একটা কথা আমি মাঝে মাঝেই বলি, ঢাকা শহরের ৮৭% ফ্যামিলিয়ার আন হ্যাপী। মানে ১০০ টি ফ্যামিলীর মধ্যে ৮৭ টি ফ্যামিলির হাজবেন্ড আর ওয়াইফ এর ভিতর মানসিক ভাবে কোন সম্পর্ক নেই। মানষিক সম্পর্ক যে হুতু নেই তাই ভালবাসা ও নেই। যা আছে তা হল যাস্ট কাগজ কলমে পতি পন্তি হবার সিকৃতি। এরা এক ছাদের তলায় বছরের পর বছর কাটায়। এক বেড এ ঘুমায়। কিন্তু এদের চিন্তা চেতনার জগত ভিন্ন। মনের টান নেই। ভালবাসা নেই। তার পরেও কেন এরা এক সাথে থাকে? বাচ্চা উৎপাদন করে। মাঝে মাঝে দুই জনের ভালবাসার ছবি দ্যায়। ভাল বাসা নেই তার পরেও নিজেকে ঠকিয়ে কেন এরা হাজবেন্ড ওয়াইফের সংসার সংসার নাটক করে? এর অনেক গুলো কারণ আছে, মেয়েদের অর্থ নৈতিক আনস্ট্যাবিলিটি, বাচ্চাদের ভবিষ্যৎ, সমাজিক অবস্থান, পরিবারের মান সম্মান অনেক কিছুই এর জন্য দায়ী, কিন্তু একটা কথা যে টা সব চেয়ে গুরুত্ব পুর্ন বলে আমার কাছে মনে হয় সেই কারণ টার কথা আমরা বলি না,আর তা হল পরবর্তি জীবনে একা থাকার ভয়।
আপনাকে আমার নিজের দেখা একটা বাস্তব উদাহরণ দেই, আমার সব চেয়ে কাছের মানুষ হল সবুজ ভাই আর রুবি ভাবি ( আসল নাম টি দিলাম না, কেন দিলাম না তার কারণ আমার মাইর খাওয়ার ইচ্ছা নাই)। সবুজ আর রুবি ভালবেসে ছাত্র অবস্থাতেই বিয়ে করেছিল। দুই জনের ফ্যামিলীর অবস্থা খুব ভাল। তাই জীবনে কেউ ই দারিদ্রতা দেখেনি। তাদের দুইটি ছেলে। তাদের দেখলে যে কেউ ই হ্যাপী ফ্যামিলি বলবেন। ভাল আছে বলবেন কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। সবুজ ভাই এর ভিতর বহুগামিতা আছে। বয়স ৪৮ প্লাস প্রায় তার পরেও মেয়েদের সাথে ফ্লাটিং করে বেরায়। কখনো পরকিয়া কখনো টাকার বিনিময়ে বারবনিতা। মোট কথা এক নাম্বারের লুচু এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হল সবুজ। বিয়ের অনেক দিন সবুজের এই স্বভাব টি রুবির কাছে গোপন ছিল। কিন্তু কথায় আছে পাপ কখনো চাপা থাকে না সেই সুবাদেই রুবির কাছে সবুজের এই বহুগামীতা ও এক দিন ধরা খেয়ে যায়। তার পর কি হল? কিছু দিন ঝগড়া ঝাটি। চিল্লা ফাল্লা । রাগ করে বাবার বাড়ি যাওয়া । তার পর সবুজের হাত পায়ে ধরে আবার রুবি কে নিয়ে আসা । তার পর আবার সরুপে ফেরা মানে চুল্লা গিড়ি করা। আর এই সব দেখতে দেখতে এক দিন রুবি রণে ভঙ্গ দিয়ে যাস্ট চেপে গেছে। এখন আর এই নিয়ে রুবি কিছুই বলে না। ধর্ম কর্ম আর বাচ্চাদের নিয়েই তার সময় কাটে। এখনো সবুজের সাথেই থাকে। তারা এক খাটেই ঘুমায়। কিন্তু হাজবেন্ড ওয়াইফের ভিতর সেই টান আর নাই যা তাদের থাকা উচিৎ ছিল। তারা এক সাথে পারিবারিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানিক অনুষ্ঠানে যায়। মানুষ জানে তারা দুই জন খুব ভাল আছে। তাদের সফল লাইফ। কিন্তু আদতে তারা সুখে থাকার অভিনয় করে। সংসার সংসার নাটক করে তারা দিব্বি আছে। হয়ত বলবেন রুবি তো অর্থনৈতিক ভাবে স্ট্যাবল একটা মেয়ে, সে চাইলেই তার বাবার দেওয়া বাড়িতে গিয়ে থাকতে পারতো। আর সেই পাচ তলা বাড়ির ভাড়া বাবদ প্লাস ব্যাংকে তার নামে যে টাকা আছে তা দিয়ে নিজের দুই বাচ্চা সহ চাইলে আরো ২০ জন ছেলে মেয়ে কে পালতে তার বিন্দু মাত্র অসুবিধা হত না, তার পরেও কেন রুবি এই নাটুকে লাইফ বেছে নিয়ে চুপ চাপ সবুজের সাথে থেকে গেল? এর কারণ হল ভয়। খাটি বাংলায় যাকে বলে শেষ বয়সে একা থাকার ভয় ।
আপনাকে আরো এক জনের ঘটনা বলি আমার এক কাজিনের নাম সাব্বির। সাব্বির বাবা-মায়ের সব চেয়ে ছোট ছেলে । বয়স একুশের কাছাকাছি। পড়াশোনায় খুব ভালো আর ভার্সিটির সিক্স সেমিস্টারে পড়ে। কিন্তু সাব্বির এখনও তার মাকে ছাড়া কোথাও চলাফেরা করতে পারে না। সাব্বির মায়ের পাশে ঘুমায়, সকালে সাব্বির কে তার মায়ের ভার্সিটিতে রেখে আসতে হয়, ফেরার পথে সাব্বির কে মাকেই নিয়ে আসে হয়, খাবার সময় সাব্বির এর পাশে তার মাকে থাকতে হয়, এমনকি গোসলের সময়ও মাকে দরজার বাইরে থাকতে হয়। এই নিয়ে তার বাবা তো বটেই বড় দুই ভাই ও খুব বিরক্ত। কিন্তু সাব্বিরের মায়ের কিছুই করার নেই। নিরবে চোখ মোছা ছাড়া। বলতে পারেন সাব্বিরের সমস্যা টা ঠিক কোথায়? আচ্ছা ঠিক আছে আমি ই দিয়ে দিচ্ছি, সাব্বিরের সমস্যা হল ভয়। খাটি বাংলায় যাকে বলে একা থাকার ভয়। আমাদের সবুজ ভাইয়ের বউ কিংবা সাব্বিরের এই একা থাকার ভয় পাওয়াকে মনোবিজ্ঞানীগন মানুষের একটি মেন্টাল ডিস অর্ডার হিসেবে অখ্যায়িত করে তার নাম দিয়েছেন মনোফোবিয়া (Monophobia)।
মনোফোবিয়া (Monophobia) দুইটি শব্দের সমন্ময়ে গঠিত। Monos ( মোনোস) যার অর্থ একাকীত্ব, Phobos ( ফেবোস) যার অর্থ হল ভয়। আর এই দুইটি শব্দের যোগে গঠিত মনোফোবিয়া (Monophobia) এর ফুল মিনিং দাঁড়ায় একা থাকার ভয় বা একাকীত্বের ভয়। মনোফোবিয়া (Monophobia) কে অনেক সময় Autophobia, Isolophobia, Eremophobia ইত্যাদি নামে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। তবে যে নামেই ডাকা হউক না কেন সবগুলোই ঘুরেফিরে একই অর্থ দেয়- আর তা হল, জীবনে একা হয়ে যাওয়ার ভয়।
মনোফোবিয়া (Monophobia) হলো একধরনের মেন্টাল ডিস অর্ডার যা মানোসিক রোগ হিসেবে ট্রিট করা হয়ে থাকে। মনোফোবিয়া (Monophobia) রোগে আক্রান্ত মানুষ সর্বদা একা হয়ে যাবার ভয়ে শঙ্কিত থাকে। পৃথিবীতে শুধু মাত্র মানুষই না, পশুদেরও মনোফোবিয়া (Monophobia) রোগে ভুগতে দেখা যায়। মনোফোবিয়া (Monophobia) কাটিয়ে ওঠা খুব সহজ কোনো বিষয় নয়। সত্যিকার অর্থে আক্রান্ত ব্যক্তির প্রকাশভঙ্গী এমন হয় যে মনোফোবিয়া (Monophobia) তে আক্রান্ত রোগীটি তার ভালবাসার মানুষটিকে খুব বেশি ভালবাসে তাই তাকে চোখের আড়াল করতে চায় না। আর তাই এমন ইতিবাচক লক্ষণ যুক্ত থাকার কারণে কেউই একে রোগ মনে করেন না।
মডেল – বহ্নি হাসান। ফাইল ফটো
মনোফোবিয়া (Monophobia) রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিটি সর্বদা চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। তাকে সবসময় উদ্বিগ্ন, বিষণ্ণ দেখায় এবং তাকে সর্বদা একা হয়ে যাবার ভয় পেতে দেখা যায়। এর ফলে মনোফোবিয়া (Monophobia) তে আক্রান্ত ব্যাক্তিটির ঘুম, খাওয়া, এমনকি একা বাথরুমে যেতেও সমস্যা হয়। মনোফোবিয়া (Monophobia) তে আক্রান্ত লোকজন স্বাভাবিক কোনো কাজ করতে পারে না। মাঝে মাঝে তার এই অতিরিক্ত সাথে সাথে থাকার প্রবণতা থেকে কাছের মানুষের সাথে সম্পর্ক খারাপ হতে শুরু করে, যা তার জন্য এক সময় আরও বেশি ক্ষতিকর হয়ে ওঠে।
মনোফোবিয়া (Monophobia) রোগের উৎপত্তি বা কারণ সুনির্দিষ্ট ভাবে বলা একটু কঠিন। এটি হতে পারে ছোট বেলায় কোনো বড় দুর্ঘটনার কারণ থেকে, কারো হতে পারে চোখের সামনে ঘটে যাওয়া কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা থেকে, আবার কারো হতে পারে খুব কাছের মানুষের অপ্রত্যাশিত মৃত্যু থেকেও । আবার এমনো দেখা গেছে কোন মানুষের দীর্ঘ সময় ধরে পুষে রাখা দুশ্চিন্তা, সম্পর্কে অবনতি, বাসায় অসঙ্গতিমূলক পরিবেশের ইত্যাদি কারনেও কেউ কেউ মনোফোবিয়া (Monophobia) তে আক্রান্ত হতে পারেন ।
তবে এইটা বলা যায় যে, যে সব লোক জন খুব বেশি উদ্বিগ্নতার মাঝে থাকেন, তারা একটি নির্দিস্ট সময়ের পর মনোফোবিয়া (Monophobia) তে আক্রান্ত হন। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যে সকল বাচ্চারা নিজেদের বাবা-মায়ের কাছে কম সময় পায় বা বাড়িতে গৃহকর্মীদের নিকট বড় হয়, বড় হয়ে তাদের মাঝে বিভিন্ন রকমের ফোবিয়া দেখা দেয়। এই ফোবিয়া গুলোর মধ্যে মনোফোবিয়া (Monophobia) অন্যতম। মনোফোবিয়া (Monophobia) তে আক্রান্তদের আত্মবিশ্বাসের প্রচন্ড অভাব থাকে। এরা স্বাধীন থাকার চেয়ে সাধারণত নিজের সবচেয়ে কাছের মানুষটার উপর খুব বেশি নির্ভরশীল হয়ে থাকতে ভালবাসে।
ধরুন কেউ আপনার সাথে কেউ মনোফোবিয়া (Monophobia) আক্রান্ত রোগীর মত আচারন করছে,অথবা বুঝতে পালেন আপনার ঘনিষ্ট কেউ মনোফোবিয়া (Monophobia) রোগে আক্রান্ত হয়ে গিয়েছে। এক্ষেত্রে আপনি যা যা করতে পারেন তা হলো-
মডেল – বাঁধন ছবি – কালাক্ষর ডেক্স
আমাদের অজান্তেই আশেপাশের অনেকেই মনোফোবিয়া (Mono phobia) সহ বিভিন্ন ফোবিয়ায় আক্রান্ত হয়ে গিয়েছে। অনেক সময় এটাও দেখা গেছে যে, অতিরিক্ত স্নেহপ্রবণতাও মনোফোবিয়া (Mono phobia) তে আক্রান্ত হবার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। মনোফোবিয়া (Mono phobia) থেকে বাঁচতে হলে পরনির্ভরশীলতা থেকে বেরিয়ে এসে প্রতিটি মানুষেরই নিজের উপরে নির্ভরশীল হতে শেখা উচিত। আমাদের এই নাগরিক ব্যস্ত জীবনে সব সময় হয়ত সবচেয়ে কাছের বন্ধু অথবা পরিবারের মানুষগুলো একে অপরকে দেওয়ার মত সময় ঠিকমত বের করতে পারে না। বাস্তবতা এমন দাড়িয়েছে যে, আপনি, আমি আমাদের আশেপাশের সবাই যেকোনো মুহূর্তে মনোফোবিয়া (Mono phobia) তে তো বটেই সাথে সাথে অন্য সব ফোবিয়ায় নিজেদের অজান্তেই আক্রান্ত হয়ে যেতে পারি। এমন অবস্থায় যেকোনো পরিস্থিতির মোকাবেলা করার মত মানসিক প্রস্তুতি রাখতে হবে। বাস্তবতার নিরিখে সব কিছুর হিসেব মেলাবার মত মানুষিক দৃঢ়তা আনতে হবে। মনে রাখবেন আবেগ যেখানে প্রবল সেই খানে ভজঘট বাধার সম্ভাবনা খুব বেশি থাকে। তাই আবেগ নয় বাস্তবিক হন, আত্মনির্ভরশীল হোন, সুস্থ থাকুন। ভাল থাকবেন। ধন্যবাদ
Leave a Reply