১৮৯৭ সালে প্রকাশিত হয় আইরিশ সাহিত্যিক ব্রাম স্টোকারের উপন্যাস ‘ড্রাকুলা’। রাতা রাতি বিখ্যাত হয়ে যাওয়া ড্রাকুলা উপন্যাস টির প্রথম প্রকাশনায় ছিলো আর্চিবল্ড কনস্টেবল অ্যান্ড কোম্পানি। উপন্যাস টির ব্যাপক জনপ্রিয়তা পাবার অন্যতম কারণ উপন্যাসটির কাহিনী এবং বিষয়বস্তু একথা কাউকে বলে দিতে হবে না। পৃথিবীর অন্য সব দেশের মত বাংলাদেশেও ভূত প্রেত নিয়ে রয়েছে নানা ধরণের হাজার পদের উপকথা। আমরা যারা গ্রামে বড় হয়েছি তাদের প্রায় সবাই ভূতের গল্প শুনে বড় হয়েছি। পড়েছি দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের ‘ঠাকুরমার ঝুলি’ কিংবা ভূতের বিখ্যাত সব গল্প, কাহিনী। তাই আমাদের প্রায় সবার মাঝেই এর প্রতি একটা আলাদা আগ্রহ কাজ করে। আমাদের মত ইউরোপ, আমেরিকাতে ভূত প্রেতের পরিবর্তে ভিন্ন এক ধরনের অশুভ শক্তির অস্তিত্বের উপস্থিতি নিয়ে অনেকের ভিতর বিশ্বাস রয়েছে ।
অন্ধকারের বাসিন্দা এই অশুভ অস্তিত্বের আরেক নাম হল ‘ভ্যাম্পায়ার’। ভ্যাম্পায়ারদের অন্যতম খাবার তাজা রক্ত। ভ্যাম্পায়ার রা রাত্রের বেলায় বিচরন করে কারণ দিনের বেলায় সুর্যের আলো তারা সয্য করতে পারে না তাই এরা দিনের বেলায় বের হতে পারেনা। মানব মনে ভিতি গাজানিয়া এই ভ্যাম্পায়ারদের যুক্ত করেই লেখা হয়েছিল ‘ড্রাকুলা’ উপন্যাসটি, যেখানে ভ্যাম্পায়ার হিসেবে পাঠক পরিচিত হয় কাউন্ট ড্রাকুলার সাথে। ফলে পাঠকদের অন্যতম আগ্রহের জায়গাটি লেখক উপন্যাস টিতে দারুণভাবে উপস্থাপন করায় উপন্যাসটির কাটতি বহু গুন বেড়ে যায় এই বইয়ের।
কিন্তু আপনার মনে কি প্রশ্ন জাগে না? আসলেই কি বাস্তবে ‘ভ্যাম্পায়ার’ বলে কিছু আছে? আমাদের উপমহাদেশের প্রায় সব মানুষের মনেই এই একই প্রশ্ন খায়। বাস্তবিক অর্থে আসলেই কি ভূত আছে? আসলেই কি কোন মানুষ যদি অপঘাতে মৃত্যু বরণ করলে, সেই মৃত মানুষ ভূত হয়ে যায়? আসলেই কি কোন মৃত দেহ যথাযত ভাবে সৎকার না করলে সেই মৃত ব্যাক্তিটির আত্মা এখানে সেখানে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে মানুষদের সামনে হাজির হয়?
তবে সত্যি সত্যি ভ্যাম্পায়ার আছে নাকি নেই? সেই বিতর্কে আজ আপনাদের টেনে নিয়ে যাব না। বরং আমাদের আজকের এই লেখার উদ্দেশ্য হল আপনাদের এমন একটি রোগের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়া যা জানলে মনে হবে এই রোগীই তো আসলে ভ্যাম্পায়ারের বাস্তব রূপ।
ভ্যাম্পেয়ারের সাথে সাদৃশ্যপুর্ন এই রোগ টির নাম ‘ভ্যাম্পায়ার সিনড্রোম’, যাকে অন্যভাবে কেউ কেউ ‘পোরফেরিয়া’ বলে আখ্যায়িত করে থাকেন। অনেকে আবার এই সিনড্রোমটিকে রোগ হিসেবে চিহ্নিত না করে জেনেটিক ডিসঅর্ডার হিসেবে আখ্যায়িতও করে থাকেন। অনেক গবেষকদের ধারণা, এই ডিসঅর্ডারটি মূলত বংশগত একটি রোগ। তবে এই ধারণা নিয়ে ভিন্নমতও আছে। তবে যাই হউক সারা পৃথিবীতে বিরাজন মান এই বিরল রোগটি গড়ে প্রায় প্রতি দশ লাখ মানুষের মধ্যে একজনের হয়ে থাকে।
ভ্যাম্পায়ার সিনড্রোম বা পোরফেরিয়া মূলত দুই ধরনের হয়ে থাকে। এর একটি হল রোগীর দেহের ত্বকের সাথে সম্পর্কিত, যাকে বলা হয় Cutaneous Porphyria বা ত্বকযুক্ত পোরফেরিয়া। অন্যটি হল রোগীর নার্ভ সিস্টেমের সাথে সম্পর্কিত, যাকে বলা হয় Acute Porphyria বা তীব্র পোরফেরিয়া।
এখানে রোগীর ত্বকযুক্ত পোরফেরিয়াকে ‘ভ্যাম্পায়ার সিনড্রোম’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। নিচে ভ্যাম্প্যার সিন্ড্রোমের অন্যতম কারণ ও বৈশিষ্ট্য দেওয়া হল ।
তীব্র পোরফেরিয়া মূলত রোগীর দেহের নার্ভ বা স্নায়ুর সাথে সম্পর্কিত। এই রোগের লক্ষণগুলো রোগীর দেহে কয়েক সপ্তাহ স্থায়ী হয়। তবে এই সময় রোগটি প্রকট আকার ধারণ করতে পারে। যদিও লক্ষণগুলো ভ্যাম্পায়ারের সাথে সম্পর্কিত নয়।
আমাদের দেহে ‘হিম’/ হিমোগ্লোবিন নামক একটি পদার্থের উৎপত্তি নিয়ে সমস্যা হওয়াই মূলত ভ্যাম্পেয়ার সিন্ডোম নামক রোগের প্রধান কারণ। ‘হিম’ হচ্ছে আমাদের রক্তের হিমোগ্লোবিনে থাকা এমন একটি প্রোটিনজাতীয় পদার্থ, এই পদার্থটি ফুসফুস থেকে আমাদের সারাদেহে অক্সিজেন সরবরাহ করে থাকে। আমাদের দেহের রক্তের লাল রঙের অন্যতম কারণ এই ‘হিম’ নামক পদার্থ। এতে আয়রন থাকে, যা রক্তকে লাল রঙ দেয়। মূলত আমাদের যকৃৎ এবং অস্থিমজ্জার হাড়ের স্পঞ্জির কেন্দ্রে এর উৎপত্তি। ‘হিম’ উৎপাদনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের এনজাইম কাজ করে থাকে।
পোরফেরিয়া রোগীদের দেহে এই এনজাইমের ঘাটতি থাকে। এতে করে এই এনজাইমের অস্বাভাবিক ক্ষরণ হতে থাকে। ফলে দেহে তৈরি হয় পোরফেরিন নামক একধরনের পদার্থ, যেটি ত্বকে কিংবা স্নায়ুতে মারাত্মক প্রভাব ফেলতে শুরু করে। এর উৎপাদনে থাকে না কোনো নিয়ন্ত্রণ। এর ফলে এই দুই ধরনের রোগ দেখা যায়।
ভ্যাম্পায়ার সিনড্রোম কে এক ধরনের বংশগত রোগও বলা যেতে পারে। যদি কোন মানুষের পিতা অথবা মাতার শরীরে অটোসোমাল ডমিন্যান্ট ধরনের ত্রুটিপূর্ণ জিন থাকে কিংবা উভয়েরই কোনো অটোসোমাল রিসেসিভ ডমিন্যান্ট ধরনের কোনো ত্রুটিপূর্ণ জিন থাকে, তাহলে সেই মানুষটি ভ্যাম্পায়ার সিনড্রোমে আক্রান্ত হতে পারেন। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই রোগ রোগীর দেহে সুপ্ত অবস্থায় থাকে। অর্থাৎ সহজে লক্ষণ দেখা দেয় না। তবে আপনার শরীরে যদি উপরে উল্লেখিত এমন কোন জিনের উপস্থিতি থাকে, তবে আপনি হবেন আপনার পরবর্তি প্রজন্মের জন্য ভ্যাম্পেয়ার সিনড্রোম নামক রোগের জিনবাহক।
এছাড়াও মানুষের প্রাত্যহিক দিনযাপনের মধ্যে করা বাজে কিছু অভ্যাস অতিমাত্রায় করা হলে ভ্যাম্পায়ার সিনড্রোম রোগ দেখা দেয়ার সম্ভাবনা থাকে।
ভ্যাম্পায়ার সিন্ড্রোমের নির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা নেই। অর্থাৎ এই রোগের শিকার হলে রোগীকে অসহায়ের মতো ঘরে বসে থাকা ছাড়া রোগীর আর কোন উপায় থাকে না। রোগীকে ড্রাকুলার মতো করে দিনের বেলায় ঘরের ভিতর বন্দি হয়ে রাত্রের বেলায় হতে হয় নিশাচর। আর কারো ভিতর যদি এমন লক্ষণ দেখা দেখা দেয় তবে অবশ্যই তাকে ভালো ডাক্তার দেখানো উচিত। প্রথমে বুঝতে হবে রোগীটির কোন ধরনের পোরফেরিয়া হয়েছে। এরপর আক্রান্ত রোগীকে সেই অনুযায়ী চিকিৎসা সেবা দিলে এই রোগের তীব্রতা কমতে পারে।
রোগীর যদি তীব্র পোরফেরিয়া রোগে আক্রান্ত হয়, তবে সে ক্ষেত্রে রোগীকে এক ধরনের গ্লুকোজ যা রোগীর মুখ দিয়ে অথবা অন্য কোন উপায়ে রোগীর দেহে প্রবেশ করানো হয়ে থাকে। এই সময় রোগীকে ডাক্তার রোগের ব্যাপকতা অনুযায়ী হেমিনের ইনজেকশনও দিতে পারেন। তবে সব চিকিৎসা শুরু হয় রোগীর ভ্যাম্পেয়ার সিনড্রোম রোগে আক্রান্ত হবার মূল কারণ জানার পর। যদি রোগটি রোগীর বংশগত হয় তাহলে রোগীর চিকিৎসা ভিন্নভাবে করা হয়ে থাকে। ভ্যাম্পায়ার সিনড্রোম হলে রোগীর যকৃতে আয়রনের পরিমাণ কমানোর প্রকৃয়া হিসেবে রোগীর দেহের রক্ত নিয়মিত ভাবে পরিবর্তন করতে হয়।
ভ্যাম্পেয়ার সিনড্রোমে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াও নিজে থেকে এই সিনড্রোমের সময় করণীয় কাজগুলো করা খুবই কার্যকরী হিসেবে দেখা যায়। যদি কারো শরীর এই রোগের বাহক হয় তবে সেই বাহক লোকটির নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের ফলে লোকটি ভ্যাম্পেয়ার সিনড্রোম নামক অদ্ভুত এই রোগ থেকে দূরে থাকতে পারে। তবে তাকে নিয়মিত চিকিৎসকের কাছে যেতেই হবে এই কথা ১০০% নিশ্চিত ভাবে বলা যায়। এতে করে রোগি জানতে পারে তাঁর শরীরে উপস্থিত রোগটির বর্তমান অবস্থার সামগ্রীক হাল হকিকত।
This article is about a rare syndrome called ‘Vampire Syndrome’. It is also called Porphyria.
Leave a Reply