আচ্ছা আপনি কি কোন প্রতিযোগীতায় কিংবা কোন পরিক্ষায় বা কোন কাজে সাফল্য লাভের পর আপনার কি কখনো এমন মনে হয়েছে যে, “এই রে, ভাগ্য ভালো ছিলো বলে জিতে গেলাম। নইলে আমার জেতার বা কাজ টি করার জন্য আদতে কোন যোগ্যতা ছিল না, কিন্তু মাঘ মাস তো আর বছরের এক মাত্র মাস নয় আরো অনেক মাস আছে তাই এইবার না হয় ভাগ্য ভাল তাই জিতে গেছি কিন্তু পরের বার কি ভাগ্য এমন প্রসন্ন হবে?
আপনার কি তখন মনে হয়েছে, আমার ভাগ্য হয়ত পরের বার আপনার প্রতি আর প্রসন্ন হবে না তখন আপনার যারিজুরী সবার কাছে ফাস হয়ে যাবে, খুব দ্রুতই আপনি তখন ধরা পড়ে যাবেন। সবাই তখন আপনার জ্ঞ্যানের দৌড় কিংবা ক্ষমতা বুঝে ফেলবে,আপনি আসলে জানেনই না কী করে আজ আপনি সফলতা পেলেন, এমনিতে তো আপনি একটা গোবর গণেশ।”
অথবা ধরুন, কোনো বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণ করে বিভাগীয় পর্যায়ে জিতে জাতীয় পর্যায়ে এলেন। আপনার মনে কি কখনো এমন ভাবনা এসেছে যে, “আগের বার আমি ভাগ্যবান ছিলাম তাই সেবার উতরে গেছি! এবার আমার সব জারিজুরী ফাস হবে,স্টেজে উঠে যাস্ট আপনাকে অপমানিত হতে হবে।” নিজের যোগ্যতাকে ছোট মনে করে নিজেকে ‘কাকতালীয়ভাবে সৌভাগ্যবান’ আর সেই সাথে আপনার পাশের প্রতিযোগীকে প্রকৃতই পুরস্কার জেতার মত যোগ্য কি কখনো আপনার মনে হয়েছে? কিংবা কোন প্রতিযোগিতা থেকে স্বর্ণপদক নিয়ে ফিরে আসার পর, নতুন কোনো প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণ করতে গিয়ে আপনার কি মনে হয়েছে “এই রে.. এইবার অন্তত ঠিকই ধরা খেয়ে যাবো”!
বাঁধন। ছবি- কালাক্ষর ডেক্স
আমরা জানি অনৈতিক উপায় অবলম্বন করে যদি কেউ কোনো অর্জন থাকে তবে সাইকোলজিক্যালি সে মনে মনে হিনোম্মতায় ভোগে। সর্বদা তার মনে ‘চোরের মন পুলিশ পুলিশ’ ভাবনার উদয় হয়। কিন্তু যখন আপনি নিজের জগ্যতায় কোন রুপ অনৈতিক উপায় অবলম্বন না করে নায্যভাবেই নিজের গুণেই কিছু একটা অর্জন করলেন তখন? তখন ওপরের ব্যাপারটি মনে হওয়া সেইটা অস্বাভাবিক নয় কি?
সব মজার ব্যাপার হলো, সাফল্যর চূড়ায় আরোহণ করা মানুষদের ভেতর এমন অনেক মানুষই আছেন, যারা ওরকম করে ভাবেন। এতকিছু অর্জনের পরও নিজের যোগ্যতা নিয়ে তারা সব সময় আস্থার অভাবে ভোগেন। নিজের অদৃশ্য ‘অযোগ্য’ রূপ তাদের সব সময় তাড়িয়ে বেড়ায়। শুধু মাত্র এজন্যই তারা সব সময় ভয়ে তটস্থ থাকেন। পাছে লোকে বুঝে ফেলে তার অযোগ্যতা! তখন কি হবে? আজ যারা তার ট্যালেন্ট নিয়ে এত প্রশংসা করছে তারা তখন কি ভাববে? আহা- মান সম্মানের আর কিছুই তখন বাকি থাকবে না।
আপনার মনে যদি সফল মানুষ দের এরকম অভূত মনস্তত্ত্বের সাইকোলিজিক্যাল ব্যাখ্যা জানার আগ্রহ তৈরি হয় তবে আপনাকে বলছি, সফল মানুষদের এই অদ্ভত মনস্তত্তের সাইকোলিজিক্যাল ব্যাখ্যা আছে,সফল মানুষদের এই ধরনের চিন্তা মূলত তাদের এক প্রকার মানসিক ব্যধির প্রভাবে হয়ে থাকে। যার নাম ইমপোস্টার সিনড্রোম।
ইমপোস্টার সিনড্রোম। ইমেজ সোর্স – towardsdatascience.com
ইমপোস্টার শব্দটি দ্বারা আভিধানিক ভাবে প্রতারক, শঠ, ঠগ বা ঠগীদের বুঝানো হয়ে থাকে । তো যদি আপনি ইমপোস্টার সিনড্রোম শব্দটির বাংলা মিনিং করতে যান তবে তার সঠিক অর্থ দাঁড়াবে ‘প্রতারক ব্যাধি’। আমি জানি আপনার এই নামকরণ থেকে ধারণা স্পষ্ট হয় নি রোগের ধরনটা? আপনার হয়ত মনে হবে যাদের মনে মানুষ ঠকাবার প্রবণতা সব সময় আনা গোনা করে, তারা “প্রতারক ব্যাধি” তে আক্রান্ত হবে। কিন্তু যারা সফল, কোন রুপ প্রতারনা না করেই সফল হয়, তাদের মানষিক ব্যাধি কে কেন তথাকথিত প্রতারক ব্যাধি বা ইম্পোস্টার সিনড্রোম ফেলানো হবে? সেটাই স্বাভাবিক। নামকরণের প্রাসঙ্গিকতা বুঝতে এক্ষেত্রে একটু বিশদ আলোচনার প্রয়োজন।
১৯৭৮ সালে দুই মার্কিন মনস্তত্ববিদ সুজেন আইমেস এবং পলিন ক্লেন্স সর্বপ্রথম ‘ইমপোস্টার সিনড্রোম’ পরিভাষাটি ব্যবহার করেন। সুজেন আইমেস এবং পলিন ক্লেন্স ‘ইমপোস্টার সিনড্রোম’ শব্দটি ব্যাবহার করে মানুষের এমন এক অদ্ভুত ধরনের মনস্তাত্ত্বিক দন্দের কথা সবার সামনে আনেন যে এই দ্বন্দ্বে ভোগা একজন মানুষ নিজেকে নানান দিক থেকে অপকৃষ্ট বা ইনফেরিয়র ভাববে,হোক তা তার বিদ্যা, বুদ্ধি, অর্থ, মর্যাদা, খ্যাতি যে কোন কিছুতেই সেই মানুষ টি নিজের যোগ্যতা নিয়ে সারাক্ষণ হিনোম্মতায় ভুগতে থাকে, অথচ যেখানে কিনা সেই মানুষটি বলার মতো অনেক অর্জনই আছে।
আমার লেখা পুর্বের নিরীক্ষা ধর্মী ব্লগ পোষ্ট গুলো পরতে নিচের লিংক গুলতে ক্লিক করুন-
‘ইমপোস্টার সিনড্রোম’ এ ভোগা লোক জন প্রবল ভাবে যেমন উচ্চাকাঙ্ক্ষী হয়, সেই সাথে নিজের স্ব-আরোপিত দুর্বলতা নিয়ে সবসময় তাদের মন দ্বিধাগ্রস্ত থাকে। কীসের দ্বিধা? সেই চিরন্তন দ্বিধা। পাছে লোকে কিছু বলে! অন্যরা এই বুঝি দেখে নিলো, এই বুঝি জেনে নিলো, এই বুঝি ধরা পড়ে যাবো- এমন একটা ভয় তাদের সবসময় তাড়িয়ে বেড়ায়। এসময় তারা মনে করে, এই ইনফিরিয়রিটি কিংবা স্ব-আরোপিত দুর্বলতাগুলোই তাদের আসল রূপ, যেটাকে মেকি আত্মবিশ্বাস ও নানারকম ‘সৌভাগ্যপ্রসূত’ অর্জনের মুখোশে তাকে ঢেকে রেখেছে। আর শুধুমাত্র এই কারণে সেই মানুষট নিজেকে প্রতারক ভাবে, তার সব অর্জন তার সু প্রসন্ন ভাগ্য প্রতারনা করে অন্যদের থেকে তাকে সফল করেছে, এমন বিষয় নিয়ে তারা সব সময় হিনোম্মতায় ভোগে। তাদের মনে হতে থাকে প্রতিনিয়তই এই ‘প্রতারক’কে সবাই ‘চোখে চোখে রাখছে’; এবং শীঘ্রই সবাই তার ‘আসল’ রূপ সবাই জেনে যাবে। আর মানুষের এই ভাবনা টি যার প্রভাবে তৈরি হয় সেটিই হল “ইমপোস্টার সিনড্রোম”।
ইমেজ সোর্স – pinterest.com
ইমপোস্টার সিনড্রোমের কথা হচ্ছে, অনেক উচ্চ সফল ব্যক্তিরও একটি গোপন দিক থাকে। এত অর্জন থাকবার পরও তারা তারা আড়ালে আড়ালে মনে করেন, তাদের যত সফলতা, সবটাই হয়তো দৈবিকভাবে হয়ে যাচ্ছে। লোকে যখন তাকে সফল ভাবছে, তখন তার ভেতর ভেতর মনে হয়, ‘আমার কৃতিত্ব তো সামান্যই।’ এ দ্বন্দ্বের দরুন নিজেকে প্রতারকই মনে হয় বৈকি। আর প্রতারক মনে হলে ‘প্রতারণা’ ধরে পড়ে যাওয়ার ভয়ও থাকে। সব মিলিয়ে ইমপোস্টার সিনড্রোম মানেই এক বিতিকিচ্ছিরি মানসিক অবস্থা।
মানুষের আচরণের ধরনের ওপর ভিত্তি করে অনেক রকম ইমপোস্টার সিনড্রোম দেখা যায়। এই বিভিন্নতা সৃষ্টির কারণ মানুষের সামাজিক-পারিবারিক অবস্থা, ব্যক্তিত্ব ও পরিস্থিতির ওপর ভিত্তি করে হয়ে থাকে। মনরোগ বিশেষজ্ঞ ভ্যালারি ইয়ং ‘দ্য সিক্রেট থটস অফ সাক্সেসফুল উইমেন: হোয়াই ক্যাপাবল পিপল সাফার্স ফ্রম দ্য ইমপোস্টার সিনড্রোম এন্ড হাও টু থ্রাইভ ইন স্পাইট অব ইট’- নামক গ্রন্থে ইমপোস্টার সিনড্রোমের প্রভাবে ভোগা ব্যক্তির আচরণকে ৫ ভাগে ভাগ করেছেন।
উপরে উল্লেখিত এই পাঁচ ধরনের ব্যক্তিত্বের ক্ষেত্রে ইমপোস্টার সিনড্রোম প্রকাশের রূপও যায় বদলে।
মানুষের ব্যক্তিজীবনের সাফল্যের সাথে সরাসরি সংযুক্তি আছে এই সিনড্রোমের, তাই মানুষের কর্মজীবনের ভবিষ্যৎ সুন্দর হবার সাথেও ইমপোস্টার সিনড্রোম যোগ করা যায়। তাই মানুষের সুন্দর ভবিষ্যতের স্বার্থেই এই সিনড্রোম এর প্রভাব কাটিয়ে ওঠা প্রয়োজন।
ইমপোস্টার সিনড্রোমের ক্ষপ্পড়ে পড়লে আপনি সব সময় ভাবতে বাধ্য হবেন যে, আপনি অযোগ্য, অন্যরাই প্রকৃত যোগ্য, যারা আপনাকে ‘বিচার’ করছে। অর্থাৎ এখান থেকে বোঝা যাচ্ছে, আপনি মানসিকভাবে অন্যদের থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন। সুতরাং সকলের সাথে মিশুন। দারুণ কিছু বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে তুলুন কর্মক্ষেত্রে। তাতে করে আপনি তাদের সীমাবদ্ধতা জানতে পারবেন, মানসিক দূরত্ব কমে আসবে এবং নিজে আশ্বস্ত হবেন যে, আপনি যেমনটা ভাবছেন তেমন ‘অযোগ্য’ আপনি নন!
আপনি আপনার নিজের অর্জনকে ‘ছোট’ করে দেখছেন নিজেকে তার ‘যোগ্য’ মনে না করে। তার মানে এটা তো অবশ্যই মানেন যে, আপনি কিছু হলেও ‘অর্জন’ করেছেন? ব্যস, এই অর্জনগুলোর দিকেই ফোকাস করুন। কেননা বুদ্ধিমানেরা একটি গ্লাসকে অর্ধেক খালি দেখে না; অর্ধেক ভরা দেখে। নিজের সবথেকে বড় অনুপ্রেরণার আধার করুন নিজেকেই।
রমিজের আয়না নাটকের একটি দৃশ্য – ছবি – youtube.com
শিহাব শাহিন পরিচালিত রমিজের আয়না নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র রমিজ ( অভিনেতা প্রাণ রায়) একদিন নিজের ভাগ্য ফেরাতে এক জ্যোতিষের কাছে যায় । জ্যোতিষ রমিজের সাথে কথা বলে বুঝেছিলেন, রমিজের সমস্যাটি আসলে কোথায়? জ্যোতিষী রমিজকে তখন একটি আয়না দিয়েছিলেন। জ্যোতিষের কথা মত রমিজ রোজ ঐ আয়না দেখতো, আর পূর্ণ বিশ্বাস নিয়ে তার অফিসে যেতো। আয়নার প্রতি বিশ্বাসের জোরে রমিজের মনে আত্মবিশ্বাস ফিরে এসেছিলো, যার ফলে রমিজের ভাগ্য ফেরে। এর পর রমিজ জ্যোতিষের আবার কাছে গেলে রমিজকে জ্যোতিষ বলেন “এই আয়না আর তার/রমিজের কোনো প্রয়োজন নেই!” তখন রমিজও বুঝতে পারে যে, আয়না দেখে তার ভাগ্য ফেরেনি, রমিজের নিজের গুণের জন্যই তার ভাগ্য ফিরিয়েছিলো। নিজের সেই গুণ উপলব্ধি করুন। বিশ্বাস রাখুন, আপনি আগেও পেরেছেন, এবারও পারবেন; ভাগ্য নয়, নিজের গুণেই আগেও জিতেছেন, সামনেও জিতবেন।
আপনাকে আত্মসমালোচনাকে বন্ধ করতে বলা হচ্ছে না, শুধ বলা হচ্ছে, আপনি আপনার ভিতরে জন্ম নেওয়া সেই সমালোচনাকে কিছুটা উৎপাদনমুখী করুন। অর্থাৎ সমালোচকের মতোই সমালোচনা করে ‘খালাস’ হয়ে যাবেন না যেন! নিজের দুর্বল দিকগুলো খুঁজে বের করুন, দরকার হলে অন্যেরও সাহায্য নিন। শুধু নিজের খাদে পড়ে যাওয়া নিয়ে আফসোস বা সমালোচনা নয়, খাদ থেকে নিজেকে টেনে তুলবার জন্য আরেকটি হাত নিজেই বানান। নিজের ব্যাপারে খুব বেশি নিশ্চিত হয়ে দুর্বলতাকে স্থায়ী জ্ঞান করবেন না।
অন্যদের সাথে মিশুন, বন্ধু বানান, তাদের সাথে কথা বলুন,আড্ডা দিন, নিজের সত্তাকে বারবার আবিষ্কার করুন, নিজেকে চিনুন। অন্যান্য সফল ব্যক্তিরা সাফল্যকে কীভাবে গ্রহণ করেন, তা জানুন; ব্যর্থতা থেকে তারা কীভাবে উঠে দাঁড়ায়, তা-ও জানুন। ইমপোস্টার সিনড্রোম তো হয় নিজেকে ভাগ্যগুণে সাফল্য পাওয়া কোনো এক ‘অযোগ্য’ জ্ঞান করা থেকেই। সুতরাং আত্মসত্তার প্রশিক্ষণে নিজেকে অযোগ্য মনে হবার কারণগুলোকেই ঝেড়ে ফেলুন।
It’s a bangle article describe imposter syndrome. All the necessary references are hyperlinked within the article.
তথ্য সুত্রঃ
Leave a Reply