পঞ্চম শতকের দিকে যখন পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের পশ্চিম অংশ পতনের শুরুর দিকে ধাবিত হচ্ছে ঠিক সেই সময় কালেই আজকের ঐতিহাসিক নগরী ভেনিসের নির্মাণের কাজ শুরু হয়। এই সময় রোম সম্রাজ্যের উত্তরের দিক থেকে বর্বর ও অসভ্য জাতির লোক জন রোমের শাসনাধীন প্রাক্তন অঞ্চলগুলো জোর করে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য উঠে পড়ে লাগে। বর্বর জাতীর লোক জন রোম সম্রাজ্যের নতুন অঞ্চল দখল করে রোমান নাগরিক দের উপর হত্যা, ধর্ষণ সহ ব্যাপক লূটতরাজ চালাতো ।
এই সব ঝামেলা থেকে বাচতে নিরীহ রোমান বাসিন্দারা অন্য কোথাও ঘরবাড়ি তৈরির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে।অনেক চিন্তাভাবনার পর তারা সিদ্ধান্ত ন্যায় ভুমির চেয়ে জলাভুমি ভাল, কারন তাতে খুব সহজে বর্বর জাতী গুলো আক্রমন করতে পারবে না, সেই মোতাবেক তারা রোমান সম্রাজ্যের বালুময় তিনটি দ্বীপ- টরসেলো, জেসোলো এবং মালামোক্কোর কাছেই শুরু করে বসতি নির্মান, আর সেই নির্মান কাজের সাথে সাথে শুরু হয় আজকের ঐতিহাসিক শহর ভেনিস শহরের গোড়াপত্তন ।
প্রথম দিকে শুধুমাত্র বর্বর জাতির হামলা থেকে বাঁচার তাগিদেই এর বাসিন্দাগন সাময়িক সময়ের জন্য এই নির্মাণকাজ করেছিল,প্রথম দিকে তারা ভেবেছিল যখন বর্বরদের উপদ্রপ কমে যাবে তখন তারা আবার আদি ভুমিতে ফিরে গিয়ে পুর্বের ন্যায় বসতি স্থাপন করবে। কিন্তু ধীরে ধীরে তাদের এই নির্মান কাজ স্থায়ী রূপ নেওয়া শুরু করে।
শুরুর দিকে এই জায়গাটিতে শুধুমাত্র জেলেদের পরিবার, অর্থাৎ যাদের সাঁতার কাটা এবং পানির উপর বাস করার অভিজ্ঞতা অভিজ্ঞতা দু’টোই ছিল, তারাই ভেনিসে বাস করার জন্য ঘরবাড়ি নির্মান করতে থাকে। কিন্তু পরের দিকে বিভিন্ন পেশার লোক জন ও এই খানে এসে বসতি স্থাপন শুরু করে ফলে ভেনিসের বিস্তৃতি লাভ করতে শুরু করে।
প্রথমদিকে কম মানুষ থাকায় কিছু কাঠ, খড় এবং মাটির সহায়তায় কম ওজনের জিনিসের তৈরি নির্মান সামগ্রী দিয়ে অস্থায়ী ভাবে গৃহ নির্মানের কাজ শুরু করা হয়। কিন্তু পরবর্তীতে অনেক লোজ জন এখানে আসার ফলে দেখা যায় অস্থায়ী ভাবে তৈরী এই সব বাসস্থানে প্রচুর মানুষের ধকল সামলাতে পারছে না। তখন সেখানকার বাসিন্দারা মজবুত এবং শক্ত ভিত্তির উপর তৈরী বাসস্থানের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে ।
দিনে দিনে রোমান সম্রাজ্যের নানা প্রান্তে বহিশ্ত্রুর আক্রমণ বেড়ে যেতে থাকে। আর তখন ওই আঞ্চলের মানুষ জীবন বাচাতে ঐ সব অঞ্চল থেকে ভেনিসে এসে বসবাস শুরু করে। জলাভুমিতে আক্রমন করা কস্টকর হবে ভেবে তারা তখন ভেনিসকে নিরাপদ মনে করেছিল, বহিঃশত্রুদের আক্রমণ থেকে বাচার তাগিদে আসা এই লোক জন গুলোই এক নিজেদের আবাসস্থল ছেড়ে স্থায়ী ভাবে সমুদ্রের উপর বসবাসের সিদ্ধান্ত নেয়।
বাসস্থানের ভিত্তিকে মজবুত এবং টেকসই করতে কোনো শক্ত মাধ্যমের প্রয়োজন আছে, আর এক্ষেত্রে বাসিন্দারা এই প্রয়োজনীয়তা কাঠের সাহায্যে পূরণ করে । কাঠের খুঁটি, কাঠের পাটাতন একের পর এক জোড়া লাগিয়ে শুরু হয় ভেনিস নির্মাণের কাজ। দুর্ভোগের সময় ভিত্তি তৈরির জন্য শুধু কাঠের যোগাড় করাই তাদের পক্ষে করা সম্ভব ছিল। তাছাড়া, এসব নির্মাণকাজে তখন আধুনিক যন্ত্রপাতিও ছিল না। তাই কাঠই হয়ে দাঁড়ায় তাদের ভিত্তি নির্মাণের মূল উপকরণ।
সাধারণত কোনো ভবন বা সেতু তৈরিতে লোহার বা কোনো শক্ত মাধ্যম ভিত্তি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আসল কথা হলো, এমন কোনো ভিত্তি লাগবে, যা কাঠামোর ভার নিতে পারবে এবং দীর্ঘমেয়াদেও সহজে নষ্ট হবে না। লোহা এবং কংক্রিটের ব্যবহার দেখে অভ্যস্ত লোকেদের কাঠের ভিত্তির উপর এমন নির্মাণ দেখে আশ্চর্য হতেই হয়। আর কিছু না হোক, পানির নিচে কাঠের খুঁটি থাকা সত্ত্বেও তা পচে যাচ্ছে না কেন, তা তো ভাবার মতোই একটি বিষয়। ভিত্তিতে কোনো রকম পচন দেখা যায়নি ভেনিসের ক্ষেত্রে।
ভেনিস শহর নির্মাণে ব্যবহৃত হয় ওক এবং লার্চ গাছের কাঠ। প্রায় ৬০ ফুট লম্বা কাঠের খুঁটি পানির নিচে নরম কাদা এবং পাথরের নিচে শক্ত করে প্রতিস্থাপিত হয়। শত শত বছর ধরে পানির নিচে থাকা এসব গাছের কাঠের তৈরি খুঁটি এবং তক্তাই নগরীর ভবনগুলোকে নিজের জায়গায় ধরে রেখেছে। স্বাভাবিকভাবেই মনে প্রশ্ন জাগে যে, কাঠের খুঁটি এত বছর ধরে পানির নিচে থাকা সত্ত্বেও টিকে আছে কীভাবে?
এতদিনে তো এগুলো পচে নষ্ট হয়ে যাওয়ার কথা। এক্ষেত্রে কিছু বৈজ্ঞানিক যুক্তি দিয়ে বিষয়টি ব্যাখ্যা করা যায়। কাঠের পচন শুধুমাত্র তখনই শুরু হয়, যখন পরিবেশে পানি এবং অক্সিজেন উভয়ই উপস্থিত থাকে। গভীর সমুদ্রে বা জলাশয়ে অক্সিজেন অনুপস্থিত। যদি থাকেও, তাহলে তা পরিমাণে একেবারেই নগণ্য। আর একারণেই পানির গভীরে থাকার পরও কাঠে পচন ধরতে পারে না। ফলে, নগরীর ভিত্তিগুলোও শক্তভাবে টিকে আছে। তাছাড়া ভিত্তিগুলো তৈরিতে ব্যবহৃত ওক এবং লার্চ গাছের কাঠ অত্যন্ত পানি প্রতিরোধী।
সাগরের উপর ভাসমান বলে ভেনিস নগরী টিকে থাকতে ঝুকির মধ্যে পড়ে, কারন পানি উপর দন্ডায়নমান ঘরবাড়ি সমূহের ভিত্তি গুলো নড়বড়ে হতো কিংবা সরে যেত। কিন্তু এ যাত্রাও সফলভাবে পার করতে সক্ষম হয়েছে শহরটি। টিকে থাকার লড়াইয়ে ভেনিসের বাসিন্দাদের মনের এই শঙ্কা জয় করতে তাদের সাহায্য করেছে ক্যারেন্টো। সাগরের গভীরে পলিমাটির নিচে একটি শক্ত মাটির স্তর থাকে। একে বলা হয় ক্যারান্টো। সাগরের লবণাক্ত পানিতে থাকা খনিজ পদার্থ দিয়ে ক্যারেন্টো নামক শক্ত মাটির স্তরটি তৈরী হয়। ভেনিসের বাসিন্দারা তাই তাদের বাড়ি নির্মানের সময় বাড়ির খুটি গুলোকে ক্যারেন্টো স্তর বরাবর পুতে দিত। আর এই ক্যারেন্টো স্তরে খুঁটিগুলো স্থাপন করার ফলে ভিত্তিও বেশ মজবুত আকার ধারন করে।
এছাড়া সাগরের জলাভূমির গভীরে থাকা খুঁটির নিচের অংশে সাগরের পানির টানে প্রতিনিয়ত নুড়ি, পাথর, মাটি এসে জমা হয়, যার ফলসরূপ বাড়ির তৈরির জন্য ব্যাবহার করা খুঁটিগুলোর সাথে মাটির সংযোগ আরো মজবুত করে। ফলে দিনের পর দিন খুঁটি সরে যাওয়ার বদলে তা আরো টেকসই হয়। কাঠ এসব পলিমাটি শোষণ করে শক্ত খুঁটিতে পরিণত হয়েছে। আর এক্ষেত্রে সমুদ্রের লবণাক্ত পানি সহায়তা করেছে। পানিতে থাকা খনিজ পদার্থগুলো এই ভিত্তি শক্ত করতে ভূমিকা রেখেছে।
ভেনিস শহরে ১৭ শতকে নির্মান করা সান্তা মারিয়া ডেলা স্যালুট চার্চ এর নির্মাণে ব্যবহৃত হয়েছে ১১,০৬,৬৫৭টি কাঠের খুঁটি । প্রতিটি খুঁটির উচ্চতা ছিল প্রায় ৪ মিটার। চার্চটি নির্মাণ করতে সময় লাগে দু’ বছর দু’মাস। প্রক্রিয়াটি বেশ কষ্টকর, তাই সময় বেশি লাগারই কথা। তাছাড়া কাঠের যোগাড় করতে হতো অন্য জায়গা থেকে। আর যোগাড় করে পানিপথে আনা হতো কাঠগুলো। এ শহর নির্মাণের জন্য ব্যবহৃত কাঠগুলোর অধিকাংশই আসে স্লোভেনিয়া, ক্রোয়েশিয়া এবং মন্টিনিগ্রো থেকে। সান্তা মারিয়া ডেলা স্যালুট চার্চ এর মত অন্য বাড়ি গুলো ও এভাবেই নির্মান করা হয়, আর এভাবেই মহনীয় ভেনিস নগরী তার জৌলুস ধরে রাখে।
অনন্য সৌন্দর্যে ঘেরা শহরটির পরিস্থিতি এখন অবনতির পথে। কাঠের ভিত্তির উপর তৈরি ভাসমান নগরী ভেনিস ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছে পানির নিচে। ২০০০ থেকে ২০১০ সালের এক হিসাবে দেখা গেছে, প্রতি বছর গড়ে ০.০৪ থেকে ০.০৮ ইঞ্চি ভূমি চলে যাচ্ছে সাগরের নিচে। এর একটি কারণ অবশ্যই সমুদ্রের পানির স্তর বেড়ে যাওয়া। আর এর পেছনে দায়ী বৈশ্বিক উষ্ণতা। তবে, এই একটি কারণেই ঐতিহ্যবাহী ভেনিস শহরকে এই দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে না। আরো কারণ রয়েছে। যেমন- মাটির গভীর থেকে প্রতিনিয়ত পানি উত্তোলন করা। এর ফলে সমুদ্রের তলদেশের খনিজ স্তর আরো নিচের দিকে চলে যাচ্ছে। ফলে শহরটির ভিত্তি হয়ে যাচ্ছে দুর্বল। তবে মাটির গভীরতলে পানি উত্তোলন হওয়ায় এই ঝুঁকি কমে গেলেও বাকি ঝুঁকি রয়েই গেছে।
Leave a Reply