ইতিহাস ডেক্সঃ সৃজনশীল ব্লগ কালাক্ষর এ আজ আমরা উইঘুর জাতীর ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করবো । উইঘুর জাতির ইতিহাস প্রায় চার হাজার বছর আগের। উইঘুর জাতীর পোস্ট মর্টেম করলে দেখা যায় এদের মূল অংশ বর্তমানের স্বাধীন তুর্কিমিনিস্থানের অধিবাসী। তুর্কিমিনিস্থানের ম্যাপ ঘাটলে আজ তাদের খুব ছোট একটা দেশ বলে ধরে নেওয়া যায় । কিন্তু এই দেশ আগে এত ছোট ছিল না ।
মানে গ্রেটার তুর্কিমিনিস্থান এর কথা বলছি – এই গ্রেটার তুর্কিমিস্থান এর পূর্ব অংশ যা প্রাচীন সিল্ক রোডের পাশে অবস্থিত ছিল, যা কালের বিবর্তনে আজ চিনের অংশ । যা আজ জিনজিয়াং প্রদেশ নামে পরিচিত, সেই খান কার বাসিন্দা দের যাদের উইঘুর বলা হয় – জিনজিয়ান প্রদেশের চতুর্পাশ্বে তুর্কিমিনিস্থান, চীন, ভারত, পাকিস্তান, কাজাখস্তান, মঙ্গোলিয়া ও রাশিয়ার অবস্থান।
চিনের জিনজিয়ান প্রদেশে উইঘুর রাই এক মাত্র বসতি নয় – উইঘুর ছাড়াও ডংজিয়াং, খালকাস, সালার, তাজিক, বাওন, হুই, কাজাখ, উজবেক, তাতার মুসলিম রয়েছে। তবে এদের অধিকাংশ ই সেক্যুলার মুসলিম এর ফলে চীনা সরকার ধর্ম প্রাণ উইঘুরদের প্রতি যতটা খড়গহস্ত অন্যান্য মুসলিমদের প্রতি ততটা নয় । কারন হিসেবে বলা যেতে পারে উইঘুররা রাজনৈতিক ইসলামকে ধারণ করে চীনা কমিউনিস্ট কর্তৃপক্ষ ধর্মিয় নিরপেক্ষতার জন্য উইঘুর দের উপর যতটা খড়গ হস্ত হয়- বাকিদেরকে সেটা করা হয়না বা করার প্রয়োজন পড়ে নি । তাছাড়া বাকিরা সেটা করে না ।
উইঘুর রা জাতী গত ভাবে উইঘুর রা কারলুক, অন্যান্য তুর্কি জাতি। আটলান্টিক জাতিসমূহের সাথে দূর সম্পর্ক যুক্ত – মধ্য এশিয়ায় বসবাসরত তুর্কি বংশোদ্ভূত একটি জাতিগোষ্ঠী। বর্তমানে উইঘুররা চীনের জিন জিয়ান প্রদেশের সরকারিভাবে স্বীকৃত ৫৬টি নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর অন্যতম জন গোষ্ঠী। ৮০% উইঘুর জিন জিয়ান অঞ্চলের দক্ষিণপশ্চিমাঞ্চলে তারিম বেসিনে বসবাস করে।জিনজিয়াং এর বাইরে উইঘুরদের সবচেয়ে বড় সম্প্রদায় চিনের দক্ষিণ মধ্য হুনান প্রদেশে বাস করে ।
চীনের বাইরে মধ্য এশিয়ার অন্যান্য রাষ্ট্র যেমন কিরগিজস্তান, কাজাখস্তান, বেলুচিস্থান, উজবেকিস্তানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক উইঘুর বাস করে। এছাড়া ও উইঘুর রা আফগানিস্তান, পাকিস্তান, সৌদি আরব, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র জার্মানি, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ড, নরওয়ে, সুইডেন, রাশিয়া, ও তুরস্কে অল্পসংখ্যক উইঘুর রয়েছে।
উমাইয়া খলিফা দ্বিতীয় ওয়ালিদের শাসনামালে উইঘুররা মুসলিম হয়েছিল। উমাইয়া খলিফা দ্বিতীয় ওয়ালিদের শাসন আমলে ইসলামের ঝান্ডা দুনিয়াতে ব্যাপক ভাবে বিকশিত হত । এর মুলে ছিল তার বিখ্যাত চার সেনাপতি । মুহাম্মদ বিন কাসিম,কুতায়বা ইবনে মুসলিম,তারেক বিন যিয়াদ,ও মুসা বিন নুসাইর নামে তার বিখ্যাত চার সেনাপতি পৃথিবীর চারদিকে অভিযান পরিচালনা করেছেন।
পৃথিবীর ইতিহাসে আর কোন নৃপতির একসাথে এত জন বিজয়ী সেনাপতি ছিল কিনা আমার জানা নেই, এটাও জানা নেই যে এতো বিখ্যাত কোন সেনাপতিদের ভাগ্যে শেষ পর্যন্ত এমন করুন অবস্থা হয়েছিল কি না সেটাও । বিখ্যাত এই চার সেনাপতির মধ্যে স্পেনে ৭১১ খৃষ্টাব্দে তারেক বিন যিয়াদ ও মুসা বিন নুসাইর। আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশে ৭১১ খৃষ্টাব্দে বিজয় অভিযান পরিচালনা করেছেন, মোহাম্মদ বিন কাসেম ,মধ্যে এশিয়ায় ৭১২ খৃষ্টাব্দে কুতায়বা ইবনে মুসলিম, মুলত কুতায়বা ইবনে মুসলিম এর মাধ্যমে ই এই উইঘুররা ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করে। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস এই চার বীর সেনানীর ভাগ্য প্রসুন্ন ছিল না – বলেই তাদের চরম দুর্ভোগের শিকার হতে হয়েছিল। তারা যেমন নির্যাতিত হয়েছিলেন ঠিক তাদের মতনই যেন তাদের হাতে বিজিত অঞ্চলের মুসলিমরাও আজ চরম নির্যাতন আর নিপীড়নের শিকার হয়ে দিন পাত করছেন ।
আজকের আধুনিক স্পেনে প্রায় ৮০০ বছর মুসলিম শাসন থাকলেও তাদেরকে সেখান থেকে এমনভাবে নিচিহ্ন করা হয়েছে যে কোনকালে এই দেশটি মুসলিমরা বাস করতো বা তাদের অস্তিত্ব ছিল সেটা বুঝার আর কোন উপায়ই আজ বাকি নেই । মধ্য এশিয়ার উইঘুররা ছাড়া অন্যান্য দেশসমূহ দীর্ঘদিন সোভিয়েত রাশিয়ার কমিউনিস্ট শাসনাধীন থেকে তাদের করুন অবস্থার কথা ইতিহাসের পাতায় চোখ বুলালেই বুঝতে পারা যায় আর সেখানকার চেচনিয়া দাগেস্তান ইঙ্গুটিশিয়ার কথা আর নাইবা বললাম।
বাকি থাকলো আামাদের ভারতীয় উপমহাদেশের কথা,ভারতবর্ষে সুলতানী আমল ও মুঘল আমল মিলিয়ে মুসলমানরা ৮০০ বছর শাসন করেছে,সুলতান আর মুঘলরা এই ভারতবর্ষকে আপন করে সাজিয়েছে কিন্তু বর্তমান সময়ে শ্রীলঙ্কা,মায়ানমার,ভারতের মুসলিমদের কী অবস্থা, কাস্মীরের কেমন পরিস্থিতি সেটা বোধকরি নতুন করে বলার কিছু নেই। মাঝে মাঝে আমার দেশটির কথা ভাবি,আল্লাহ আমাদেরকে স্বাধীনতার যে নিয়ামত প্রদান করেছেন তা কি আমরা অক্ষুণ্ণ রাখতে পারবো? ভিনদেশী হায়েনা আর তাদের এদেশীয় দালালদের কার্যক্রম দেখলে বড্ড ভয় লাগে আবার যুবকদের দেশপ্রেম আর স্বদেশ প্রীতি দেখলে মনে আশা জাগে।
আন লু সান নামের একজন জেনারেল ৭৫৫ সালে চীনের কেন্দ্রীয় শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে নিজের অধীনে থাকা অঞ্চলকে স্বাধীন ঘোষণা করেছিলেন – এই বিদ্রোহ দমনের জন্য চীনের কেন্দ্রীয় শাসক চীনা সম্রাট উইঘুর খানাতেরর কাছে সাহায্য চান। উইঘুর খানাতের সহায়তায় আন লু সাং এর বিদ্রোহ দমন করা হয় – কিন্তু চিনা সম্রাট উইঘুর দের প্রতি কৃতজ্ঞতা দেখান নি- তিনি উপকারী উইঘুর দের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে খোদ খানাতকেই দখল করে নিতে উদ্যত হয় –
# উইঘুর খানাত এর লোক জন ছিল স্বাধীনচেতা- তাদের স্বল্প শক্তি আর স্বল্প জনবল হওয়া সত্ত্বেও তারা বিশ্বাস ঘাতক চিন সম্রাটের বিপুল জনবল আর শক্তিশালী চিনা সেনাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় । উইঘুর রা চিনা বাহিনীর সাথে পেরে উঠতে পারে নি – তাই ব্যাপক সংখ্যক উইঘুর সেনা নিহত হবার পরে স্বল্পসংখ্যক বেঁচে থাকা উইঘুর সেনা পিছু হটে এবং কোচো রাজত্বে আশ্রয়গ্রহণ করে। মুলত তখন থেকেই শুরু হয় তাদের টিকে থাকার লড়াই।
# ১০০৬সালে ইউসুফ কাদির খান নামক একজন তুর্কি যোদ্ধা উইঘুরদের ত্রাণকর্তা হয়ে হাজির হন । তাঁর নেতৃত্বেই পুনরায় মুসলিম সালতানাত ‘কারা খানিদ খানাত’ প্রতিষ্ঠিত হয়। এই রাজ্য প্রায় আটশত বছর টিকে ছিল কিন্তু জুনগড় এবং তারিম উপত্যকার পূর্বাঞ্চল দখলের মাধ্যমে চিনা সামন্ত রাজারা ১৮ শতকের শেষের দিকে স্বাধীন কারা খানিদ খানাত নামক উইঘুর দের রাজ্যকে আবার নিজেদের অধীনে নিয়ে নেয়।
# তখন তাসখন্দ নিবাসী ইয়াকুব বেগ নামক এক লোক উইঘুরদের ত্রাণকর্তা হিসেবে হাজির হন । এই ইয়াকুব বেগ এর নেতৃত্বে উইঘুররা যুদ্ধে জয়ী হয়ে কাশগরের আশপাশের অঞ্চল নিয়ে গড়ে তোলে শরিয়াভিত্তিক স্বাধীন কাশগরিয়া রাষ্ট্র। আধুনিক পূর্ব-তুর্কিস্তান নামক রাস্টটির মূল ভিত্তি হিসাবে ইয়াকুব বেগের অর্জিত কাশগরিয়া রাষ্ট্রকেই ধরা হয় । ইয়াকুব বেগ কে তুরস্কের উসমানি খেলাফতের খলিফা ‘আমিরুল কাশগরিয়া’ উপাধি প্রদান করেন।
১৮৭৭ সালের ২২ মে আমিরুল কাশগরিয়া’ উপাধি প্রাপ্ত ইয়াকুব বেগ মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর পর পরই চীনের কিং রাজা ও রাশিয়ার জার শাসকরা স্বাধীন ইসলামী উইঘুর কাশগরিয়া’ রাষ্ট্রটিকে দখল করে নিতে উঠেপড়ে লাগে।
# প্রায় সাত বছর লড়াই করার পরে ১৮৮৪ সালের ১৮ নভেম্বর চীনের মাঞ্চু বা কিং রাজা কাশগর কেন্দ্রীক পূর্ব তুর্কিস্তান স্বাধীন রাষ্ট্রটিকে দখল করে নেয় এবং সেই সাথে আমিরুল কাশগরিয়া’ উপাধি প্রাপ্ত ইয়াকুব বেগের চার সন্তান,নাতি নাতনি ও চার স্ত্রীদের সবাইকে বন্দী করা হয়। বিভিন্ন মেয়াদে তাদেরকে শাস্তি দিয়ে মাত্র ১১ বছরের মধ্যে সবাইকেই মেরে ফেলে ।
( সূত্র -উইঘুরের কান্না-মুহসিন আবদুল্লাহ,পৃষ্ঠা ১১-১৭)
# ১৯১১ সালে স্বাধীন তুর্কিস্তানে চীনের মাঞ্চু সাম্রাজ্যের পতনের পর সেখানে প্রত্যক্ষ চীনা শাসন চালু করে এ অঞ্চলকে চীনের জিনজিয়াংয়ের সাথে একীভূত করা হয়। (সূত্র-দৈনিক যায়যায়দিন, ২৫ মে,২০১৯)
# ১৯৩৩ সালে পুনরায় উইঘুর মুসলিমরা মাঞ্চু সম্রাজ্য থেকে আলাদা হয়ে যায়। তারা কাশগর ও এর আশপাশের এলাকা নিয়ে প্রতিষ্ঠিত করে স্বাধীন পূর্ব তুর্কিস্তান রাষ্ট্র।
# চাইনিজ জেনারেল শেং শি চাই এর নেতৃত্বে চাইনিজ হানরা উইঘুর দের এই স্বাধীন রাষ্ট্রটিকে বেশিদিন স্বাধীন থাকতে দেয়নি । দখলদার চাইনিজ (হানদের) ব্যাপক হামলা আর আক্রমণের মুখে অল্প দিনেই এই রাষ্ট্রের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়।
# তুর্কিস্তান ইসলামী পার্টি নেতৃত্বে তিয়েশান পর্বতমালার ওপারে ঘুলজা এবং এর আশপাশের অঞ্চলে ১৯৪৪ সালে বিপ্লবের মাধ্যমে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হয় উইঘুর মুসলিমদের পূর্ব-তুর্কিস্তান। কিন্তু চীনের গৃহযুদ্ধ (১৯৪৯ ) সমাপ্ত হওয়ার পর ১৩ ই অক্টোবর চীন সরকার পূর্ব তুর্কিস্তান দখল করতে সেনা পাঠায় – দীর্ঘ ৬ বছর যুদ্ধ করার পর ১৯৫৫ সালের ১লা অক্টোবর কমিউনিষ্ট বাহিনী পুরো উইঘুর এলাকার দখল নেয়।
(সূত্র -উইঘুরের কান্না- মুহসিন আবদুল্লাহ)
আজকের জিনজিয়াং প্রদেশ যা পূর্ব তুর্কিস্থান নামে বহুবার নিজেকে প্রমান করতে চেয়েছে । সেখানকার স্বাধীন নাগরিক উইঘুর মুসলিমদেরকে কথিত সায়ত্ত্বশাসনের নামে চীনা শাসকরা পরাধীনতার শিকল পরিয়ে রেখেছে যুগ যুগ ধরে। নিজেদের ভূমিতে নিজেদের মত করে থাকতে চাওয়াটা বাসনা উইঘুর দের পুরো ইতিহাস জুড়ে দেখে গেছে – কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস – তাদের চাওয়াকে কেউ সম্মান দেখায় নি- বলেই বার বার পরধীনতার শীকল পরতে হয়েছে –
Leave a Reply