কালাক্ষর ডেক্সঃ কিছু দিন আগের ঘটনা- বাংলাদেশের মিডিয়ার এক জনপ্রিয় অভিনয় শিল্পী (নাম টা বললাম না) গিয়েছিলেন থাইল্যান্ড শুটিং করতে,শুটিং শেষে শপিং করতে গিয়ে বিপনি বিতান থেকে কিছু জিনিস ভ্যানেটি ব্যাগে গায়েব করেছিলেন- তার পর বের হয়ে আসার পথে সিসি ক্যামেরায় খেয়েছিলেন ধরা- যদিও বা খবর টি সেই ভাবে পত্রিয়ায় আসে নি তার পরেও এই ঘটনা নিয়ে মিডিয়া পাড়ার গ্রিন রুম গুলোর ভিতরে কাজের ফাঁকে যে আড্ডা হয় সেই আড্ডার বেশ কিছুদিন হট টপিক হয়েছি ছিল- সবাই এক রকম ধন্দে পড়েছিলেন কেন তিনি চুরি করতে গেলেন? তার টাকার অভাব নেই, আবার চুরি করা জিনিস টা যে খুব মুল্যবান তাও নয়- তাহলে কেন? তার কারন আর কিছু নয়, তিনি এমন একটি মানুষিক রোগে আক্রান্ত – যার চর্চা খুব একটা নেই বললেই চলে,সৃজনশীল ব্লগ কালাক্ষর এর আজকের আযোজন সেই রোগ টি নিয়েই –
ক্লেপটোম্যানিয়া শব্দটি গ্রীক শব্দ (ক্লেপটো) এবং (ম্যানিয়া) থেকে এসেছে যার অর্থ যথাক্রমে “চুরি করা” ও ” পাগলের মতো তীব্র আকাঙ্খা” থেকে এসেছে। এর অর্থ দাঁড়ায় “চুরির প্রতি বাধ্যবধকতা“। ১৮১৬ খ্রিষ্টাব্দে সর্বপ্রথম এব্যাপারে উল্লেখ করে একে একধরনের মানসিক ডিজঅর্ডারের তালিকা ভুক্তি করা হয়।ক্লেপটোম্যানিয়া এক ধরণের মানসিক রোগ। রোগ মানুষকে চুরি করতে তাড়না যোগায় । তবে ক্লেপটোম্যানিয়ার প্রভাবে চুরি করা আর স্বাভাবিক চুরি এক নয়। স্বাভাবিক চুরিতে যিনি চুরি করেন উনার একটা উদ্দেশ্য থাকে। কেউ অভাবের তাড়নায় চুরি করেন, কেউ প্রতিশোধ পরায়ন হয়ে, কেউবা করেন কারো ক্ষতি করার জন্য। কিন্তু ক্লেপটোম্যানিয়ার প্রভাবে যারা চুরি করেন উনাদের এমন কোন উদ্দেশ্যই থাকে না। সোজা বাংলায় ক্লেপটোম্যানিয়া মানে উদ্দেশ্য ছাড়াই চুরি করা।
হিউম্যান সাইকোলজি নিয়ে আমার অন্য লেখা গুলো পড়তে চাইলে নিচের লিংক গুলোতে ক্লিক করুনঃ
এই রোগে আক্রান্ত মানুষ কোন বস্তু দেখলে সেটা চুরি করার জন্য হাঁসফাঁস করতে থাকেন, বস্তুটি খুবই কম দামি কিংবা নিতান্তই অপ্রয়োজনীয় হলেও। চুরি করতে না পারা পর্যন্ত রোগী খুবই অস্বস্তিতে ভোগেন। চুরি সম্পন্ন করতে পারলে আত্মতুষ্টিতে ভোগেন। কিন্তু স্বাভাবিক চুরির সাথে এই চুরির পার্থক্য হলো, এনারা চুরি করা বস্তু নিজে ব্যবহার করেন না, বিক্রিও করেন না। হয় কাউকে দিয়ে দেন না হয় ফেলে দেন কিংবা চুরি করা বস্তুটি গোপনে সঠিক জায়গায় ফেরত দিয়ে দেন। যদিও ক্লেপটোম্যানিয়া রোগের এখনো কোন স্পষ্ট কারণ খুঁজে পাওয়া যায়নি। কিন্তু গবেষকরা বলছেন, মস্তিষ্কে প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট সেরোটোনিন নামক রাসায়নিকের কম-বেশি হওয়ার কারণে এই সমস্যা হতে পারে।
একজন মানুষের বেড়ে উঠার সময়ে আচরণগত ও ধারণাগত বিবর্তনের কারণে এমনটা হতে পারে। শিশু কিশোররা মাঝে মাঝে কন্ডাক্ট ডিসঅর্ডার বা আচরণগত মানসিক সমস্যার কারণে চুরি করে থাকে যা ক্লেপটোম্যানিয়া থেকে আলাদা। কিন্তু সঠিক পরিচর্যার মাধ্যমে শিশু কিশোরদের কন্ডাক্ট ডিসঅর্ডার প্রতিরোধ না করলে তার মাঝে ধীরে ধীরে ক্লেপটোম্যানিয়া প্রভাব বিস্তার করতে পারে। ক্লেপটোম্যানিয়াকে অবসেসিভ কম্পালসিভ ধরনের ডিজঅর্ডার বলে আখ্যায়িত করা যায়
বহু মনঃ সমীক্ষার তাত্ত্বিক ক্লেপ্টোম্যানিয়া একজন ব্যক্তির কোন সত্যিকারে অথবা কাল্প্নিক ক্ষতির প্রতীকি ক্ষতিপূরণ হিসেবে বস্তু দখলের প্রবণতা বলে ব্যাখ্যা করেন। তাদের মতে, এই আচরণ চুরি করা বস্তুর প্রতীকি ভাবার্থের মাঝেই নিহিত। চালক তত্ত্ব বা ড্রাইভ থিওরি এই চুরি করা প্রবণতাকে প্রতিরক্ষামূলক আচরণ বলে প্রস্তাব করেছে। এই তত্ত্ব মতে, চুরির মাধ্যমে ব্যক্তি নিজের অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ কিংবা অনুভূতি প্রকাশ থেকে বিরত রাখে। অন্যদের মতে ক্লেপটোম্যানিয়াক ব্যক্তি চুরি করা বস্তু কিংবা চুরি করে যে অনুভূতি পাওয়া যায়, সেটার জন্যই চুরি করে থাকে-
জীববৈজ্ঞানিক নমুনায় ক্লেপটোম্যানিয়ার মূল প্রধানত কিছু নির্দিষ্ট সেরোটোনিন ইনহিবিটর (SSRIs), ভাবের স্থিরতা এবং অপিওয়েড রিসেপ্টরের প্রতিদ্বন্দী। কিছু গবেষণায় ক্লেপটোম্যানিয়াক ব্যক্তির মাঝে আফিম আসক্তির মতো এক ধরনে আকাংখা তৈরি হয় যা শুধুমাত্র চৌর্য্যকর্মের মাধ্যমেই নিবারণ হয়। এতদ্বারা দূর্বল সেরোটোনিন, ডোপামিন নিঃসরণ এবং/অথবা মস্তিষ্কের প্রাকৃতিক অপিওয়েড ক্লেপটোম্যানিয়াকের জন্য দায়ী করা যায়। যা এই আচরণকে ইমপালসিভ কন্ট্রোল ডিজঅর্ডারের তালিকায় যুক্ত করে। অন্য একটি ব্যাখায় ক্লেপটোম্যানিয়াকে স্বচিকিৎসার সাথে তুলনা করা হয়েছে। এক্ষেত্রে চুরির মাধ্যমে ব্যক্তির প্রাকৃতিক অপিওয়েড নিঃসরণ উত্তেজিত হয়। এই “অপিওয়েড নিঃসরণ রোগীর দুঃখ, দুশ্চিন্তা কমাতে সাহায্য করে। ফলে চুরিরা মাধ্যমে ব্যক্তি নিজের মানসিক প্রশান্তি আনে।”
ক্লেপটোম্যানিয়া বনাম চুরি: দেখতে শুনতে এক রকম লাগলেও দু’টোর পার্থক্য বোঝা খুবই জরুরি।
(১) ক্লেপটোম্যানিয়া হল অন্যের জিনিস না বলে নেওয়ার এক অদম্য আকাঙ্খা যা সেই ব্যক্তির স্বতঃস্ফূর্ত আচরণ। কিন্তু চুরি হল সেই জিনিসটি ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্যে হাত করা, যার জন্যে প্রাথমিক পরিকল্পনা প্রয়োজন।
(২) ক্লেপটোম্যানিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তি অন্যের জিনিস চুরি করার ইচ্ছাকে দমন করতে পারেন না। অন্যদিকে দোকানপাট থেকে লোভে পড়ে জিনিস চুরি করার পেছনে সেটাকে আত্মসাৎ করার চিন্তা কাজ করে। কাজেই দেখতে শুনতে এক রকম লাগলেও, একে অপরের থেকে যথেষ্ট আলাদা।
মডেল বাধন। ছবি – কালাক্ষর ডেক্স
অপ্রয়োজনীয় জিনিস চুরি করার অদম্য আকাঙ্খাচুরি করার আগে অত্যাধিক চাপ এবং উদ্বেগচুরি করে আনন্দ পাওয়াচুরি করার পরে অপরাধবোধ এবং লজ্জায় ভোগাচুরিগুলো কোনও বিভ্রম, বিভ্রান্তি বা রাগের বশে অথবা প্রতিশোধ স্পৃহায় না করাকোনও কোনও ক্ষেত্রে অপরাধবোধ থেকে মুক্তি পেতে চুরি করা জিনিস ফেরৎ দেওয়া অপ্রয়োজনীয় জিনিস চুরি করার অদম্য আকাঙ্খাচুরি করার আগে অত্যাধিক চাপ এবং উদ্বেগচুরি করে আনন্দ পাওয়াচুরি করার পরে অপরাধবোধ এবং লজ্জায় ভোগাচুরিগুলো কোনও বিভ্রম, বিভ্রান্তি বা রাগের বশে অথবা প্রতিশোধ স্পৃহায় না করাকোনও কোনও ক্ষেত্রে অপরাধবোধ থেকে মুক্তি পেতে চুরি করা জিনিস ফেরৎ দেওয়া
ক্লেপটোম্যানিয়ার প্রকৃত কারণ সকলেরই অজানা।তবে মনোবিদরা অনুমানের ভিত্তিতে এই সংক্রান্ত কিছু যুক্তি খাড়া করেছেন।
ফ্রন্টাল লোব ডিসফাংশন: আমাদের মস্তিষ্কের সামনের অংশ বা ফ্রন্টাল লোব আমাদের ইছাগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে। সেখানে কোনও রকমের রাসায়নিক বা নিউরোট্রান্সমিটারের ভারসাম্যহীনতার জন্য ক্লেপটোম্যানিয়া দেখা দিতে পারে।
অন্যান্য মানসিক উপসর্গের উপস্থিতি: অনেক সময় মানসিক চাপ, অত্যধিক-অমোঘ ব্যাধি (অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার), মাদকাসক্তি বা মুড ডিসঅর্ডারের সাথে ক্লেপটোম্যানিয়া দেখা দিতে পারে।জিনগত: বিভিন্ন গবেষণা থেকে জানা গিয়েছে যে বংশানুক্রমেও ক্লেপটোম্যানিয়া দেখা দিতে পারে।
ফ্রন্টাল লোব ডিসফাংশন: আমাদের মস্তিষ্কের সামনের অংশ বা ফ্রন্টাল লোব আমাদের ইছাগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে। সেখানে কোনও রকমের রাসায়নিক বা নিউরোট্রান্সমিটারের ভারসাম্যহীনতার জন্য ক্লেপটোম্যানিয়া দেখা দিতে পারে।
অন্যান্য মানসিক উপসর্গের উপস্থিতি: অনেক সময় মানসিক চাপ, অত্যধিক-অমোঘ ব্যাধি (অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার), মাদকাসক্তি বা মুড ডিসঅর্ডারের সাথে ক্লেপটোম্যানিয়া দেখা দিতে পারে।জিনগত: বিভিন্ন গবেষণা থেকে জানা গিয়েছে যে বংশানুক্রমেও ক্লেপটোম্যানিয়া দেখা দিতে পারে।
চিকিৎসা: ক্লেপটোম্যানিয়া একজন ব্যক্তির আজীবন থাকতে পারে। এর চিকিৎসার উদ্দেশ্য হল রোগের উপসর্গগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করা, কারণ এটি সম্পূর্ণ নির্মূল করার কোনও নিশ্চয়তা দেওয়া সম্ভব নয়। পরিণতির ভয়ে লোকে ক্লেপটোম্যানিয়া নিয়ে আলোচনা করতে দ্বিধা বোধ করেন, যা তাদেরকে ক্রমাগত হতাশা এবং মানসিক চাপের দিকে ঠেলে দেয়। ক্লেপটোম্যানিয়ার চিকিৎসা পদ্ধতিগুলি নিম্নরূপ:
ওষুধ: অ্যন্টিডিপ্রেসেন্টস(অবসাদ নিয়ন্ত্রণকারী),মুড স্টেবিলাইজার(মেজাজ নিয়ন্ত্রণকারী),অ্যান্টি-সিজার (খিঁচুনি প্রতিরোধক) এবং নেশা কাটানোর ওষুধের মাধ্যমে সুফল পাওয়া সম্ভব। থেরাপি:সাইকোথেরাপি ক্লেপটোম্যানিয়ার চিকিৎসায় ভালো কাজ করে। এমন কিছু পদ্ধতি হল –
প্রচ্ছন্ন সংবেদনশীলতা: এখানে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে ধরা পড়ার পরিণতিগুলি নিয়ে কল্পনা করতে বলা হয়। অপরাধের নেতিবাচক দিকগুলি নিয়ে অবগত থাকলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি চুরি করা থেকে নিজেকে আটকাতে সক্ষম হন।
বিতৃষ্ণা পদ্ধতি: সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে চুরি করার আগে অস্বাচ্ছন্দ্যকর কিছু করতে বলা হয়। উদাহরণস্বরূপ, সেই ব্যক্তিকে চুরি করার প্রলোভনে সাড়া দেওয়ার আগে নিঃশ্বাস ততক্ষণ বন্ধ করে রাখতে বলা হতে পারে যতক্ষণ না সেটা অসম্ভব মনে হয়।
ক্লেপটোম্যানিয়া এমন এক মানসিক ব্যাধি যা নিয়ে আমাদের সমাজে যথেষ্ট কুণ্ঠা এবং লজ্জা বিদ্যমান রয়েছে। ফলে এতে আক্রান্ত ব্যক্তিরা এই নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা করতে ভয় পান। পাশাপাশি এটাও মনে রাখা দরকার যে সম্পূর্ণ নির্মূল করার কোনও নিশ্চয়তা না দেওয়া গেলেও চিকিৎসার মাধ্যমে ক্লেপটোম্যানিয়ার উপসর্গগুলিকে আরও দক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
Leave a Reply