসারিত এবং গঠনমূলক করে তোলেন যার প্রবাহ এখনো ধারাবাহিক ভাবে চলছে ।
সামিরা খান মাহি। ছবি – ফেসবুক
আধুনিক সমাজ ব্যাবস্থায় মানুষের মনের বিচ্ছিন্নতাবোধ নিয়ে দার্শনিকরা যে মত দেন তা নিচে বর্নিত চার ভাগে ভাগ করা যায় ।
দার্শনিক হেগেল মতে, মানুষ সৃষ্টিকর্তারই একটি বিচ্ছিন্ন অংশ এবং এই বিচ্ছিন্ন অংশ হিসেবে মানুষের মনে যে বিচ্ছিন্নতাবোধ কাজ করে সেটিই মানুষের মনে নিঃসঙ্গতাবোধ জাগার মূল কারণ। অন্যদিকে ফয়েরবাখ এর মতে, মানুষের নিজের সত্ত্বা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যে ঈশ্বরচিন্তা বা ধর্মচিন্তা করে, সেটিই মানুষের মনে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টির আসল কারণ। অর্থাৎ ফয়েরবাখ ধারণা থেকে এইটা প্রতিয়নমান হয় যে, মানুষ যখন নিজের সত্ত্বা থেকে বের হয়ে নিজের সাথে সম্পর্কহীন অলৌকিক সত্ত্বাকে নিয়ে ভাবে, তখন তাঁর মনে যে শুন্যতার সৃষ্টি হয় তার কারনেই মানুষের মনে বিচ্ছিন্নতাবোধের জন্ম হয়। অন্য দিকে দার্শনিক হেগেলের বর্ননা অনুযায়ী ধরা যায়, মানুষ সৃষ্টিকর্তা থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার মাধ্যমে মানব সভ্যতার একেবারে প্রথম থেকেই মানুষের মনে বিচ্ছিন্নতাবোধের জন্ম নিয়েছিল। সেই বিচ্ছিন্নতার ফলেই মানব মনে নিঃসঙ্গতাবোধ জন্মে আছে আজ অব্ধী। এই দুটি মত সম্পূর্ণ বিপ্রতীপ।
মনোবিজ্ঞানী সোরেন কিয়ের্কেগার্ড, এডমণ্ড হুসের্লে, মার্টিন হাইডেগার, জ্যাঁ পল সার্ত্রের মতো অস্তিত্ববাদী দার্শনিকরা সব সময় বলতে চেয়েছেন আমাদের এই ভোগবাদী সমাজ ব্যবস্থায় মানুষ নানা ক্ষেত্রে নিজের অস্তিত্বের সংকট অনুভব করে থাকে। আর সেই সংকটই মানব মনে বিচ্ছিন্নতাবোধের জাগাবার মূল কারণ। আধুনিক এই যন্ত্রসভ্যতার যুগে আমাদের সমাজব্যাবস্থা এবং আমাদের আশেপাশের বৈরী পরিবেশের চাপে পড়ে আমাদেরকে বেশিরভাগ সময় আমাদের স্বভাববিরুদ্ধ বা ইচ্ছাবিরুদ্ধ অনেক ধরণের কাজ করতে হয়, যে খানে না থাকে নিজের ভাল লাগা না থাকে নিজের ইচ্ছের বহিপ্রকাশ ঠিক যন্ত্রের মত তখন আমাদের কাজ করে যেতে হয়, আর এর ফলে আমাদের মনে এক ধরণের অস্তিত্বের সংকট তৈরি হয়। এই সংকট গুলো আমাদের মনে জমা হতে হতে আমাদের তথা মানুষের মনে বিচ্ছিন্নতাবোধের জন্ম দেয়।
দার্শনিক কার্ল মার্ক্সের বিশ্লেষণ থেকে আমরা জানতে পারি যে, শ্রমের ফসল থেকে বিচ্ছিন্নতাই ক্রমে মানুষকে অপর মানুষ থেকে এবং তার আপন সত্ত্বা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। পুঁজিবাদী সমাজে শ্রমিকের শ্রমের ফলে উৎপন্ন ফসল শ্রমিকের কাছে থাকে না, সে ফসল চলে যায় মালিকের দখলে। এভাবে শ্রমের ফসল থেকে বিচ্ছিন্নতা মানুষের মনে বিচ্ছিন্নতাবোধের জন্ম দেয়। মানুষের কোনো উৎপাদন বা সৃষ্টিই তার কাছে থাকে না, অন্য কারো মুনাফা লাভে তা ব্যবহৃত হয়। এর বাইরেও সমাজের সাথে ব্যক্তির যে দ্বন্দ্ব এবং এ থেকে ব্যক্তিমনে যে বিচ্ছিন্নতাবোধের উদ্ভব হয় সেটিও যে বিচ্ছিন্নতার একটি কারণ মার্কস তার সূত্রে তা উল্লেখ করেছেন।
নিঃসঙ্গতা
বিখ্যাত দার্ষনিক সিগমুণ্ড ফ্রয়েড মানব মনে নিঃসঙ্গতার সৃষ্টি কি ভাবে হয় তা নিয়ে বলতে গিয়ে বলেছিলেন, সমাজ ও রাষ্ট্রের চাপের মুখে মানুষের লিবিডোর যে অবদমন সেটিই বিচ্ছিন্নতাবোধের মূল কারণ– যদিও পরবর্তীতে ফ্রয়েডের এই তত্ত্ব সমাজ-মনস্তত্ত্ববিদরা গ্রহণ করেননি। অন্যদিকে এরিক ফ্রম মনে করতেন, পুঁজিবাদের সংকটই হচ্ছে মানবজাতির প্রধান সংকট, যার অনিবার্য ফলাফল মানবমনে বিচ্ছিন্নতাবোধ। মার্কসের সাথে সংকটের ব্যাপারে একমত হলেও সমাধানের ক্ষেত্রে একমত হতে পারেননি এরিক ফ্রম । তিনি মনে করেন, সমাজে নয়, মানুষের মনের গভীরেই রয়েছে বিচ্ছিন্নতার সমাধান। আর. ডি. ল্যাঙ এর বিচ্ছিন্নতার তত্ত্ব এরিক ফ্রমের মতোই। তিনিও মনে করেন, বিচ্ছিন্নতা মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা হলেও এর বীজ রোপিত রয়েছে সমাজের অভ্যন্তরে।
মানুষের কোন রোগ হলে তার কিছু লক্ষণ দেখে আমরা বুঝতে পারি রোগীটি কোন রোগে আক্রান্ত হয়েছে। সমাজ-মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা হিসেবে বিচ্ছিন্নতার কিছু লক্ষণ রয়েছে। মেলভিন সিম্যান তার ‘অন দ্য মিনিং অব এলিয়েনেশন’ বইয়ে বিচ্ছিন্নতার পাঁচটি প্রধান লক্ষণ দেখিয়েছেন–
১) কর্তৃত্বহীনতা (Powerlessness);
২) অর্থহীনতা (Meaninglessness);
৩) আদর্শহীনতা (Normlessness);
৪) সম্পর্কহীনতা (Isolation);
৫) আত্ম-সংযোগহীনতা (Estrangement);
সিম্যানের মতে, বিচ্ছিন্নতার মূল অর্থই হলো ‘to become a stranger to oneself’.
নিঃসঙ্গতা
মানুষ প্রকৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। শিল্প-বিপ্লবের পরের সময়ে, নগর–মহানগর প্রতিষ্ঠার পর থেকে মানুষ প্রকৃতির সাথে তার যে বন্ধন সেটি হারাতে শুরু করে। প্রাণ-প্রকৃতি যেখানে মানুষকে প্রশান্তি দেয়, সেখানে যন্ত্রসভ্যতায় মানুষ এক অনিবার্য মানসিক অশান্তিতে ভুগতে থাকে। প্রকৃতির সান্নিধ্য থেকে বিচ্ছিন্ন মানুষ হয়ে পড়ে নিঃসঙ্গ।
প্রেম আর ভালোবাসার উৎস হারিয়ে মানুষের মর্মলোক হতে থাকে আরো বিচ্ছিন্ন, আরো নিঃসঙ্গ।
৩। পরিবার ও পারিবারিক-বন্ধন বিচ্ছিন্নতাজাত নিঃসঙ্গতা :
পুঁজিবাদী সমাজে মানুষ কেবলই দৌড়াচ্ছে। একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে যাচ্ছে। একক পরিবারেও কেউ কাউকে সময় দিতে পারেন না। পরিবারের প্রত্যেক সদস্য একইসাথে বাস করছেন, তবুও কারো জন্য কারো সময় নেই। পরিবারের মাঝে থেকেও মানুষ নিজেকে বিচ্ছিন্ন এবং নিঃসঙ্গ হিসেবে আবিষ্কার করে।
দার্শনিকদের আলাপে মানুষের সমাজ-বিচ্ছিন্নতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হিসেবে ঠাঁই পেয়েছে। মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। কিন্তু এই জটিল এবং কুটিল সময়ে মানুষ সমাজের মাঝে থেকেও সমাজের অংশ নয়। এই সমাজের যেন মানুষকে দেবার কিছু নেই, আবার ব্যক্তি মানুষেরও এই সমাজকে দেবার কিছু নেই। এই সমাজ-বিচ্ছিন্নতা মানুষকে করে তুলেছে অনেক বেশি নিঃসঙ্গ।
ধর্মের উৎপত্তির পর থেকে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম আসার আগপর্যন্ত ধর্মের সাথে মানুষের একটা গভীর সম্পর্ক ছিল। কালক্রমে মানুষের ঈশ্বরচিন্তায় বিবর্তন আসতে শুরু করে। ধর্ম ও ঈশ্বর সম্পর্কিত অবিশ্বাসকে নিঃসঙ্গতাবোধের একটি কারণ হিসেবে মনে করেন অনেকে।
উপর্যুক্ত নিঃসঙ্গতার ধরনগুলোর সাথে মুখোমুখি হতে হতে মানুষ নিজেকে আরো বেশি গুটিয়ে নেয় তার চারপাশের পরিবেশ থেকে। একসময় সে তার ব্যক্তিসত্ত্বাকে আর খুঁজে পায় না। জ্যাঁ পল সাঁর্ত্রের মতে, একসময় মানুষের নিজের সত্তাই বিরোধিতা করে বসে। এই সত্তা বিচ্ছিন্নতাজাত নিঃসঙ্গতা সবচেয়ে বেশি যন্ত্রণাদায়ক নিঃসঙ্গতা।
সমাজবদ্ধ জীবনের প্রয়োজনে সমাজ ব্যক্তিমানুষের সমাজের প্রতি এবং সমাজের ব্যক্তিমানুষের প্রতি করণীয় কিছু আচার-আচরণের বিধান তৈরী করে। এই যন্ত্রসভ্যতায় শিকড়হীন মানুষ সেসব মূল্যবোধ হারিয়ে নিঃসঙ্গ হয়ে উঠেছে।
Zahara Mitu, ছবি- ফেসবুক
পৃথিবীতে মানুষ সমাজবদ্ধ ভাবে বসবাস করে, একা মায়ের পেট থেকে জন্মাবার পর তাঁর জীবন চক্রের একটা সময়ে এসে মানুষ পরিবার প্রথায় প্রবেশ করে,তবে মানুষের ইতিহাস যদি ঘাটতে যান তবে দেখতে পারবেন একজন ব্যক্তিমানুষের সাথে ব্যক্তিমানুষের সম্পর্কের দৃঢ় বন্ধন ছিল বহু যুগ ধরে, বহু সহস্র বছর ধরে। কারো কারো মতে, মানব ইতিহাসের জন্ম থেকেই মানুষ বিচ্ছিন্ন এবং একা। কারো কারো মতে, শিল্পবিপ্লবোত্তর কালে এসে মানুষের এই বিচ্ছিন্নতাবোধের জন্ম। কিন্তু যে মতবাদই থাকুক, মানুষ জন্ম থেকে বিচ্ছিন্ন হোক বা না হোক, এটা সত্যি যে শিল্পবিপ্লবের পরের সময়ে এসে মানুষের বিচ্ছিন্নতা প্রবল থেকে প্রবলতর হচ্ছে। মানুষ আরো বেশি নিঃসঙ্গতাবোধে আক্রান্ত।
মানুষের জীবনের প্রতি এই গভীর উদাসীনতা কেবলই নিঃসঙ্গতাপ্রসূত হয়ে থাকে। জনপ্রিয় মার্কিন ব্যাণ্ড লিনকিন পার্ক যখন বলে ‘Waiting for the end’ তখন এই সময়ের, এই যুগের, এই বাস্তবতায় মানবমনের করুণ আর্তিই ধ্বনিত হয়। অবচেতনে জীবনের প্রতি এই বিরাগ যেন সংক্রামক ব্যাধির মতো ছড়িয়ে পড়ছে সবখানে।
যদিও মানুষের মনে জেকে বসা এই নিঃসঙ্গতাবোধ থেকে মুক্তি পাবার সর্বজনস্বীকৃত পথ এখনো কেউ ভাল ভাবে বের করতে পারেন নি। তবুও ব্যাক্তিগত ভাবে আমি চাই নিঃসঙ্গতা নামক সংক্রমিত ব্যাধির বিপক্ষে মানুষের লড়াইটা চলুক। আর এ লড়াইটা একা একজন ব্যক্তিমানুষের না হয়ে লড়াইটা যেন সবার হয়। ভাল থাকবেন সবাই। ধন্যবাদ
This article is about the philosophy of loneliness, alienation & estrangement.
References :
Leave a Reply