সৃজনশীল বাংলা ব্লগ “কালাক্ষর” এ আমি বেশিরভাগ সময় মানুষের মনোজগতের নানা জটিল বিষয় নিয়ে আলোচনা করে থাকি। আমার এই আলোচনার এক মাত্র উদ্দেশ্য থাকে মানুষেকে মনস্তাত্ত্বিক বিষয়ে ভাল ভাবে বোঝানো। এই কাজ করতে না আমায় কেউ নিয়োগ দিয়েছে। না আমায় কেউ কোন অর্থ দ্যায়। না পাই কারো কাছ থেকে কোন ক্রেডিট। তার পরেও কাজটি করি শুধু মাত্র নিজের আত্ততৃপ্তির জন্য, নিজের খেয়ে বনের মেষ তাড়ানোর স্বভাব আছে শুধু মাত্র এই জন্য- যাই হোক প্রতি দিনের মত আজ ও আমি ঠিক সেই অর্থে হিউম্যান সাইকোলজির কোন বিষয় নিয়ে আলোচনায় যাচ্ছি না, আজ বরং এমন এক বিষয় নিয়ে আলোচনা করবো যা জানা প্রতিটি মানুষের খুব জরুরী। আর তা হল ব্রেইন ফগ। ব্রেইন ফগ কে খাটি বাংলায় তর্জমা করলে এর অর্থ দাঁড়ায় মেঘাচ্ছন্ন ব্রেইন বা মেঘাচ্ছন্ন মস্তিস্ক বলা হয়। বিস্তারিত আলচনায় যাবার আগে প্রথমে জেনে নেওয়া যাক ব্রেইন ফগ বা মেঘাচ্ছন্ন মস্তিস্ক কি? কাকে ব্রেইন ফগ বা মেঘাচ্ছন্ন মস্তিস্ক বলা হয়?
লেখাটিতে আরো যা জানতে পারবেন
মনে করুন, শীতের সকালে ঘর হতে বের হয়ে দেখলেন চার পাশের পরিবেশ কুয়াশার চাদরে ঢেকে আছে। আর এই কুয়াশাচ্ছন্ন পরিবেশে আপনার কাছে সবকিছু ধোঁয়াটে লাগছে, আপনি দুই হাত দূরের কিছুও ঠিকমতো দেখতে পারছেন না। যার অর্থ, কুয়াশা আপনার দৃষ্টিশক্তির সীমানাকে সংক্ষিপ্ত করে দিয়েছে। এমন হলে আপনি চাইলেও আপনার দশ হাত সামনে কী আছে তা ভালো ভাবে দেখতে পারবেন না।
সৃজন শীল বাংলা ব্লগ কালাক্ষর এ আমার লেখা পুরাতন লেখা গুলো পড়ার জন্য অনুরোধ রইল
আপনি কি জানেন? শিতের সকালের কুয়াচ্ছন্ন পরিবেশের ন্যায় ঠিক একই রকম অবস্থা, আপনার মস্তিষ্কের সাথেও ঘটতে পারে। আর তাতে আপনার ভিতর এমন অবস্থা দাঁড়াতে পারে যে, দেখা যাবে আপনি ঠিকমতো কিছু ভাবতে পারছেন না, আপনার সকল চিন্তাভাবনা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে, আপনি কোনো কাজে মন বসাতে পারছেন না, আপনার কোনো কিছু স্মরণেও থাকছে না। যদি আপনার ভিতর এমন অবস্থার সৃষ্টি হয় তখন, আপনার মস্তিষ্কের ভেতরে শিতের সকালের মত ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়েছে, বলে ধরে নেওয়া হয়, যা আপনার মস্তিষ্কের স্বাভাবিক কার্যক্রমকে ব্যাহত করতে বাধ্য। মনোবিজ্ঞানের পরিভাষায় এই অবস্থাকেই ব্রেইন ফগ বা কুয়াচ্ছন্ন মস্তিস্ক বলা হয়।
মেঘাচ্ছন্ন মস্তিষ্ক; Image Source: Quora
তবে হ্যাঁ জেনে রাখা ভাল, বাস্তবিক অর্থে কারো মস্তিষ্কে এমন ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয় না এবং এটি কোনো স্বকীয় মেডিকেল কন্ডিশনও নয়। তবে বিভিন্ন ধরনের মেডিকেল কন্ডিশনের পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়ায় আপনার মস্তিষ্ক প্রভাবিত হতে পারে, যার ফলে আপনার মস্তিস্কে তথাকথিত ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়ে আপনার ব্রেইন ফগ হতে পারে।
ব্রেইন ফগ হলে মস্তিষ্কের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হয়, অর্থাৎ আপনার ব্রেইন ফগ হলে আপনি আপনার মস্তিষ্ক থেকে সচরাচর যে পরিমাণ কাজ প্রত্যাশা করেন,সেই পরিমাণ কাজ আপনার মস্তিস্ক করতে পারবে না,আর যদি তা হয় তবে আপনার ব্রেইন ফগ হয়েছে বলে ধরে নেয়া যেতে পারে। আরো সুনির্দিষ্টভাবে বললে বলতে হয়, যদি আপনার মস্তিষ্ক নিচের কোনো এক বা একাধিক সমস্যা যুক্ত লক্ষন উপস্থিত থাকে, তবে আপনার ব্রেইন ফগ হয়েছে বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে।
যদিও এগুলোকে মেন্টাল ফ্যাটিগ বা মানসিক শৈথিল্য হিসেবেও অনেকে চিহ্নিত করে থাকেন। তবে মূল বিষয়টি হলো, আপনার অবস্থা ঠিক কতটা গুরুতর। কারো কারো ক্ষেত্রে এটি কেবলই স্বল্পস্থায়ী একটি সমস্যা, নির্দিষ্ট সময় পর যা কেটে যায়। আবার কারো কারো ক্ষেত্রে সমস্যাটি এতটাই সংকটাপন্ন হয়ে যায় যে, এই ব্রেইন ফগের প্রভাবে তার শিক্ষা, কর্ম ও ব্যক্তিজীবনেও অনবরত সমস্যা দেখা দিতে থাকে।
মানুষের এই ব্রেইন ফগ কেন হয়? এর পেছনের কারণ গুলোর মধ্যে বিশেষজ্ঞরা কয়েকটি সাধারণ কারণ খুঁজে বের করতে সক্ষম হয়েছেন। চলুন, জেনে নেওয়া যাক সেই কারণ গুলো কি কি?
কোন অনাকানিংক্ষিত বিষয় নিয়ে উদ্বিগ্ন বা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত থাকা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তির ভিতর একটি। প্রায় সব মানুষ প্রায় সময়ই কোনো না কোনো বিষয় নিয়ে উদ্বিগ্ন বা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত থাকে। আবার এমনো দেখা যায় কিছু কিছু মানুষের উদ্বিগ্ন হওয়ার সুনির্দিষ্ট কোনো বিষয় বা কারণ এরও প্রয়োজন হয় না। তারা কোনো কারণ ছাড়াই, অজানা আশঙ্কায় শঙ্কিত হয়ে থাকে। তবে উদ্বেগের পেছনে কারণ থাকুক বা না থাকুক, সেই উদ্বেগের মাত্রা যদি খুব বেশি হয়, এবং উদ্বিগ্ন হওয়ার প্রবণতাও যদি ঘন ঘন দেখা দিতে থাকে, তবে তার ফলে ব্রেইন ফগ হতে পারে। চিন্তাভাবনা এলোমেলো হওয়া এবং মনোযোগহীনতা এক্ষেত্রে দুটি প্রধান লক্ষণ।
কোন রোগীকে ওষুধ সেবন করতে দেওয়া হয় দ্রুত রোগমুক্তি, কিংবা কোনো রোগকে মাত্রা ছাড়ানো থেকে আটকানোর আশায়। কিন্তু কিছু কিছু ওষুধ, সেবনকারীর উপর নেতিবাচক পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। বিশেষত বয়স্ক রোগীরা হঠাৎ করে নতুন কোনো ওষুধ সেবন শুরু করলে, তাদের মনে স্মৃতিভ্রম এবং ব্রেইন ফগে আক্রান্তের সম্ভাবনা প্রকট আকারে বেড়ে যায়। উদ্বিগ্নতা, সিজার প্রভৃতি মানসিক সমস্যার প্রতিষেধক কিংবা নারকোটিক পেইন মেডিসিন সেবনে ব্রেইন ফগ হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
যদি কোনো ব্যক্তির রাতে পর্যাপ্ত পরিমাণ ঘুম না হয় তখন সেই ব্যাক্তির ইনসমনিয়ায় আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়। এর প্রভাবে অনেক সময়ই সেই ব্যাক্তি বিভ্রান্ত থাকতে পারে। পাশাপাশি তার বিচারবুদ্ধি যেমন আংশিক লোপ পেতে পারে, তেমনই স্মৃতিশক্তিও লোপ পাওয়ার আশঙ্কা থাকে। এছাড়া ইনসমনিয়ার অন্যান্য শারীরিক পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়াও থাকতে পারে, যেমন: এর ফলে স্ট্রোক, অ্যাজমা কিংবা সিজারের ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে, উচ্চ রক্তচাপ দেখা দিতে পারে, এবং হৃদযন্ত্রের অন্যান্য বিভিন্ন রোগের সম্ভাবনাও বেড়ে যেতে পারে।
লৌহ এর কাজ হল মানুষের শরীরে ফুফফুস থেকে শরীরের অন্যান্য অংশে অক্সিজেন পরিবহনের কাজে সহায়তা করা। কিন্তু যদি মানুষের শরীরে যথেষ্ট পরিমাণে লৌহ না থাকে, তখন বেশ কিছু উপসর্গ দেখা দ্যায়, যার মধ্যে ব্রেইন ফগ অন্যতম। মানুষের শরীরে লৌহের ঘাটতি রয়েছে কি না তা জানার জন্য সাধারণত রক্ত পরীক্ষার প্রয়োজন পরে। এর পাশাপাশি চিকিৎসককে এটিও অবগত করা প্রয়োজন যে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসা, হৃদকম্পন বেড়ে যাওয়া, জিহবা শুকিয়ে যাওয়া ছাড়াও আমরা ব্রেইন ফগেরও সম্মুখীন হচ্ছি।
ভিটামিন বি-১২ এর অভাবে সৃষ্ট সমস্যা; Image Source: YouTube
মানুষের কোনো কিছু পরিষ্কারভাবে চিন্তা করতে না পারার দক্ষতা, কোনো ব্যাপারে সুস্পষ্ট যুক্তি খুঁজে বের করতে কষ্ট হওয়া প্রভৃতি হলো শরীরে বি-১২ ভিটামিনের ঘাটতির কিছু প্রাথমিক লক্ষণ। এছাড়া আরো কিছু লক্ষণও দেখা দিতে পারে, যেমন- শরীরের ভারসাম্য রক্ষা করতে কষ্ট হওয়া, দুর্বল অনুভব করা, অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়া, হাত-পা ও পায়ের পাতা অসাড় হয়ে যাওয়া ইত্যাদি। অনেক সময় দেখা যায়, কোন বয়স্ক রোগীর যদি হঠাৎ করেই খাদ্য তালিকায় পরিবর্তন আনা হয় বা আগের চেয়ে খাদ্যের পরিমাণ কমিয়ে দেয়া হয়ে,আর এই বদলে দেওয়া খাদ্য তালিকায় যদি পর্যাপ্ত পরিমানে ভিটামিনের উপস্থিতি থাকে না, তাদের মধ্যে ব্রেইন ফগ এর সমস্যা সৃষ্টির সব চেয়ে বেশি ঝুঁকি থাকে।
যে সব মানুষের ভিতর ক্রনিক ফ্যাটিগ সিনড্রোম বা ঘন ঘন অবসাদগ্রস্ত বা মানসিকভাবে শিথিল হয়ে পড়ার লক্ষন আছে, তারা আমির খানের গাজনী সিনেমার মত শর্ট-টাইম মেমোরি লস কিংবা মনোযোগহীনতার শিকারও হতে পারেন।
মানুষের মাংসপেশি, টেন্ডন এবং অস্থিসন্ধিগুলোতে প্রদাহ জনিত রোগের নাম হল ফাইব্রোমায়ালজিয়া। ফাইব্রোমায়ালজিয়া হলো একটি দীর্ঘমেয়াদী শারীরিক অসুস্থতা জনিত রোগ। ফাইব্রোমায়ালজিয়া আক্রান্ত অনেক মানুষের মধ্যেই ব্রেইন ফগও দেখা যায়, তবে এক্ষেত্রে অনেকে এটিকে “ফাইব্রো ফগ” হিসেবে অভিহিত করে থাকেন।
লাইম রোগটি বোরেলিয়া বাগডোরফেরি নামক ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সংক্রামিত বা আক্রান্ত পোকামাকড়ের কামড়ের কারণে হয়ে থাকে । সাধারণত লাইম রোগের উপসর্গ হিসেবে জ্বর, মাথা ব্যথা, ক্লান্তি এবং ত্বকে ফুসকুড়ি দেখা দেওয়া কে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। এছাড়া এই রোগটি মানুষের শরীরের পেশি, রক্ত সংবহনতন্ত্র, হজম প্রক্রিয়া এবং স্নায়ুতন্ত্রকেও প্রভাবিত করে। শেষোক্তটির কারণে ব্রেইন ফগ দেখা দিতে পারে।
মডেল- বহ্নি হাসান। ছবি – কালাক্ষর ডেক্স
খাটি বাংলায় একটা কথার প্রচলন আছে, কোনো রোগ বা সমস্যার কার্যকারণ সম্পর্কে আপনার আগে জানা থাকে, তাহলে সেই রোগ বা সমস্যা সৃষ্টি হবার আশঙ্কা আপনার ভিতর অনেকটাই কম হবে। তাই আজকের এই দীর্ঘ আলোচনার মাধ্যমে আপনারা যেহেতু আপনাদের ব্রেইন ফগের নেপথ্যে কী কী কারণ থাকতে পারে তা জানানো হল, তাই আপনাদের কাছে প্রত্যাশা করাই যায়, আপনারা এখন থেকে সবসময় ব্রেইন ফগ রোগের এইসব কার্যকারণের ব্যাপারে সচেতন থাকবেন, ফলে আপনারাও ব্রেইন ফগের শিকার হতে রক্ষা পাবেন । এখন ব্রেইন ফগ থেকে বাঁচার জন্য আরো কয়েকটি উপদেশ মেনে চলাও আবশ্যক তা আপনাদের জানাচ্ছি-
It’s the Bengali language-based article in Brain Fog. Necessary references have been hyperlinked inside.
Leave a Reply