১৯১২ খ্রিষ্টাব্দে ত্রয়োদশ দলাই লামা ১২ই ফেব্রুয়ারি চীনের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে তিব্বতকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করেন। কিন্তু তিব্বতী সেনাবাহিনীকে আধুনিকীকরণের ব্যাপারে ত্রয়োদশ দলাই লামার প্রচেষ্টা তিব্বতের শক্তিশালী অভিজাত ও লামা সম্প্রদায়ের বিরোধিতায় সম্পূর্ণ রূপে ব্যর্থ হয়।
ব্রিটিশ ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ব্যতীত বিশ্বের অন্য কোন রাষ্ট্রের সঙ্গে তাঁদের বৈদেশিক সম্পর্ক ছিল না বললেই চলে। এরফলে তিব্বত কূটনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন থাকায় তার অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলির সম্বন্ধে আন্তর্জাতিক রাষ্ট্রগুলিকে অবহিত করতে ব্যর্থ হয়। ১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দে জাতীয়তাবাদী চীন সরকারের প্রতিনিধিদের তিব্বত থেকে বিতাড়ণ করা হয়।
১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে গণচীন সরকার তিব্বত, তাইওয়ান ও হাইনান দ্বীপকে বলপূর্বক অথবা শান্তিপূর্ণভাবে চীনের মূল ভূখণ্ডের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করাকে নিজেদের প্রধান কাজ বলে গণ্য করে। তিব্বত চীনের পরাধীনতা স্বীকারে অপারগ থাকায় মাও সে তুং তিব্বত সরকারকে মধ্যস্থতায় বসতে বাধ্য করার উদ্দেশ্যে ঐ বছর ডিসেম্বর মাসে চীনা বাহিনীকে চামদো আক্রমণ করার প্রস্তুতি নেওয়ার আদেশ দেন।
১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে তিব্বত সরকারের পক্ষ থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও মাও সে তুংয়ের নিকট পত্র পাঠিয়ে জানিয়ে দেওয়া হয় যে, গণচীনের সমস্ত রকমের সামরিক অভিযান প্রতিরোধ করতে তিব্বত বদ্ধপরিকর। এই সময় তিব্বতী সেনাবাহিনীকে দ্রুত আধুনিকীকরণের একটি প্রচেষ্টা করা হয়। ভারত কিছু অস্ত্রসাহায্য ও সামরিক প্রশিক্ষণ দিলেও চীনের সামরিক বাহিনী তুলনায় অনেক বেশি সংগঠিত, অস্ত্রসমৃদ্ধ, বৃহৎ ও অভিজ্ঞ বাহিনী ছিল।
বেশ কয়েক মাসের ব্যর্থ আলোচনা ও তিব্বতীদের বৈদেশিক সমর্থনলাভের ব্যর্থ প্রচেষ্টার পর চীনের সামরিক বাহিনী ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসের ৬ ও ৭ তারিখ জিনশা নদী অতিক্রম করে। চীনা বাহিনীর দুইটি দল খুব শীঘ্রই তিব্বতী সেনাবাহিনীকে চারিদিক দিয়ে ঘিরে ১৯শে অক্টোবরের মধ্যে চামদো অধিকার করে নেয়। এই লড়াইয়ে ১১৪ জন চীনা ও ১৮০ জন তিব্বতী সৈন্য নিহত বা আহত হন। এই অভিযানে চীনা সেনাপতি ঝাং গুয়োহুয়ার মতে, ৫৭০০ জন তিব্বতী নিহত হন এবং ৩০০০ জন শান্তিপূর্ণ ভাবে আত্মসমর্পণ করেন। খাম্স অঞ্চলের তিব্বতীরা চীনা বাহিনীর চামদো আক্রমণের বিরুদ্ধে কোন ধরনের প্রতিরোধ না গড়ে তোলায় চীনের সামরিক বাহিনী প্রায় বিনা প্রতিরোধে খাম্স অঞ্চল অধিকার করে নেয়।
চীনের সামরিক বাহিনী তিব্বত আক্রমণের সময় ঙ্গা-ফোদ-ঙ্গাগ-দ্বাং-‘জিগ্স-‘মেদ (ওয়াইলি: nga phod ngag dbang ‘jigs med) নামক চামদো অঞ্চলের তিব্বতী সেনার সর্বাধিনায়ককে বন্দী করে। পরে তাঁকে মুক্ত করে চতুর্দশ দলাই লামার নিকট মধ্যস্থতার জন্য পাঠানো হয়। চীনাদের তরফ থেকে জানানো হয় যে, তিব্বতকে শান্তিপূর্ণভাবে মুক্তি দেওয়া হলে তিব্বতী অভিজাতদের তাঁদের ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি বজায় রাখতে দেওয়া হবে।
এরপর তিব্বত সরকার তাঁদের পক্ষ থেকে বেইজিং শহরে তাঁদের প্রতিনিধিদল পাঠাতে সম্মত হন। তিব্বতী প্রতিনিধিদল বেইজিং পৌছলে তাঁদেরকে তিব্বতের শান্তিপূর্ণ মুক্তির সতেরো দফা চুক্তি নামক একটি পূর্বপ্রস্তুত চুক্তি প্রদান করা হয়। চীনের তরফ থেকে মধ্যস্থতার কোন বার্তা না থাকলেও তাঁরা তিব্বতকে চীনের অংশ হিসেবে রেখে তিব্বতের অভ্যন্তরীণ বিষয়, ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সংস্কারব্যবস্থা তিব্বতীদের হাতে রাখার কথা বলেন। এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে স্বাক্ষরের পূর্বে তিব্বতী প্রতিনিধিদলকে তাঁদের সরকারের সঙ্গে আলোচনার কোন সুযোগ দেওয়া হয় না এবং ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দের ২৩শে মে তাঁরা এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে বাধ্য হন। এরফলে তিব্বতে সাম্যবাদী চীনের শাসন এবং চীনের সামরিক বাহিনীর উপস্থিতিকে বৈধতা প্রদান করা হয়।
তিব্বত সরকারের সঙ্গে কোন রকম আলোচনা না করে শুধুমাত্র তিব্বতী প্রতিনিধিদলের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ায় এই চুক্তির বৈধতা মানার ব্যাপারে তিব্বত সরকার দ্বিধাবিভক্ত হয়। এইসময় চতুর্দশ দলাই লামা সরকারের প্রধান হিসেবে অধিষ্ঠিত হলে তিনি অক্টোবর মাসে এই চুক্তির শর্ত মানতে প্রস্তুত হন। এরফলে কার্যতঃ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষিত তিব্বত গণচীনের অধীনে একটি স্বয়ংশাসিত অঞ্চলে পরিণত হয়।
চীনের শাসনাধীনে তিব্বতের সরকার ও সামাজিক গঠন অপরিবর্তিত থাকলেও ১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দের তিব্বতী বিদ্রোহের পর চতুর্দশ দলাই লামা ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করলে তিব্বত সরকারকে লোপ করে দেওয়া হয়।
(সুত্র: অন্তর্জাল)
Leave a Reply