গ্যাসলাইটিং ইফেক্ট (Gaslighting Effect) একটি সামাজীক অবক্ষয়ের নাম। এটি সঠিক ভাবে বোঝাতে আজ আমরা একটি গল্পের অবতারনা করবো- আশা করি লেখাটি পড়ে আপনাদের বুঝতে সুবিধা হবে।আতিক ও শুভ্রার ভালবাসার সংসারে কোন কিছুর কমতি নেই। এক মাত্র মেয়ে নীরা কে নিয়ে তাদের এই সাজানো গোছানো জগতটাতে খুব বেশি প্রাচুর্যে ভরপুর না থাকলে ভালবাসার কমতি নেই। শুরুর দিকে শুভ্রা ও ভাল বেতনের একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি তে জব করতো। কিন্তু মেয়েটা হবার পর মেয়ের জন্য শুভ্রা জব ছেড়ে দেবে কি না এই এই নিয়ে সিদ্ধান্তহিনতায় ভুগছিল সেই সময় আতিক তার সিদ্ধান্ত নেবার ভার শুভ্রার উপর ছেড়ে দেয়। এর কারন আতিক শুধু তা হাজবেন্ড ই নয় ভাল বন্ধু ও বটে। সব বিষয়ে তাদের আন্ডাস্ট্যান্ডিং খুব ভাল। ভাল চলছিল জীবন মেয়ে নীরা কে স্কুলে আনা নেওয়া আর ঘর কন্যার কাজ নিয়ে। কিন্তু তার পরেও কর্ম দিবসে যখন আতিক অফিসে যায় তখন কিছুটা শুন্যতা ভর করে নীরার মায়ের (শুভ্রা) ভিতর। কাজের মানুষ বসে গেলে যা হয়৷ কিন্তু বিষয় টা শুভ্রা তেমন আমলে ন্যায় না। মেয়ে নীরার স্কুলে আনা নেওয়া প্লাস তার টেককেয়ার টাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়।
এভাবেই চলছিল কিন্তু শুভ্রা এক দিন লক্ষ করে ওই স্কুলের আরেকজন সুদর্শন অভিভাবক জামান কী রকমভাবে যেন তাঁর দিকে তাকাচ্ছে। দেহের ভাষা আর চোখের চাহনি দিয়ে শুভ্রার দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন। প্রথম প্রথম শুভ্রা পাত্তা না দিলেও কিউরেসির বসে হউক আর ভাল লাগার বসেই হউক জামানের সাথে মাঝে মধ্যে সৌজন্যমূলক কথাবার্তা থেকে শুরু করে।মুঠোফোনের নম্বর আদান–প্রদান, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে (সোশ্যাল মিডিয়া) যোগাযোগ এবং রোমান্টিক বার্তা আদান–প্রদান হতে থাকে। সেই থেকে শুরু জামান আস্তে আস্তে শুভ্রার খুব কাছের মানুষ হয়ে যায়। আর শুভ্রাও ধীরে ধীরে প্রতি দুর্বল হতে থাকে। এক দিন তারা ঘুরতেও যায়। ফেরার পথে জামান তাকে তার এক পরিচিতর বাসায় নিয়ে যায়। ওই বাসায় গিয়েই শুভ্রা বুঝতে পারে কি ভুল করে ফেলেছে। জামান তার সাথে শারীরিক সম্পর্ক করে। শুভ্রা বুঝতে পারে এইটা ভুল। সে যা করছে তা তার হাজবেন্ড কে চরম ভাবে ঠকানো হচ্ছে। কিন্তু শুভ্রার যে পথ ও নেই। এর পর থেকে প্রায়সই শুভ্রাকে জামানের সয্যা সংগীনী হতে হয়। জামানের পোষা খেলার পুতুল হয়ে গেছে সে। তাই জামানের ডাকে সারা দেওয়া ছাড়া তার উপায় ও নেই।
মডেল – জয়া আহসান। ছবি – কালাক্ষর ডেক্স
কারন জামান তার সাথে করা প্রথম দিনের সেক্স এর ভিডিও গোপনে ধারন করে রেখেছে। এই সব করে জামান শুভ্রার ওপর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ফেলেন। কোনো একসময় অন্তরঙ্গ সম্পর্ক তৈরির চেষ্টা করে ব্যর্থ হলে শুভ্রার ওপর মানসিক চাপ দেওয়া শুরু করেন। শুভ্রা যা করেননি বা বলেননি, সেটাও সত্য বলে তাঁর ওপর চাপাতে থাকেন। ইমোশনাল ব্ল্যাকমেলিং করা শুরু করেন। শুভ্রার মধ্যে উদ্বেগ, বিষণ্নতা আর চাপের (স্ট্রেস) লক্ষণ দেখা দিতে শুরু হয়। বিপর্যস্ত শুভ্রা নিজেকে মানসিক রোগী হিসেবে ভাবতে শুরু করেন। মনোবিজ্ঞানের ভাষায় এভাবে মানসিক নির্যাতন করাকে বলা হয় ‘গ্যাসলাইটিং সিনড্রোম ’।
কেউ হয়তো শারীরিক ও মানসিক ভাষা দিয়ে অপর একজনকে আকর্ষণ করার চেষ্টা করছে। একপর্যায়ে সে সফল হয়ে ওই মানুষের মানসিক নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ফেলে। এরপর যদি তার সব কথা না শোনে, তবে শুরু হয় ব্ল্যাকমেলিং, মানসিক নির্যাতন। মনোবিজ্ঞানের ভাষায় একে ‘গ্যাসলাইটিং’। এই গ্যাসলাইটিং শিকারকে কুরে কুরে খায়। তাকে মানষিক ভাবে বিপর্যস্ত করে ফেলে। এমন কি ধীরে ধীরে সুইসাইড এর দিকে টেনে নিয়ে যায়।
তিরিশের দশকে প্যাট্রিক হ্যামিলটন রচিত গ্যাসলাইট উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত হয়েছিল একটি চলচিত্র। যা ১৯৪৪ সালে মুক্তি পায়।এই গ্যাসলাইট থ্রিলার ছবির নাম থেকে এই বহুল শব্দটি এসেছে। সেই চলচ্চিত্রে নায়ক চার্লস বয়ার একজন স্বামীর চরিত্রে অভিনয় করে ধীরে ধীরে তাঁর স্ত্রীর মনের ওপর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেন। স্ত্রীকে (বার্গম্যান) মানসিকভাবে নির্যাতন করতে থাকেন। একপর্যায়ে স্ত্রীকে ভাবতে বাধ্য করেন যে স্ত্রী মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছেন। যাঁরা এ ধরনের নিপীড়ন করেন, তাঁদের বলা হয় ‘গ্যাসলাইট’ আর প্রক্রিয়াটিকে বলা হয় ‘গ্যাসলাইটিং’ (Gaslighting)।
গ্যাসলাইটিং–প্রক্রিয়ায় শিকারকে ভাবতে বাধ্য করা হয় তিনি ভুল করেছেন বা ভুল ভেবেছেন। যেমন যে কাজটি তিনি করেননি, তাঁকে ভাবতে বাধ্য করা হয় সেই কাজটি তিনি করেছেন। আবার যা প্রকৃতপক্ষে ঘটে গেছে, কিন্তু শিকারকে ভাবতে বাধ্য করা হয় এমনটা আদৌ ঘটেনি। ফলে বাস্তবতা আর বিশ্বাসের মধ্যে একটি দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। এই দ্বন্দ্ব থেকে মানসিক বিপর্যস্ততা দেখা দেয়। হয়তো একটি ই–মেইল ডিলিট করে দেওয়া হলো এবং যিনি মেইলটা পাঠিয়েছেন তিনি অস্বীকার করা শুরু করলেন যে আদৌ কোনো মেইল পাঠানো হয়নি! তখন মেইল প্রাপক একধরনের মানসিক যাতনায় পড়ে যান, নিজের ওপর বিশ্বাস হারাতে থাকেন।যা করেননি তা ভাবতে েকউ যেন আপনাকে বাধ্য করতে না পারে নারী বা পুরুষ যে কেউ গ্যাসলাইটিংয়ের শিকার হতে পারেন, তবে নারীদের আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি।দ্য গ্যাসলাইট ইফেক্ট বইয়ের লেখক ড. রবিন স্টার্ন, যিনি আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা (ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স) নিয়ে ব্যাপক গবেষণা করেছেন, তিনি তিন ধরনের ‘গ্যাসলাইটার’–এর বর্ণনা তাঁর বইয়ে উল্লেখ করেছেন।
গ্যাসলাইটার আসলে ঠিক ভিলেন নন, অনেকটা অ্যান্টি ভিলেন। অর্থাৎ প্রকৃত খলনায়ক না হয়েও তাঁর কর্মকাণ্ড খলনায়কের মতোই।যিনি প্রতিনিয়ত শিকারের মনে দ্বন্দ্ব (কনফিউশন) তৈরি করেন।
যখন দেখবেন কেউ আপনাকে বিভ্রান্ত করছেন, আপনার সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনা অলীক প্রমাণিত হচ্ছে বা যা হয়নি, তা হয়েছে বলে সবাইকে বিশ্বাস করাচ্ছেন। নিজের বিশ্বাসের ওপর আস্থা হারাতে থাকবেন এবং সন্দেহ শুরু হবে, ‘আসলেই কি এমনটা হয়েছে, নাকি হয়নি?’
মডেল – অহনা রহমান। ছবি – কালাক্ষর ডেক্স
যদি মনে করেন যে আপনি গ্যাসলাইটিংয়ের শিকার হচ্ছেন, তবে যা করতে পারেন—
ধন্যবাদ আর্টিকেল টি পড়ার জন্য। ভাল লাগলে কমেন্টস করে জানান। আর শেয়ার করে অন্যদের পড়ার সুযোগ দিন। তাতে আমার ইনেস্পায়ার আসে আরো নতুন নতুন লেখার।
Leave a Reply