আ২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে ঘটে যাওয়া ভয়ানক বোমা হামলার ঘটনার জের এখনও দুনিয়া বয়ে বেড়াচ্ছে। বিশেষ করে মার্কিনীরা দুই দশক পরেও সেই ঘটনা নিয়ে কথা বলছে। ‘বিবিসি’র এক প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে যে, ঘটনার পর থেকেই ৯/১১এর ঘটনাকে যুক্তরাষ্ট্রে অনেকেই ষড়যন্ত্র বলে মনে করতে থাকে। সোশাল মিডিয়াতে অনেকেই বলতে থাকে যে, ঘটনাগুলি যুক্তরাষ্ট্রের ‘ডীপ স্টেট’এর লোকজন ঘটিয়েছে। এর পিছনে সেই দিনের ঘটে যাওয়া ঘটনার কিছু তথ্য উপাত্ত নিয়েই অনলাইনে পোস্ট দিতে থাকে মানুষ; যা আজও চলছে। অনেকেই মনে করেন যে, জেট ফুয়েলের মাধ্যমে স্টিলের বীম গলিয়ে ফেলা সম্ভব নয়; যার ফলশ্রুতিতে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের ১’শ তলা দু’টা ভবন ধ্বসে পড়ে বলে বলা হয়েছিল। এরপর রয়েছে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের কিছু দূরে অবস্থিত ৪৭ তলা ‘৭ ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার’এর ধ্বসে পড়া। ১’শ তলা ভবনগুলি ধ্বসে পড়ার কয়েক ঘন্টা পর এই ভবনটা ধ্বসে পড়ে। ‘বিবিসি’র তৎকালীন প্রতিনিধি জেইন স্ট্যানলি টেলিভিশনে লাইভ রিপোর্টে বলেন যে, ‘৭ ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার’ ধ্বসে পড়েছে। অথচ রিপোর্টারের পিছনে তখনও পরিষ্কারভাবে দেখা যাচ্ছিলো যে, ভবনটা দাঁড়িয়ে আছে। এছাড়াও পেন্টাগন ভবনে বিমান আঘাত হেনেছে বলে বলা হয়; সেখানে ভবনে তৈরি হওয়া ছোট্ট ফুটো দিয়ে একটা বিমানের পক্ষে যাওয়া সম্ভব ছিল না। সেখানে বিমানের ডানা বা বিমানের বডির কিছুই ছিল না। অনেকেই সন্দেহ করেছে যে, সেখানে বিমানের স্থানে ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছিল। এছাড়াও আরও অনেকগুলি যুক্তিতর্কের অবতারণা হয় সেদিনের ঘটনাকে ঘিরে। ‘বিবিসি’ তাদের প্রতিবেদনে মার্কিন সরকার এবং রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলির বিভিন্ন প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করে; যেগুলি এই প্রশ্নগুলির উত্তর দেয় বলে দাবি করা হয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এখনও মার্কিন জনগণের একটা অংশ রাষ্ট্র এবং মিডিয়ার এই ব্যাখ্যাগুলিকে মেনে নিচ্ছে না। “৯/১১ ট্রুথ” মুভমেন্ট নামে একটা আন্দোলন এখনও সেই ঘটনাগুলির ব্যাপারে সোশাল মিডিয়াকে ব্যবহার করে পোস্ট দিচ্ছে এবং সত্যিকারের ঘটনা জনগণকে জানাবার জন্যে দাবি করছে।
অতি সম্প্রতি ‘ইউএসএ টুডে’এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, ৯/১১ এর বোমা হামলার ঘটনা পশ্চিমা দুনিয়াকে এক অভিষ্ট লক্ষ্যে টেনে এনেছিল। কিন্তু এখন আর কোন ভাবেই সেই অভিষ্ট তাদেরকে এক রাখতে পারছে না। যে ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের সকল দলই একমত তা হলো, যুক্তরাষ্ট্র এখন গুরুত্বপূর্ণ আদর্শের ব্যাপারে পুরোপুরিভাবে বিভক্ত। বিশ বছর কেন, দশ বছর আগেও ক্যাপিটল হিলে হামলা চিন্তার বাইরে ছিল। আর এখন মার্কিন এটর্নি জেনারেল মেরিক গারল্যান্ড বলছেন যে, শ্বেতাঙ্গ উগ্রবাদীরা যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্যে সবচাইতে বড় হুমকি। ‘পিউ রিসার্চ’এর এক গবেষণায় বলা হচ্ছে যে, ২০১৬ সালের নির্বাচনের পর থেকে মার্কিন রিপাবলিকানদের মাঝে মিডিয়ার উপর বিশ্বাস ৭০ শতাংশ থেকে কমে ৩৫ শতাংশে নেমে এসেছে। অথচ ডেমোক্র্যাটদের মাঝে ৮০ শতাংশই মিডিয়াকে বিশ্বাস করছে। ভ্যাকসিনের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের মাঝে অনেকেই রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলিকে বিশ্বাস করতে পারছে না। সামাজিক এবং রাজনৈতিক মেরুকরণ এখন ইতিহাসে সবচাইতে মারাত্মক পর্যায়ে রয়েছে। বৈচিত্র্যকে একসময় যুক্তরাষ্ট্রের ভিত বলে মনে করা হতো। কিন্তু এখন রাজনৈতিক মেরুকরণ একটা রোগের মতো যুক্তরাষ্ট্রে ছড়িয়ে পড়েছে। ‘বিবিসি’র উত্তর আমেরিকা সম্পাদক জন সোপেল এক লেখায় বলছেন যে, ৯/১১এর বিশ বছর পূর্তিতে ‘ইউনাইটেড স্টেটস’ এখন ‘ডিজইউনাইটেড স্টেটস’ হয়ে গেছে।
সম্প্রতি ‘এসোসিয়েটেড প্রেস’ বলছে যে, গত দুই দশকে আফগানিস্তান এবং ইরাকের যুদ্ধে ৭ হাজারের বেশি মার্কিন সেনা এবং ১ হাজারের বেশি মার্কিনীদের বন্ধু দেশের সেনা মৃত্যুবরণ করেছে। ‘ব্রাউন ইউনিভার্সিটি’র ‘কস্ট অব ওয়ার’ প্রকল্পের হিসেবে যুদ্ধাহত সেনাদের পিছনে যুক্তরাষ্ট্রের ৬ ট্রিলিয়ন ডলার বা ৬ হাজার বিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে! এটা যুক্তরাষ্ট্রের দশ বছরের সামরিক বাজেটের সমান! এখন পশ্চিমা বিশ্বের মানুষ বেড়ে উঠছে সিকিউরিটি ক্যামেরার নিচে; মানুষের ব্যক্তিগত যোগাযোগের উপর এখন নজরদারি হচ্ছে। বড় এবং ছোট শহরগুলির নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে ব্যাপক সামরিক যন্ত্রপাতি দেখে সেটা সন্ত্রাসবাদ দমনে ব্যবহার করা হবে, এই যুক্তি দেয়া কঠিন। সরকারি অফিসগুলি এখন দূর্গের মতো; বিমানবন্দরগুলি এখন নিরাপত্তার চাদরে ঢাকা।
তদানিন্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ জুনিয়র সেই যুদ্ধ আরম্ভ করলেও পরবর্তী সকল প্রেসিডেন্টই চেয়েছিলেন মার্কিন সেনাদের যুদ্ধের ময়দান দেশের ফিরিয়ে নিয়ে আনতে। তথাকথিত ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে’ পশ্চিমা বিশ্বের মাঝে একাত্মতা তৈরি হবার যে আশা জেগেছিল, তা এখন জাতীয়তাবাদের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে। ওবামা এবং ট্রাম্প প্রশাসনের সময় থেকেই যুক্তরাষ্ট্র ‘বিশ্বের পুলিশম্যান’ থাকার ভূমিকা ছেড়ে দিতে চাইছিল। ‘এসোসিয়েটেড প্রেস’ আরও বলছে যে, ৯/১১এর পর বিশ্ব ব্যবস্থা যা দাঁড়িয়েছিল, তা এখন পুরোপুরিভাবে ভেস্তে গেছে অর্থনৈতিক মন্দা এবং করোনাভাইরাসের সংক্রমণের পর।
‘বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড’ বলছে যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর গ্রেট ব্রিটেন তার বৈশ্বিক নিয়ন্ত্রণকে ধরে রাখতে চেষ্টা করেছিল; যেন ভূরাজনৈতিক পরিবর্তন খুব বেশি কিছু একটা ছিল না। ১৯৪৯ সাল থেকে ১৯৭০এর মাঝে তারা বিশ্বব্যাপী মোট ৩৪টা সামরিক মিশন চালিয়েছিল। একটা বৈশ্বিক শক্তির পক্ষে তার শক্তির অবক্ষয় মেনে নেয়া কঠিন। যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান থেকে সরে এসে চীনের দিকে মনোনিবেশ করেছে। কিন্তু চীন তো সোভিয়েত ইউনিয়ন নয়। চীনারা একটা জাতীয়তাবাদী বড় অর্থনৈতিক শক্তি; যারা মার্কিনীদের নিজস্ব উঠানেই বিনিয়োগ করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবকে কমাচ্ছে।
আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের ফলে রাশিয়া এবং চীন যেমন প্রভাব বাড়ানোর সুযোগ পেয়েছে, ‘এসোসিয়েটেড প্রেস’ এর মতে।তেমনি যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধুরাও বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন করছে। ‘বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড’ বলছে যে, দুই দশক আগে যুক্তরাষ্ট্র ঠান্ডা যুদ্ধে জয়ের কারণে নেতৃত্বশীল অবস্থানে ছিল। কিন্তু এখন যুক্তরাষ্ট্র অনেকগুলি বড় শক্তির মাঝে একটা। গায়ের জোর দিয়ে তো বিশ্বকে নেতৃত্ব দেয়া যায় না। অর্থনৈতিকভাবে যুক্তরাষ্ট্র চীনের সাথে প্রতিযোগিতায় হিমসিম খাচ্ছে; আর ভূরাজনৈতিকভাবে যুক্তরাষ্ট্র এখন একটা অনির্ভরযোগ্য সুপারপাওয়ার। হয়তো ব্রিটিশদের মতোই মার্কিনীরাও বুঝতে পারছে যে, সাম্রাজ্যের খেলা শেষ!
Leave a Reply