কয়েক দিন আগের ঘটনা। হাতে কাজ কর্ম নেই বেকার বসে থাকতে থাকতে ভাল লাগছে না তাই গুলশানে এক আপুর বাসায় গিয়েছিলাম আড্ডা মারতে। আর যে হুতু আড্ডা মারবো তো মোটামুটি গুলশানের ঐ দিক যে কয়জন পরিচিত আছে সবাইকে আসতে বললাম। কারো কাজ কারো অফিস আবার কেউ সংসারের ঘানি টানতে টানতে মহা ব্যাস্ত। তাই দেখা গেল দুই জন ছাড়া কেঊ ই আসলো না। এই দিক কার্ড খেলতে ও চার জন মানুষ লাগে। তখন সেই দুই জনের এক জন পরিচিত কে আসতে বলা হয়েছিল। যথারিতি তিনি আসলেন। আলাপ হল। মোটামুটি ভালই মনে হয়েছিল কিন্তু আমার আর এক ফ্রেন্ড তাকে ভাল ভাবে ন্যায় নাই। কথার মাঝে তো সে আমায় একটু দূরে ডেকে নিয়ে কানে মানে বলেই দিল যে ঐ পোলাতো ইয়াবা খোর মানে ছেলেটি ইয়াবা খায়।
এই কথা শুনে আমার তো টাস্কি খাওয়ার জোগার। কারণ প্রথমত আমি শৌখিন মদ খোর হলেও এক মাত্র সিগারেট ছাড়া অন্য কোন নেশাদ্রব্য ই নয় এর সাথে সংশ্লিষ্ট লোক জন কেও পারত পক্ষে এডিয়ে চলি। তখন আমি সেই বন্ধুকে প্রশ্ন করেছিলাম কি ভাবে বুঝলা সে ইয়াবা খায়? উত্তর যা দিল তা হল সে ঘন ঘন দাত কামড়াচ্ছে। আর ইয়াবা খোর দের নাকি এইটা কমন সমস্যা। বিষয়টি আমার জানা ছিল না। যাই হউক তাঁর এই কথা শুনে আমার কিন্তু অন্য একটা ভাবনা মাথায় চলে এসেছে। আর তা হল, এক সময় আমি ক্রিকেট খেলাতাম। আমার প্রিয় পেজ বলার ছিল কার্টনী ওয়ালস। তো তিনি মাঝে মাঝেই দাতের উপর দাত রেখে চাপ দিত। আর আমি তাকে এতটা অনুসরণ করতাম যে আমিও দাতের উপর দাত রেখে চাবাইতাম। আর বিষয়টি এক সময় এত বেশি করতাম যে আমার অভ্যাসে পরিনিত হয়ে যায়। আর যত দিন ক্রিকেট খেলাম ততদিন এই অভ্যাস আমার খুব ভাল ভাবেই নিজের ভিতর ছিল। যাই হোক সেই দিনের আড্ডাবাজি শেষ করে এই দাত কামড়াবার বিষয় টি অনেক বার ই মনে হয়েছে। আর এক সময় বিষয় টি নিয়ে ঘাটাঘাটি করতে করে যা অভিজ্ঞতা হয়েছে তা আপনাদের সাথে শেয়ার করতে সৃজনশীল ব্লগ “কালাক্ষর” এ আজকে লিখতে বসলাম।
দাত কামড়ানো এরর বিষয় নিয়ে লেখার শুরুতে আপনাদের বোঝার সার্থে আয়ান নামের ছয় বছর বয়সি একটি ছেলের ঘটনা আজ আপনাদের বর্ননা করবো । আয়ান বাবা-মায়ের কনিষ্ঠ সন্তান, তাই যত্ন অাত্তির কোনো কমতি নেই। সমবয়সী অন্যান্য শিশুদের তুলনায় সে অনেক শান্তশিষ্ট এবং চুপচাপও থাকে। একদিন রাতে শোবার সময় আয়ানের মা খেয়াল করল, ঘুমের ঘোরে আয়ান দাঁত কিড়মিড় করে। আয়ানের মা প্রথমে ভেবেছিল, হয়তো আয়ান কোনো দুঃস্বপ্ন দেখে এমন দাঁত কিড়মিড়ি করতেছে। আর তাই তিনি ব্যাপারটিকে খুব একটা পাত্তা দেন নি।
কিন্তু যত দিন যেতে লাগলো আয়ানের এই দাত কিড়মিড় করার সমস্যা দিন দিন আরো জটিল এবং প্রকট আকার ধারণ করতে লাগলো। আয়ানের জোরে দাঁত ঘষার অভ্যাস তো গেলই না, উল্টো আরো তীব্র আকার ধারণ করলো। জোরে দাঁত ঘষার শব্দের জ্বালায় আয়ানের পাশে কেউ ঘুমুতেই চায় না। এর কিছুদিন পর দেখা গেলো, আয়ানের উপরের চোয়ালের দাঁতগুলো সব ক্ষয়ে গেছে। আয়ান মুখ ও চোয়ালে প্রচন্ড ব্যথা অনুভব করার কারণে আয়ান কোনো খাবারই মুখে তুলে খেতে পারছে না।
তখন আয়ানের বাবা-মা ভাবলেন বোধহয় তাদের ছেলের পেটে কৃমি হয়েছে, তাই সে এরকম করছে। তারা তাকে কৃমিনাশক ওষুধ খাওয়াতে শুরু করলেন। কিন্তু কোনো উপকার হলো না। অগত্যা তারা সন্তানকে নিয়ে একজন শিশু বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হলেন। তিনি নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানালেন, তাদের ছেলে আয়ান এক ধরণের বিশেষ ব্যাধিতে ভুগছে, যার নাম ব্রুকসিজম ।
আমাদের সবারই কম-বেশি দাঁত কামড়ানোর অভ্যাস রয়েছে এই কথা টি আপনারকে কেউ যদি বলে আপনি হয়ত হেসেই উড়িয়ে দিতে পারেন, তবে কথা ১০০% সত্য। খেয়াল করে দেখবেন আমরা যখন রাগান্বিত বা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত অবস্থায় থাকি, তখন অবচেতন মনে আমরা অনেকেই দাঁত কামড়াই। বিষয়টিকে খুব সাধারণ বিষয় বলে মনে করতে পারেন। তবে এটিও কিন্তু একটি রোগ। চিকিৎসাবিজ্ঞানের পরিভাষায় যাকে ব্রুকসিজম বলে। খুব অল্প হলে এই রোগ তেমন কোনো ক্ষতির কারণ হিসেবে প্রকাশ পায় না। কিন্তু যদি এটি প্রকট আকারে প্রকাশ পায় বা কারো অনবরত বা মাত্রাতিরিক্ত দাঁত কামড়ানোর অভ্যাস হয়ে যায় তবে এ অবস্থা থেকে সেই মানুষের চোয়ালের সমস্যা, মাথা ব্যথা, দাঁতের ক্ষয় এবং অন্যান্য সমস্যা দেখা দিতে দেখা যায়। যাকে বলে ব্রুকসিজম।
যাদের ভিতর ঘুমের মধ্যে দাঁত কামড়ানোর অভ্যাস থাকে, সেই রোগটিকে স্লিপ ব্রুকসিজম নামে ডাকা হয়। মজার ব্যাপার হল,শিশুদের ভিতর যারা ঘুমের মধ্যে দাঁত কামড়ায় তখন অনেক অভিভাবকই চিকিৎসকের কাছে এসে বলেন তাদের বাচ্চার পেটে কৃমি হয়েছে। আবার অনেকেই আছেন তাদের বাচ্চাদের দাত কামড়ানি দেখলে চিকিৎসকের কাছে যায় ই না। নিজেরাই ডাক্তারের ভূমিকায় অবতির্ন হয়ে তাদের বাচ্চাদের কৃমিনাশক সেবন করিয়ে থাকেন। কিন্তু সত্য কথা হল দাঁত কামড়ানোর সঙ্গে পেটে কৃমি থাকার কোনো ধরনের সম্পর্কই নেই।
বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে মরিৎজ ক্যারলি নামের ইতালির অন্তর্গত ভিয়েনা শহরের এক দন্তবিদ ব্রুকসিজম নামক রোগ টি সবার গোচরে নিয়ে আসেন। যদিও জনাব মরিৎজ ক্যারলি এই রোগটিকে ট্রমাটিক নিউরালজিয়া নামে সবার সাথে পরিচিত করান এবং একে পেরিওডন্টাইটিস রোগের অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন।
তবে ১৯০৭ সালে মেরি পিয়েতকেউইজ “La bruxomanie” শব্দটি প্রচলন করেন। ১৯৩১ সালে বারট্রান্ড ফ্রম্যান ব্রুকসিজম শব্দটি উদ্ভাবন করেন। অনেকের ধারণা, ব্রুকসিজম শব্দটি এসেছে গ্রিক প্রতিশব্দ ‘brychien odontas’ থেকে,যার বাংলা অর্থ দাঁড়ায়, দাঁত চিবিয়ে কথা বলা।
বিখ্যাত মনোবিদ সিগমুন্ড ফ্রয়েড দাত কামড়ানো রোগের কারণ হিসেবে বলেন, ব্রুকসিজমের সাথে মানুষের মনোদৈহিক বিকাশের গভীর সংযোগ বিদ্যামান।
মানুষের এই দাত কামড়ানো রোগ বা ব্রুকসিজম কে দু’ভাগে ভাগ করা হয়।
১. প্রাইমারি (ইডিওপ্যাথিক) ব্রুকসিজম: যখন মানুষের দাঁত কামড়ানোর পেছনে তাঁর দেহের স্নায়ুবিক ও শারীরবৃত্তীয় কারণ (যেমন: রোগ, মানসিক ব্যাধি, জীবাণুর সংক্রমণ) গুলো জড়িত থাকে।
২. সেকেন্ডারি (ইরাটোজেনিক) ব্রুকসিজম: কোন মানুষের দাঁত কামড়ানোর পেছনে কোনো পরিবেশগত কারণ গুলো (যেমন: ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, মাদকদ্রব্য, দূষণ) জড়িত থাকে।
এখন এই প্রাইমারি ব্রুকসিজমকে অাবার দু’ভাগে ভাগ করা যায়।
কোন মানুষের দাত কামড়ানো রোগ বা ব্রুকসিজম হওয়ার পেছনে বেশ কিছু কারণ কাজ করে।
মাদকদ্রব্য: ক্যাফেইন, টোবাকো, কোকেন, এম্ফিটামিন বা ইয়াবা ট্যাবলেট সেবনের কারণে ব্রুকসিজম হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
(i) বিভিন্ন শারীরিক রোগ যেমন: পারকিনসন্স ডিজিজ, হান্টিংটন ডিজিজ, স্লিপ অ্যাপানিয়া, ডাউন সিনড্রোম।
(ii) মানসিক ব্যধি যেমন: মৃগী, ডিমেনশিয়া, ডিপ্রেশন, অ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপার-অ্যাক্টিভিটি ডিজঅর্ডার, অবসেসিভ-কম্পালসিভ ডিজঅর্ডার- এ সকল রোগের জটিলতা হিসেবে ব্রুকসিজম হতে পারে। এক গবেষণায় দেখা যায়, সেরেব্রাল পালসি রোগাক্রান্ত শিশুরা অন্যদের তুলনায় অধিক দাঁত কামড়ায়।
ব্রুকসিজম হলে নিম্নলিখিত জটিলতাগুলো দেখা দিতে পারে।
এর চিকিৎসা পদ্ধতি ৩ ভাগে বিভক্ত।
ওষুধ এক্ষেত্রে খুব একটা ভালো কাজ করে না। তবে পেশীতে ব্যথা হলে ব্যথা নিরাময়ের ওষুধ বা খুব শক্ত হয়ে গেলে ইনজেকশন দেওয়া হয়।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবন করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিতে পারে। রোগীর অবস্থাভেদে মানসিক চাপ মুক্ত করার জন্য কিছু অ্যান্টিডিপ্রেসেন্ট অথবা ঘুমের ওষুধ প্রয়োগ করার প্রয়োজন হতে পারে। তবে একটি জিনিস খেয়াল রাখতে হবে যে, সব রোগীর জন্য একই ওষুধ প্রয়োগ করা যায় না, যদিও রোগের ধরন একই। তাই ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া চিকিৎসা গ্রহণ করবে না।
শিশুদের ক্ষেত্রে ৫-৬ বছর বয়সে ব্রুকসিজম বা দাঁত কামড়ানোর অভ্যাস দেখা যেতে পারে। সাধারণত ১০ বছর বয়সের মধ্যে ভালো হয়ে যায়।
Leave a Reply