নেলসন ম্যান্ডেলা এর নাম আমরা প্রায় সবাই জানি। বর্ণবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে ইতিহাসের পাতায় সর্নাক্ষরে নিজের নাম লিখে গিয়েছেন। আর এই আন্দোলন করতে গিয়ে তার জীবনের বেশির ভাগ সময় তাই জেল খানার ভিতরেই কাটাতে হয়েছিল। শেষ বয়সে যদিও তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট হন কিন্তু হিসেব করলে দেখা যায় নেলসন ম্যান্ডেলা তার জীবনের দীর্ঘ সময় ২৭ বছর জেলের অন্ধ কুঠরির ভিতরেই কাটাতে হয়েছিল।
নেলসন ম্যান্ডেলা দেশের প্রেসিডেন্ট হবার পর একদিন তাঁর কয়েকজন সহকর্মীকে বললেন : -চলো আজ শহর দেখি । চার দেয়ালের ভিতর বন্দি থেকেই তো জীবনের বেশির ভাগ সময় কেটে গেলো। এখন নিজের শহরটি কেমন হয়েছে , নিজের চোখে না দেখলেই নয় । সহকর্মীদের সাথে নিয়ে নেলসন ম্যান্ডেলা শহরের অলিতে গলিতে হাঁটলেন । তাঁর খুব ক্ষিদে পেলো । ক্ষিদে লাগার পর ম্যান্ডেলা বললেন : – চলো , সামনের মোড়ে যদি কোনো রেস্তোরাঁ পাই ,সেখানেই কিছু খেয়ে নিতে চাই । সহকর্মীরা তো অবাক ! বুঝতে পেরে ম্যান্ডেলা বললেন , অবাক হওয়ার কিছুই নেই , ক্ষিদে পেয়েছে , খাবো । জেলখানার ওই বিভৎস খাবার খেয়েও যেহেতু মরিনি , তাই এতো সহজে মরবো না । সবাই মিলে টেবিলে খেতে বসেছেন ।
নেলসন ম্যান্ডেলা লক্ষ করলেন তার অল্পদূরে বেশ বয়ষ্ক এক ভদ্রলোক বসে আছেন। নেলসন ম্যান্ডেলা হোটেলের ওয়েটারকে ডেকে বললেন,একটা চেয়ার এনে আমার পাশে রাখো এবং ওনাকে বলো,আমার টেবিলে বসে আমার পাশে বসে খেতে।ভদ্রলোক আসলেন । এসে তাঁর পাশের চেয়ারটায় বসলেন। খেতে খেতে সবাই গল্প করছেন । কিন্তু পাশে বসা ভদ্রলোকটি কিছুই খেতে পারছেন না । ওনার হাত কাঁপছে । চামচ থেকে খাবার প্লেটে পড়ে যাচ্ছে। ম্যান্ডেলার সহকর্মীদের একজন বললেন ,আপনি মনে হয় অসুস্থ । ভদ্রলোক চুপচাপ রইলেন। কিছুই বললেন না ।ম্যান্ডেলা নিজ হাতে ওনাকে খাবার খাইয়ে দিলেন এবং ওয়েটারকে ডেকে বললেন , ওনার খাবার বিলটা আমরা পরিশোধ করবো ।খাবার শেষে সেই বয়স্ক ভদ্রলোক বিদায় নেয়ার জন্য প্রস্তুত হলেন । কিন্তু সবাই অবাক চোখে দেখলো ,লোকটি ভালো করে দাঁড়াতে বা হাঁটতে পারছেন না । শরীরের কাঁপুনি ক্রমবর্ধমান ।ম্যান্ডেলা নিজ হাতে ওনাকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করলেন এবং সহকর্মীদের একজনকে বললেন , ওনাকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসতে ।
নেলসন ম্যান্ডেলার সহকর্মী দলের ভিতর একজন বললেন, এতো অসুস্থ শরীর নিয়ে উনি বাড়ী পৌঁছাতে পারবেন তো? সহকর্মীর কথা শুনে সে সময় ম্যান্ডেলা বলতে শুরু করলেন,আসলে উনি অসুস্থ না । আমি জেলের যে সেলে বন্দি ছিলাম উনি ছিলেন সেই সেলের গার্ড হিসেবে কর্মরত ছিলেন। জেল খানার ভিতর আমায় প্রচন্ড মার খেতে হত। মার খেয়ে আমার খুব তৃষ্ণা পেতো। পিপাসায় কাতর হয়ে আমি যতবার পানি পানি বলে আর্তনাদ করতাম,উনি ততবারই পানি না দিয়ে আমার সমস্ত শরীরে প্রসাব করে দিতেন।
আজ আমি দেশের প্রেসিডেন্ট।দেশের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী মানুষ হওয়ার পর,আমি ওনাকে আমার টেবিলে একসাথে খাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ করেছি! তাই সেই সব দিনগুলোর কথা মনে করে উনি খুব ভয় পেয়েছেন।কিন্তু ক্ষমতাবান হয়েই ক্ষমতাহীন মানুষকে শাস্তি দেয়া তো আমার আদর্শের পরিপন্থী।এটা আমার জীবনের এথিকসের অংশ নয়। তাই শাস্তি পাওয়ার পরিবর্তে উনি ভালোবাসা পেয়েছেন । আমার মুখে আর শরীরে উনি প্রসাব করেছেন । কিন্ত ওনার মুখে আমি খাবার তুলে দিয়েছি । আমি আপনাদের যেমন প্রেসিডেন্ট , তেমনি ওনারও প্রেসিডেন্ট । প্রতিটি নাগরিককে সম্মান জানানো আমার নৈতিক দায়িত্ব । শুধুমাত্র প্রতিশোধ নেয়ার মানসিকতা’ই একটি তৈরী রাষ্ট্রকে ধ্বংস করে দিতে পারে । আর সহনশীলতার মানসিকতা একটি ধ্বংস হয়ে যাওয়া রাষ্ট্রকে তৈরী করতে পারে ।
Leave a Reply