আহা ভাবনারে কী হাওয়ায় মাতালো, দোলে মন দোলে অকারণ হরষে/ হৃদয়গগনে সজল ঘন নবীন মেঘে রসের ধারা বরষে ’…রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মানুষের প্রেমের অনুভূতি নিয়ে হৃদয়চেরা ভাবনা লিখেছিলেন । যে প্রেম মনে দোলা না দেয় সে প্রেম প্রেম নয় অন্য কিছু। রোমান্টিসিজম মুখের ভাষায় নয় মনের ভাবনাতেই ফুটে ওঠে যাকে আমরা প্রেম বলি। কিন্তু কোন মানুষের মনে এই ভাবনাটাই যদি না থাকে? প্রেমে পড়ার ফিলিংস যদি কাজ না করে? তবে? তবে আর কি সে অ্যারোমান্টিক (Aromantic) । অ্যারোমান্টিক? হয়ত বলবেন এই অ্যারোমান্টিক (Aromantic) টা আবার কি? প্রেম আছে অথচ এই অনুভূতি নেই, মনের এমনই এক বিচিত্র অবস্থা নিয়ে আমাদের চার পাশে বহু মানুষ বাস করেন। মনোবিজ্ঞানীরা সেই সব ইমোশন হিন মানুষের মনের অবস্থা বোঝাতে অ্যারোমান্টিক (Aromantic) শব্দ টি ব্যাবহার করে থাকেন।
রিমি তার দশ বছর বয়সে প্রথম অনুভব করেছিল রিমি বাকি বন্ধুদের থেকে অনেকটাই আলাদা। তার মনের অনুভূতিগুলো স্বাভাবিক নয় ববং একটু ভিন্ন পথে দৌড়য়। তার মানে রিমির মনে ভালবাসা, সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না নেই তা নয়। তার সবই আছে। কিন্ত যে একটু আলাদা। কিন্তু এই আলাদাটা যে কী, সেটা বছর দশেকের মেয়ে রিমি তা বুঝতে পারেনি। এই অন্যরকম অনুভূতির সঙ্গে পরিচয় হয় যখন রিমি কিশোরী থেকে তরুণী হয়। অন্য সবার মত রিমির জীবনেও প্রেম আসে, এক জনের সাথে সম্পর্ক তৈরি হয় তার। কিন্তু সচারাচর প্রেমের ফিলিং এর মত সেই যে ফুলের মতো নরম ভালবাসা, সঙ্গির প্রতি মনের টান, বুকের বাম পাশের ধুকধুকানি,আপনজনকে জড়িয়ে আঁকড়ে ধরে সেই যে শিরশিরানি অনুভূতি, অথবা ভালবাসার ছোঁয়ায় ভেতর থেকে উঠে আসা মৃদু কম্পন,কিংবা সঙ্গীকে নিয়ে দুরন্ত হাওয়ায় ভেসে যাওয়ার বাসনা, সে সব কোথায়? রিমি মনে কিছুই টের পায় না। সবই যেন যান্ত্রিক, গতানুগতিকতায় এগিয়ে চলা একটা শীতল সম্পর্ক। তাতে প্রাণ আছে কিন্তু উদ্দামতার জোয়ার নেই। রিমির বয়স যখন ৪৬ বছর, সে মনোবিজ্ঞানীর কাছে গিয়ে জানতে পারেন তিনি অ্যারোমান্টিক (Aromantic) ।
অর্থাৎ যাঁর মধ্যে রোমান্টিসিজমই নেই। তার মানে এই নয় যে রিমি কঠিন, নিষ্ঠুর একটা মানুষ। তেমনটা নয়। রিমি ভালবাসতে জানেন। কিন্তু সঙ্গীর প্রতি যে রোমান্টিক অনুভূতি, সেই যে প্রেমের দোলা, তেমনটা অনুভব করতে পারেননা কিছুতেই। প্রেম থাকলেও তাকে মনে, আত্মায়, শিরায়-উপশিরায় মেখে নিয়ে তার গন্ধ বোঝার ক্ষমতা নেই রিমির। তাই রিমি অ্যারোমান্টিক (Aromantic) ।
রোমান্টিসিজম শব্দটি মানুষের আপন মনের ভাবনার সাথে সম্পর্কিত । রোমান্স মানেই মানব মনের একটা চনমনে মন, দুষ্টুমিষ্টি মাখা অনুভূতি। এই অনুভুতি গুলোর কিছুটা খোলা আয়নার মতো, কিছুটা গোপনে নিষিদ্ধ ভাবনার পাতায় লিখে রাখা কিছু অস্পষ্ট শব্দের মতো। যার ভাষা একমাত্র প্রেমিক মনই বোঝে।
তবে অ্যারোমান্টিক (Aromantic) শব্দটি নিছকই কৌতুক করে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। অর্থাৎ যার মনে প্রেমের প্রকাশ তেমন একটা নেই, রূপকথার মতো করে অনুভূতির দরজা খুলে যে দিতে পারে না, তাদেরকেই অ্যারোমান্টিক (Aromantic) বলে দাগিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু ব্যাপারটা মোটেও তা নয়। এই অ্যারোমান্টিক হল মনের এমন এক বিচিত্র অবস্থা যেখানে মানুষের মনের ভাবনাগুলো বিভিন্ন কুঠুরিতে আলাদা আলাদা করে বন্দি থাকে। বাবা,মা, ভাই-বোন, বন্ধু, আত্মীয়দের প্রতি ভালবাসা আছে। আবেগও আছে কিন্তু ওই রোমান্টিক ভাবনাটাই নেই। যৌন আকর্ষণ যে নেই সেটা জোর দিয়ে বলা যায়।
মডেল – সামিয়া শিকদার। ছবি – কালাক্ষর ডেক্স
মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, অ্যারোমান্টিক (Aromantic) রা যৌন সম্পর্ক উপভোগ করেন কিন্তু তাতে ফিলিংস নয় যান্ত্রিকতাই বেশি থাকে। আবার অনেকের সেই অনুভূতিও থাকে না। সঙ্গীর ছোঁয়ায় কোনও শিহরণ জাগে না। মানুষের মন বড় বিচিত্র। বড়ই জটিল। তার গভীরতা মাপা প্রায় অসম্ভব। তাই রোমান্টিক ও অ্যারোমান্টিক (Aromantic) মানুষদের মধ্যে ফারাক করা যায়না অনেক সময়েই। এমনকি অ্যারোমান্টিকরা নিজেরাও বুঝতে পারেন না তাঁরা মনের কোনও অবস্থার মধ্যে রয়েছেন। স্বাভাবিক, ব্যস্ত জীবনে, সেডেন্টারি লাইফস্টাইলের কারণে রোমান্টিক অনুভূতি হারিয়ে যাচ্ছে নাকি শুরু থেকে তাঁরা এমনই ছিলেন। ভাবনার বিকাশটা এতদিন পরে হয়েছে। এবার আসা যাক বিজ্ঞানের তথ্যে। প্রেম কতটা এবং ঠিক কেমন তাকে রোমান্টিক ওরিয়েন্টেশন (Romantic Orientation) দিয়ে ব্যাখ্যা করে থাকেন গবেষকরা। একে অ্যাফেকশনাল ওরিয়েন্টেশন (Affectional Oriention) বলে।
রোমান্টিসিজমের উপর নির্ভর করে মানুষের মনের মতিগতি বোঝা হয় এই রোমান্টিক ওরিয়েন্টেশন দিয়ে। অর্থাৎ লিঙ্গভেদে মানুষের আচরণ কেমন, কোন লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ জন্মাচ্ছে, যৌন আকর্ষণ রয়েছে কিনা, সেটা আবার সেক্সুয়াল ওরিয়েন্টেশন দিয়ে ব্যাখ্যা করা হয়।
আধুনিক বিজ্ঞান বলছে, রোমান্টিসিজমের অনেক ভাগ আছে। অ্যারোমান্টিক অর্থাৎ যাদের সঙ্গীর প্রতি বিশেষ আকর্ষণই নেই। যৌন ইচ্ছা থাকতেও পারে আবার নাও থাকতে পারে। সেটা নির্ভর করে। হেটারো-রোমান্টিক (Heteroromantic) যাদের রোমান্টিক ভাবনা বা আকর্ষণ থাকে বিপরীত লিঙ্গের প্রতিই। হোমো-রোমান্টিকরা (Homoromantic) একই লিঙ্গে আকর্ষণ অনুভব করেন। আবার এর বিপরীত বাইরোমান্টিক (Biromantic) যাঁরা উভয় লিঙ্কের প্রতিই আকর্ষণ অনুভূ করেন। এই বাইরোমান্টিকদেরই একটা ভাগ হল প্যানরোমান্টিক (Panromantic) যাঁরা যে কোনও কারও উপরেই আকর্ষণ অনুভব করতে পারেন, নারী বা পুরুষ বলে আলাদা লিঙ্গ ভাগ করেন না। মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, অ্যারোমান্টিকরা যে জীবনে অখুশী হন তেমনটা নয়। অনেককেই দেখা গেছে সুখী সম্পর্কে রয়েছেন। অথচ তাঁরা নিজেরা বলেন যে, রোমান্সের বিশেষ মুহূর্তেও কোনও আলাদা অনুভূতি আসে না তাঁদের। ভালবাসায় টান পড়ে না তাতে, তবে প্রেমের সময় মন যে রূপকথার নেশায় ভাসতে চায় সেই অনুভূতিটা শুধু থাকে না। এই অ্যারোমান্টিকরা আবার কিছু ক্ষেত্রে রোমান্টিক হয়ে উঠতে পারেন। সেটাও মনের একটা বিচিত্র অবস্থা।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, এই অনুভূতিটা দেখা গেছে ডেমিরোমান্টিক (Demiromantic) বা গ্রেরোমান্টিকদের (Greyromantic) ক্ষেত্রে। ডেমিরোমান্টিকরা তখনই রোমান্টিক হতে পারেন যখন তাঁরা সম্পর্কে গভীরভাবে জড়িয়ে পড়েন। অথবা সঙ্গীর সঙ্গে মনের টান তৈরি হয়। নিরাপত্তাহীনতা থাকে না। গ্রেরোমান্টিকরা আবার কোনও বিশেষ মুহূর্তেই রোমান্টিক হতে পারেন। সেটা পরিবেশ, পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে। এই ভাবনাটা তাঁদের হঠাৎ করেই আসে আবার আচমকাই চলে যায়। অ্যারোমান্টিক (Aromantic) মানেই যে সে ব্যাক্তি অ্যাসেক্সুয়াল হবে তেমনটা নাও হতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, অ্যারোমান্টিক (Aromantic) রা মনের অনুভূতির বিকাশ না হলেও সুস্থ, যৌন সম্পর্কে থাকতে পারেন । তবে সেক্ষেত্রে হয়ত তাঁদের শরীরের চাহিদা থাকে, কিন্তু মনের টান একেবারেই থাকে না।
Leave a Reply