পরন্ত বিকেলে ঢাকার কোন রাস্তা দিয়ে এক মহিলা হেটে যাচ্ছেন, এমন সময় এক আততায়ী ছুড়ি নিয়ে মহিলার উপর হামলা করলো। মহিলাটি আহত হয়ে অসহায় ভাবে রাস্তায় পড়ে কাতরাচ্ছে। আর হামলাকারী? সে ছুটে পালিয়ে গেছে। এইরকম অবস্থায় থাকলে আপনি কি করতেন? নিশ্চিত ভাবেই বলা যায় আপনি মহিলাটিকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসতেন তাই না?
এবার একটু পিছনের একটা ঘটনায় ফিরে যাই, ১৯৬৪ সালের ১৩ মার্চ, ঠিক একইরকম এক ঘটনা কিটি জেনোভিস, এক মেয়ের সাথে ঘটেছিল । জেনোভিস নামের এক মেয়ের সাথে। মেয়েটি পেশায় ছিলেন একজন বারটেন্ডার। অত্যন্ত কাজ পাগল মেয়েটির স্বপ্ন ছিল বারটেন্ডারের কাজ করে অর্থ উপার্জন করে সেই টাকায় অতিসত্বর তিনি নিজের একটি ইটালিয়ান রেস্টুরেন্ট খুলবেন। আর তিনি সব গুছিয়ে ও এনেছিলেন। কিন্তু বিধিবাম, এক রাত্রে জেনেভিস তার কাজ শেষ করে বাসার দিকে ফিরছিলেন। ঠিক তার বাসার কাছাকাছি চলেও এসেছলেন ঠিক তখনি তিন লক্ষ্য করলেন একজন লোক জেনেভিস কে অনেকক্ষন ধরে অনুসরণ করছে। এবং হঠাৎ লোকটি হাতে চাকু নিয়ে ধেয়ে আসা শুরু করলে মিস জেনোভিস ভয়ে, আতংকে চিৎকার করতে করতে ঠিক তার বাসার কাছে পৌছালেন। এবং ঠিক সেই সময়েই হামলাকারী দৌড়াতে দৌড়াতে তাকে ধরে ছুরি দিয়ে দুইবার তাকে আঘাত করলেন।
এই সময় জেনোভিস সাহায্যের জন্য আর্তচিৎকার করে যাচ্ছিলেন। কিন্ত ঘটলো কি? আশেপাশে থাকা ৩৮ জন মানুষ তাকে নির্দয়ের মতো আহত হতে দেখলো। তাকে মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করতে দেখলো কিন্তু কেউ কিচ্ছু করলো না! কেও এগিয়ে আসলো না! একজন মানুষও না!
সাইকোলজি নিয়ে আমার লেখা পুরাতন পোস্ট গুলো পড়ে আসতে পারেন
আপনি হয়তো ভাবছেন একজন সাধারণ বোধ সম্পন্ন মানুষেরও তো একটু এগিয়ে আসার কথা, পুলিশকে ফোন দেয়ার কথা অথবা এম্বুলেন্সকে জানানোর কথা। কিন্তু না, বাস্তবে তেমনটা কিছুই ঘটেনি। অনেক পড়ে যখন মিস জেনোভিসকে হাসপাতাল নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল যাবার পথেই জেনেভিস মারা যায়। মিস জেনোভিসের মারা যাওয়ার পর অবশ্য একজন এই ঘটনার সাক্ষী প্রদান করেন। তবে ঐ ৩৮ জন মানুষের মধ্যে যদি একজন মানুষ ও জেনেভিস কে সাহায্য করতে এগিয়ে আসতো তবে হয়ত জেনেভিসের মৃত্যু হতো না। তাই প্রশ্ন রয়ে যায় কেন সেই লোক গুলো এগিয়ে আসে নি? জেনেভিসের এই মর্মান্তিক ঘটনায় প্রদর্শিত নির্মমতা এবং বিবেকহীনতা কে নিয়ে সূচনা করে এক নতুন গবেষণার এবং তৈরী করে আমাদের আজকেরআলোচনার বিষয় বস্তু যার নাম “বাইস্ট্যান্ডার ইফেক্ট” (Bystander Effect) এর ।
লেখাটিতে আরো যা জানতে পারবেন
বাইস্ট্যান্ডার ইফেক্ট (Bystander Effect) হচ্ছে এমন একটি মনঃস্তাত্ত্বিক ব্যাধি যেখানে এক বা একাধিক ব্যাক্তিগোষ্ঠীর উপস্থিতিতে কেউ ক্ষতির সম্মুখীন হলে সেই বৃহৎ জনগোষ্ঠীর উপস্থিতি থাকা স্বত্তেও কারো পদক্ষেপ নেওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে।
মডেল – শাকিলা – ছবি কালাক্ষর ডেক্স
কিটি জেনোভিসের হত্যার ঘটনার পর ১৯৬৮ সালে এবং ১৯৬৯ সালে “the diffusion of responsibility theory” থিওরী নামে বিভিন্ন গবেষণা চালানো হয়। মনোবিজ্ঞানের এই গবেষণা গুলোই আজকের “বাইস্ট্যান্ডার ইফেক্ট”(Bystander Effect) নামে সার্বজনীন ভাবেও পরিচিত। এই গবেষণা গুলোয় দেখা গিয়েছিলো অন্যের উপস্থিতি দায়বদ্ধতার অনুভূতি গুলোকে হ্রাস করে এবং ফলস্বরূপ সাহায্যের গতি উল্লেখযোগ্যভাবে বিলম্বিত হয়। তাই ঐদিনের ঘটনায় কোনো সাহায্য আসেনি মিস জেনোভিসের। জেনেভিসের আশেপাশের প্রতিবেশীরা ভাবছিল “আরে কেউ না কেউ হয়তো পুলিশে কল দিবে। আমি আমার আমার রাস্তা মাপি।”
জেনেভিসের সাথে ঘটে যাওয়া ঐ ঘটনার ৬০ বছর পর, এই সেলফোন আর সোশাল মিডিয়ার যুগে ও বাইস্ট্যান্ডার এফেক্ট বিলিন হয়নি? এত শত গন সচেতনার ক্যাম্পেইন চালানোর পরেও আজো শোনা যায় এমন শত শত ঘটনা ঘটে বাইস্ট্যান্ডার ইফেক্ট (Bystander Effect) এর। এমনই একটি ছোট্ট উদাহরণ দেখা যাক, গত বছর এফ আর টাওয়ারের ভয়াভহ অগ্নি দূর্ঘটনায় এই উল্লিখিত ছবি বেশ ভাইরাল হয়। যেখানে লক্ষ্য করা যায় কিছু জনগণ কর্তৃপক্ষকে সাহায্যর বদলে স্ক্রিনের পিছনে দূর্ঘটনাটি রেকর্ড করতেই যেনো বেশ উপভোগ করছেন। রাস্তায় কেউ এক্সিডেন্ট করে কাতরাচ্ছে আমরা সেই ছবি তুলে ফেসবুকে দেই কিন্তু কেউ লোক টিকে তুলে হাসপাতালে নিয়ে যাই না, ঢাকার রাস্তাঘাটে দিনে দুপুরে ছিনতাই এবং রাস্তাঘাটে অথবা বাসে যৌন হয়রানির মতো ঘটনা গুলি প্রায়শই শোনা যায়। এখানে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে এই সব ঘটনার অনেক প্রত্যক্ষদর্শী থাকলেও কেউ এগিয়ে আসার সাহস দেখায় না। দুঃখের বিষয়, এগুলি আধুনিক সময়ে বাইস্ট্যান্ডার ইফেক্ট (Bystander Effect) এর বহিঃপ্রকাশের ভয়াভহ কিছু উদাহারণ।
এই বিব্রতকর পরিস্থিতি কে কাটিয়ে উঠার উপায় হিসেবে গবেষকরা বেশ কিছু গবেষণালব্ধ উপায় নিয়ে বিভিন্ন সময়ে হাজির হয়েছেন। তার মধ্যে বেশ উল্লেখযোগ্য গুলো হচ্ছেঃ
১. যদি অনেক লোক জনের ভেতর কোন ভুক্তভোগী একা হয় সেক্ষেত্রে ভীড়ের মধ্যে থেকে ভুক্তভুগির যেকোনো একজন মানুষ কে আলাদা করা উচিৎ এবং তার সাথে চোখে চোখ মিলিয়ে মুখ ফুটে তার সাহায্য চাওয়া উচিৎ। এতে ভুক্তভোগীর সাহায্য পাবার সম্ভাবনাকে অনেক বেড়ে যায়।
২. আপনার সামনে এমন ঘটনা ঘটলে সবার আগে আপনি নিজে সাহায্য করতে এগিয়ে আসুন এবং অপরকেও সাহায্য করতে অনুপ্রাণিত করুন। গবেষকরা বের করেছেন কোন মানুষ কোনো ভালো কাজ করতে এগিয়ে আসলে তার দেখা দেখি অন্য মানুষকেও ভাল কিছু করার জন্য অনুপ্রাণিত করে।
৩. বাইরে গেলে আপনার চোখ কান খোলা রাখা খুবই জরুরী। অনেক সময় আমাদের বেখেয়ালি আচরণই আমাদের বিপদের দিকে ঠেলে দেয়। আশেপাশের অবস্থা সম্পর্কে ধারণা রাখা এবং সর্তকতা অবলম্বন করলে সম্পুর্নভাবে অপরের উপর নির্ভরশীল হতে হয় না।
৪. নতুন সম্পর্কের সৃষ্টি করা যেতে পারে। আমরা সাধারণত মানুষ হিসেবে পরিচিত মানুষের সাহায্যে এগিয়ে আসতে বেশ পচ্ছন্দ করি। তাই যেখানেই অবস্থান করি না কেন আশেপাশে থাকা লোকজনদের সাথে টুকটাক কথা বলা উচিত। এতে একদম অচেনা-অজানা থেকে একটু পরিচিত হলেও লাভ।
৫. একজন সচেতন মানুষ হিসেবে ইমার্জেন্সি বিভিন্ন সময়ে কি প্রস্তুতি নেওয়া উচিত সেগুলো সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকা উচিত। যেমন আগুন লেগে গেলে কি করা অথবা ভুমিকম্প এলে, বিভিন্ন দূর্ঘটনা কবলিত হলে প্রাথমিকভাবে কি করা দরকার তা সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখা আমাদের প্রত্যেক মানুষেরই কাম্য। এছাড়া বিপদে আপদে প্রাথমিক চিকিৎসার সম্পর্কে ধারণা রাখাও এর অন্তর্ভুক্ত।
৬. নিজেকে সবসময় একজন ভালো মানুষ হিসেবে ভাবা। পজিটিভলি চিন্তা করা। ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে যে, “ফিল গুড, ডু গুড” অর্থাৎ আপনি যদি ভালো অনুভব করেন তবেই আপনি অপরের ভালো করতে চাইবেন।
আমার এই লেখাটি পড়ে আশা করি আপনারা সবাই “বাইস্ট্যান্ডার ইফেক্ট” (Bystander Effect) সম্পর্কে অবহিত হবেন। আপনার পাশে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত কোন ঘটনা ঘটলে নিজে অপরের সাহায্যের জন্য সবসময় মুখিয়ে থাকবেন। অপরকে সাহায্যের হাত বাড়ানোই হোক আপনার জীবন চলার অন্যতম নীতি।
This is a Bangla article about bystander effect.
তথ্যসূত্রঃ
Leave a Reply