কালাক্ষর ডেক্সঃ- মুড সুইং কি? এই বিষয়ে জানতে আমার নিজের একটা ঘটনার বর্ণনা দেই। কিছুদিন আগে আমি বিছানায় বসে ফোন গুতাচ্ছিলাম। কোন জরুরী কাজ ছিল না। তাই আজাইরা ফেসবুকিং করে সময় পার করা আর কি। এমন সময় আমার সহকারি (এসিস্টেন্ট ডিরেক্টর) আমাকে সুটিং পারপাস কি যেন একটা বলতে এসেছিল। আমি কোন কারণ ছাড়া অযথাই রিএক্ট করে বসেছিলাম ছেলেটার উপর।এরকম আরো অনেকবার হয়েছে আমার সাথে। কেবল মাত্র আমার সহকারীদের উপর ই নয়, অনেক সময় আমার অধীনস্থ কিংবা উচ্চপদস্থ অনেক গুরুত্বপূর্ন অনেকের সাথেই কারণ ছাড়াই আমি তর্কে জড়িয়ে পড়েছি। বিশেষ করে কিছু কিছু সময় আমার আশেপাশে কাউকেই ভাল লাগেনা। তখন এই স্বভাবটা আমার ভিতর বেশ ভাল ভাবেই ভর করে। তাই বিষয়টা নিয়ে সেদিন একটু গভীরে ভাবছিলাম।ঠিক তখনই আমার মাথায় এই নচ্ছার স্বভাব নিয়ে একটা প্রশ্ন তৈরী হয়। আচ্ছা এইটা মুড সুইং (mood swings) নয় তো? তখন ই মাথায় এই নিয়ে একটা আর্টিকেল লেখার কথা মাথায় এলো – সৃজনশিল ব্লগ কালাক্ষর এ আজকের পোস্ট মর্টেম এর নাম মুড সুইং –
কোনো কারণ ছাড়াই কোন মানুষের মেজাজের চটজলদি নাটকীয় পরিবর্তন হওয়াকে ‘মুড সুইং’ বলে। হঠাৎ করে কোন মানুষের মন খারাপ হয়ে যাওয়া, রাগ হওয়া,আবার অনুষুচনায় কান্না পাওয়া আবার কোন কারন ছাড়াই হুট করেই মনে উৎফুল্লভাব বা আনন্দ অনুভব করার মতো অনুভূতি হতে পারে । মুড সুইং মুলত মানব শরীরে লৌহ,ভিটামিন ও খনিজের অভাব,পুষ্টিহীনতা এবং হরমোনের চেঞ্জ যা মেয়েদের ইমোশনাল ব্রেকডাউন সৃষ্টি করে ফলে অপ্রত্যাশিত দ্রুত মেজাজের দ্রুত ওঠা-নামা করে ।
মুড সুইং নারী পুরুষ দুই ধরনের মানুষের ভিতরেই হতে পারে – তবে এর প্রভাব বেশি দেখা যায় মেয়েদের ক্ষেত্রে কারন -“মেয়েদের পিরিয়ডের সময় শরীর থেকে প্রচুর আয়রনের ক্ষয় হয়। পরে তা পূরণ না করায় ধীরে ধীরে ‘মুড সুইং’য়ের দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা দেখা দেয়।”
মডেল- পায়েল। ছবি কালাক্ষর ডেক্স
বাংলাদেশে এমন খুব কম সংখ্যক ছেলে আছে যারা মেয়েদের মুড সুইং এর ব্যাপারে জানে অথবা জেনেও গুরুত্ব দেয়! আগে না বুঝলেও এখন বুঝতে পারছি এই ব্যাপারটা একটা অভিশাপ।আপনি যদি কখনো দেখেন আপনার মা, বোন, বান্ধবী, প্রেমিকা, স্ত্রী কিংবা কন্যা অকারনে ইমোশনাল হচ্ছে, অযথা রাগ করছে, কাঁদছে, চিৎকার করছে, ফ্রাস্ট্রেটেড হয়ে যাচ্ছে তখন প্লিজ তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হোন! কারন হরমোনাল ইমব্যালেন্স, মেন্সট্রুয়াল সাইকেল সহ বিভিন্ন কারণে বেশিরভাগ মেয়ে মুড সুইং এ ভোগে।
হঠাৎ হঠাৎ তাদের বিহেভ পাল্টে যায়। ওভার রিঅ্যাক্ট করে। আমরা মেয়েটাকে সাইকো বলি। কিন্তু মেয়েটা আসলে সাইকো না। আবেগ, মায়া মমতায় ভরা একটা মানুষ সে। মুড সুইং-এ ভোগা মেয়েগুলো পৃথিবীর সবচেয়ে অসহায় প্রাণী। ওরা নিজের সাথে যুদ্ধ করে আপনার আমার সাথে নরমাল বিহেভ করতে চায়। কিন্তু তা মাঝেমধ্যে পেরে উঠেনা। ওভার রিঅ্যাক্ট করে ফেলে। ওরা ইচ্ছা করে এমনটা করেনা। ওদের শরীরে বিভিন্ন প্রকার হরমোনের প্রভাবে ওরা এমন করে। হয়তো সে নিজেও জানে না কিভাবে নিজের মুড সুইং কে হ্যান্ডেল করতে হয়-
ওদের এই মুড সুইং টা বেশিভাগ ক্ষেত্রে তার প্রিয় মানুষগুলার সাথে হয়। এই দেখছেন ও খুব হাসি খুশিই আছে কিন্তু হঠাৎ খেয়াল করে দেখলেন সে অন্যরকম বিহেভ করছে। হতে পারে সে আপনার কাছ থেকে মনে মনে কিছু চাইতেছে, কিন্তু সেটা প্রকাশ করতে পারছেনা, ও চায় আপনি বুঝুন তাকে কিন্তু যখন দেখে তার কাছের প্রিয় মানুষটা তার চাওয়াটা পূরণ করবে তো দূরে থাক বুঝতেই পারেনি সে কি চায় তখন সে নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারে না, সেই আশা পূরণ না হওয়ার কারণে নিমিষেই সে পাল্টে যায়। পরে ফেলে আপনার সাথে ওভার রিঅ্যাক্ট।
সাইকোলজি নিয়ে আমার লেখা পুরাতন পোস্ট গুলো পড়ে আসতে পারেন
আবার কিছুক্ষণ পরেই সে ঠিক হয়ে যায় কিন্তু আপনি তার মুড সুইং এর ব্যাপারটা ধরতে পারেন নি বলে তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে আপনিও করে ফেলেন মিসবিহেভ কিংবা তাকে এড়িয়ে চলেন এতে করে সেই মুড সুইং হওয়া মেয়েটি আস্তে আস্তে সবার থেকে গুটিয়ে নেয় নিজেকে।তাদের কে ন্যাকা, এইমলেস বলে রূঢ় আচরণ না করে বরং এমন একজন হোন যার কাঁধে মাথা রেখে কাঁদা যায়! যার কাছে মন খুলে কিছু কথা বলা যায়! যখন ওদের সবকিছু ভুল মনে হতে থাকে,,, নিজেকেই নিজের আর সহ্য না হয়,,, সবকিছু অর্থহীন মনে হতে থাকে,,, তখন চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করে; বিশ্বাস করেন,, ঐ মুহূর্তে স্রেফ একজন শোনার মানুষের দরকার হয়,,যে কিনা খুব মনোযোগ দিয়ে ভীষণ অগোছালো আর অর্থহীন কথাগুলো কেবলই শুনে যাবে! হয়তো কথা গুলো বলে সে নিজেকে হাল্কা অনুভব করবে।
বাঙালিরা মুড সুয়িং কে ন্যাকামি মনে করে।তাই তো ডিপ্রেশনে বেশি ভোগে শুধু মানুষিক স্বাস্থ্যের যত্ন না নেয়ার কারনে। ওদের একটু বুঝুন, দেখবেন ঘনঘন মুড সুইং হওয়া মেয়েটা সাইকো না সেও কিন্তু লক্ষী একটা মেয়ে।
এত গেল মেয়েদের ব্যাপার- এইবার আসি পুরুষদের প্রসঙ্গে – হয়ত বলবেন মেয়েদের তো প্রিরিয়ড হয় তাই মুড সুইং হতে পারে- কিন্তু পুরুষদের ব্যাপারে কি তা হতে পারে? পুরুষদের তো প্রিরিয়ড হয় না? –না ডিরেক্টলি এ ধরণের কোন পিরিয়ড পুরুষের হয়না যেটাতে রক্ত পড়বে। তবে কিছু কিছু দেশে পুরুষের এরকম ব্লিডিং হয় প্রস্রাবের রাস্তায় যেটা ইনফেকশনের কারণে হয়। তবে কেন পুরুষদের মুড সুইং হবে?
এর কারন হল ইমোশনাল ব্রেক ডাউন – যা হরমনাল চেঞ্জের কারনে হয়ে থাকে- কারন ছেলের ও মেয়েদের মত রেগুলার বেসিসে ছেলেদেরো হরমোনাল চেঞ্জ হয় যা তাদের ইমোশনালি ভালনারেবল করে তুলে মানে মুড সুইং এর সূত্রপাত করে। এই হরমোনের পরিবর্তন এমন কিছু লক্ষণ তৈরী করে যা মেয়েদের পিরিয়ডের সময়কার লক্ষণগুলোর সাথে মিলে যায়।
হ্যা। সাইকোথ্যারাপিস্ট এবং লেখক জেড ডায়মন্ড এমনটাই দাবি করছেন উনার ৪০ বছরের ক্লিনিক্যাল অভিজ্ঞতা এবং ১০০০০ এরো বেশি মানুষের রেস্পন্সের উপর ভিত্তি করে। তিনি পুরুষের এই হরমোনাল পরিবর্তনের নামকরন করেছেন Irritable Male Syndrome (IMS) নামে। এ নামে তার একটি বই ও আছে।
আমরা জানি পুরুষের প্রজনন হরমোনের নাম টেস্টোস্টেরন। এই হরমোনের পরিমাণ আমাদের শরীরে চেঞ্জ হতে পারে। এক ঘন্টায় ৪/৫ বার ও এটি বাড়তে বা কমতে থাকে। প্রতিদিন ভোরবেলা পুরুষের শরীরে এর মাত্রা থাকে সর্বোচ্চ এবং সন্ধ্যার দিকে কমতে থাকে। সিজনের উপর ভিত্তি করে এটি বাড়ে কমে যেমন নভেম্বরের দিকে এটি সর্বোচ্চ এবং এপ্রিলের দিকে সর্বনিম্ন।
এই হরমোন কেবলমাত্র ছেলেদের প্রজনন কাজের জন্যই না বরং আরো বিভিন্ন আবেগীয় প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত। যার কারণে এটি বাড়া বা কমা আমাদের আচরণে প্রচুর প্রভাব ফেলে।
হিউম্যান সাইকোলিজি নিয়ে আমার লেখা পুরাতন পোস্ট গুলো পড়ে আসতে পারেন
ছেলেদের বা মেয়েদের উভয়ের শরীরে টেস্টোস্টেরনের পাশাপাশি স্ট্রোজেন (ফিমেল সেক্স হরমোন) ও আছে। মেয়েদের শরীরে স্ট্রোজেন বেশি টেস্টোস্টেরন কম, ছেলেদের উল্টা। ছেলেদের শরীরে কিছু টেস্টোস্টেরন ভেঙে স্ট্রোজেনে রূপান্তরিত হয়। আমাদের ওজনের ফ্যাট সেল (চর্বি কোষ) টেস্টোস্টেরন কে স্ট্রোজেনে রূপান্তর করে। ছেলেদের শরীরে যত বেশি স্ট্রোজেন বাড়তে থাকে টেস্টোস্টেরন তত কমতে থাকে এবং ছেলেরা ততবেশি ইরিটেড বা বিরক্ত হতে থাকে, এর সাথে নিজেদের আইডেন্টিটি ভুলে রিএক্ট করতে থাকে। তারমানে টেস্টোস্টেরণ যত কম ইরেটিবল মেইল সিন্ড্রোমে (IMS) আক্রান্ত হবার আশংকা তত বেশি।
যদিও এটি মেয়েদের পিরিয়ড কালীন সময়ের লক্ষণগুলার সাথে কিছুটা মিলে যায় কিন্তু ছেলেদের ক্ষেত্রে মেয়েদের মতো শারীরিক যে ক্রিয়কলাপ তা হয়না বলে ছেলেদের এই লক্ষণগুলো নিয়মিত না। এর কোন রেগুলার প্যাটার্ন নেই। ইরেটিবল মেইল সিন্ড্রোমের লক্ষণ হলো- বিনাকারণে, ক্লান্তি,বিভ্রান্তি বা কনফিউশান, হতাশা বা মন খারাপ থাকা, রাগ, বিরক্তি, উদ্বেগ, অতিরিক্ত সংবেদনশীলতা,যৌন চাহিদা কমে যাওয়া এবং আচরণগত অসমঞ্জস্যতা- এই সিম্পটম বা লক্ষণগুলো যদি দীর্ঘ সময় কারো মধ্যে দেখা দেয় তবে অবশ্যই বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেয়া দরকার।
মূল কথা হলো এই সবগুলা ফ্যাক্টর আমাদের শরীরের হরমোনে ব্যপাক প্রভাব ফেলে বিশেষ করে সেক্স হরমোন টেস্টোস্টেরণে যা আমাদের ইরেটেবল মেইল সিন্ড্রোম বা মেইল পিরিয়ডের দিকে টেলে দেয়। এতে করে আমাদের মেজাজ আজাইরা বিগড়ে যায় এবং এই সমস্যার বাজে প্রভাব গুলো আমাদের সাথে রিলেটেড মানুষদের উপর পড়ে।
প্রথমত লক্ষ্য করা নিজের আবেগ অনুভূতির দিকে। নিজের আচরণের দিকে। আমি কিভাবে রিএক্ট করছি কারো প্রতি, কিভাবে নিচ্ছি কারো কথা, কারো উপর কি কোন কিছু চাপিয়ে দিচ্ছি কিনা বা কারো সাথে তর্কে জড়িয়ে পড়ছি কিনানা অযথা। যদি IMS এর লক্ষণগুলো আমার দৈনন্দিন জীবনের কাজে বা সম্পর্কে কোনরূপ খারাপ প্রভাব ফেলে তবে আমার এ বিষয়ে অবশ্যই সচেতন হতে হবে। বেশিরভাগ পুরুষ হরমোনাল এই চেঞ্জকে অস্বীকার করতে চায় কারণ তারা মনে করে এসব মেয়েলী রোগ এবং এতে তাদের সম্মান বা পৌরুষত্ব নষ্ট হবে। যার ফলে এর বাজে প্রভাব গিয়ে পড়ে সেই সব পুরুষদের সাথে সাথে জড়িত নারীদের উপর- মানে বউ মেয়ে বোনদের এবং মায়েদের উপর।
মডেল – শবনম ফারিয়া। ছবি – কালাক্ষর ডেক্স
প্রথমত লক্ষ্য করা তারপর স্বীকার করা যে এধরণের একটা সমস্যার ভিতর দিয়ে যাচ্ছি আমরা। চাপ স্ট্রেস নিয়ন্ত্রনের জন্য একটা রুটিন লাইফ মেন্টেন করার চেষ্টা করা, প্রয়োজনে প্রফেশনালদের সাহায্য নেয়া ( আমরা কি করতে আছি! :-P)। খাদ্যাভ্যাস এবং ঘুমের ব্যপারে সতর্ক থাকা। নিজে প্রতি যত্নশীল হওয়া, কাছের মানুষদের সাথে নিয়মিত কথা বলা।
মূলত যখন কেউ এ ধরণের কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যায় তখন পারতপক্ষে নিজেকে একটু আলাদা করে রাখা, শান্ত করার চেষ্টা করা, ঠান্ডা পানি পানকরা এবং গভীর ভাবে শ্বাস নেয়া। নিজেকে নিজের সাথে গ্রাউন্ডেড করা।
আজ আপনাদের একটা সিক্রেট বলবো। আমার ধারণা বেশিরভাগ পুরুষ কাজ শেষ করে সরাসরি বাসায় না গিয়ে বন্ধুদের সাথে সময় কাটায় বা আড্ডা দিতে চায় কারণ তাদের আচরণের উত্তান পতন তাদের বাড়ির মহিলারা বুঝতে পারেনা বলে। অযথা তর্ক করার চেয়ে দূরে থাকাই ভাল। আমি এটা বিশ্বাস করি যে আমাদের দেশের বেশিরভাগ নারী তাদের পার্টনারদের ইমোশন লেভেল পর্যন্ত যেতেই পারেনা। কেমন ফিল করছেন তাদের সঙ্গীটি! গ্রামেতো আরো অবস্থা খারাপ। আমার বাবা চাচাদের তো কখনোই দেখলাম না কখনো বলতে তাদের মন খারাপ বা আমার মা চাচীদের ও এ বিষয়ে কোন আগ্রহ দেখিনি কখনো। আদতে তারা জানেও না যে পুরুষের ইমোশন বলে কিছু আছে! এজন্য ছেলেরা ঘরমুখী না হয়ে বাহির মুখীই রয়ে গেল আর অনাবিষ্কৃত বা চাপা পড়ে রয়ে গেল তাদের বেচারা আবেগগুলো।
আমার আজকের এই মুড সুইং (mood swings) নিয়ে লেখাটির উদ্দেশ্য হলো একটা সচেতনতা তৈরী করা যাতে আমরা পাশের মানুষটার প্রতি একটু সহানুভূতি, সমানুভূতি দেখাতে পারি। তাকে সাহায্য করতে পারি। নারী পুরুষ সবার সাথেই যেন আমাদের আন্তরিকতা, সমমর্মিতা বজায় থাকে। পরিশেষ এ নিবেদন, পোস্টটি ভাল লাগলে শেয়ার করতে পারেন। তাতে কিছুটা ইনেস্পায়ার আসে।
Leave a Reply