১৭২৫ সালে আয়ারল্যান্ডের এক মাঝারি জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করা লর্ড ক্লাইভ খোদ নিজ জন্ম ভূমিতে তেমন পরিচিত না হলে ভারতীয় উপমহাদেশের এক ঐতিহাসিক চরিত্র। ষড়যন্ত্রকারী দের শিরমনি ও সুচতুর এই ইংরেজ সৈনিকটির কারনেই ভারত উপমহাদেশে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা লাভ করে।একজন ষরযন্ত্র কারী হিসাবে ক্লাইভের কৃতকর্মের কথা আমরা সবাই জানি, তিনি কি ভাবে, কোন পন্থায় বাংলা বিহার উড়িষ্যায় ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন,কিন্তু আমরা কয়জন বা জানি এই ষরযন্ত্রকারীর শেষ পরিনতি কি হয়েছিল? তাই সৃজনশীল বাংলা ব্লগ কালাক্ষর এর আজকের আয়োজনে থাকছে লর্ড ক্লাইভ এর জীবনের শেষ পরিণতি কি হয়েছিল সেই প্রসঙ্গেই।
রবার্ট ক্লাইভ এর ঠকুজি
লড ক্লাইভ স্কুলজীবনে ছাত্র ছিলেন না। তাই পরিক্ষায় আশানুরূপ ফলাফল করতে না পারার কারনে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এক জন সামান্য কর্মচারী হিসেবে ১৭৪৩ সালে মাদ্রাজ চলে আসেন। মাদ্রাজে ইংরেজদের প্রতিদন্দি ফরাসিদের হাতে একবার বন্দী হন এবং উপস্থিত বুদ্ধি খাটিয়ে বন্দিদশা থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন।
এর পর ১৭৪৮ সালে ক্লাইভ ইস্ট ইন্ডিয়ার কোম্পানির চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে মাদ্রাজে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর সাহাযার্থে আগত ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে সর্বনিম্ন কমিশনপ্রাপ্ত অফিসার হিসেবে যোগদান করেন। অতি উচ্ছৃঙ্খল, উগ্র ও হটকারী সিদ্ধান্তের অধিকারী ক্লাইভ সেনাবাহিনীতে যুক্ত হয়ে দেবীকোট দুর্গ দখল করেন এবং আর্কট অভিযান পরিচালনা করেন। এই দুই অভিযানে তিনি প্রশংসনীয় সাফল্য অর্জন করেন। ১৭৫৩ সালে ক্লাইভ মাতৃভুমি ইংল্যান্ডে প্রত্যাবর্তন করেন। সেখানে ‘কোর্ট অব ডাইরেক্টস’ তাঁর বীরোচিত ভুমিকার জন্য রত্নখচিত তরবারি উপহার দেওয়ার মাধ্যমে তাঁকে ‘জেনারেল ক্লাইভ’ বলে অভিহিত করে ।
লন্ডনে বীরোচিত সংবর্ধনার পর জনাব লর্ড ক্লাইভের ঘাড়ে রাজনীতির ভুত চাপে। এই কারণে ক্লাইভ সেনাবাহিনীর চাকরি থেকে ইস্তফা দেন এবং পার্লামেন্টে আসন লাভের জন্য নির্বাচন করার চেষ্টা করেন। কিন্তু পুর্বেই বলেছি ক্লাইভ ছিল অতি উচ্ছৃঙ্খল, উগ্র ও হটকারী সিদ্ধান্তের অধিকারী আর তাই যথেষ্ট সুযোগ থাকার পরেও শুধু মাত্র ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক জীবনে অসংযত আচরণের জন্য রাজনীতি তে সফল হতে পারেন না। উপরুন্ত এই কারনে তার ধন সম্পদ ও সামাজিক মর্যাদা উভয়েই হারিয়ে ফেলেন । অবশেষে ১৭৫৫ সালে প্রচন্ড হতাশাগ্রস্ত হয়ে আবার মাদ্রাজে ফিরে আসেন।
মাদ্রাজে এসে লেফটেন্যান্ট কর্নেল পদে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে ক্লাইভ হায়দ্রাবাদের নিজামের বিরুদ্ধে অতর্কিতে আক্রমণ করে ১৭৫৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে গেরিয়া দুর্গ অধিকার করেন এবং সাথে নিজামের শত্রু মারাঠাদের সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন করেন। ক্লাইভের দুরদর্শিতা, রণকৌশল এবং বিচক্ষণতার প্রশংসায় যখন মাদ্রাজের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীতে কর্ম রত ইংরেজরা উৎসবমুখর অবস্থায় ছিলেন,ঠিক তখনি সংবাদ আসে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার মসনদে আসিন নতুন নবাব সিরাজউদ্দৌলার হাতে কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গের পতন হয়েছে। এবং ফোর্ট উইলিয়ামের বিতাড়িত ইংরেজরা ফলতায় গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে এবং তারা জল খাদ্যের অভাবে মৃতপ্রায় হয়ে আছে।
মাদ্রাজের বিজয়ী ইংরেজরা কলকাতায় বিপদগ্রস্ত ইংরেজদের রক্ষায় সর্বাপেক্ষা যোগ্য বিবেচনা করে ক্লাইভকে। ১৭৫৬ সালের ১৬ অক্টোবর রবার্ট ক্লাইভ একদল সেনা নিয়ে নৌপথে মাদ্রাস থেকে যাত্রা শুরু করে এবং ডিসেম্বর মাসে তিনি ফলতায় পৌছান। ক্লাইভের এই নৌ পথে আগমনের সাহায্যকারী হিসেবে ছিলেন অ্যাডমিরাল ওয়াটসন নামক এক ইংরেজ। ক্লাইভ ফলতায় এসেই ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ পুনরাদ্ধার করতে অভিজান শুরু করে। ক্লাইভ ও ওয়াটসনের এই যৌথ অভিযানের ফলে ১৭৫৭ সালের ২ জানুয়ারি কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গের পুনর্দখল করে ইংরেজ বাহিনী । ৯ ফেব্রুয়ারি সিরাজউদ্দৌলার সঙ্গে অনুকুল শান্তিচুক্তি সম্পাদন করে।
কলকাতা বিজয়ের পর ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গের সিলেক্ট কমিটির স্বঘোষিত গভর্নর হন ক্লাইভ। অগ্রজ ও যোগ্য অ্যাডমিরাল ওয়াটসনম,রজার ড্রেক, রিচার্ড বেকারকে উপেক্ষা করে ক্লাইভ এ পদে নিজেকে অগণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত করেন। স্বনির্বাচিত পদে যাতে ক্লাইভ নিরাপদ থাকতে পারেন এই জন্য অ্যাডমিরাল ওয়াটসনম,রজার ড্রেক, রিচার্ড বেকার সহ বিরুদ্ধপক্ষকে সামরিক হুমকিও দেন তিনি। গভর্নর হিসেবে অবস্থান নিশ্চিত করার পর ক্লাইভ কলকাতা থেকে ফরাসিদের তাদের দখল করা জায়গা থেকে বিতারণ করার এবং পলাশী যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। শত্রুভাবাপন্ন নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে ক্ষমতাচ্যুত করে, তাঁর পরিবর্তে একজন অনুগত ব্যক্তিকে মুর্শিদাবাদের ক্ষমতার মসনদে বসাতে তৎপর হন ক্লাইভ।
এর ভিতর ১৭৫৭ সালের মার্চ মাসে ক্লাইভ চন্দননগরের ফরাসি উপনিবেশ অধিকার করেন। ফরাসি উপনিবেশ অধিকার করার পর ক্লাইভ নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে উৎখাত করার জন্য জগৎ শেঠ ও উমিচাঁদের সঙ্গে একটি ষড়যন্ত্রমূলক চুক্তি করেন ১৭৫৭ সালের ১৯ মে মাসে । সেই ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনা অনুযায়ী পলাশীর প্রান্তরে একটি প্রহসনমূলক যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে নবাবের পরাজয় হয় পুর্ব নির্ধারিত ভাবে। নবাব বন্দী হন এবং তাঁকে হত্যা করা হয়। আর চুক্তি অনুযায়ী মুর্শিদাবাদের মসনদে বসেন সিরাজের প্রধান সেনাপতি বিশ্বাস ঘাতক মীরজাফর আলী খান।
রবার্ট ক্লাইভের ষড়যন্ত্রে বাংলার স্বাধীনতা ইংরেজদের দ্বারা লুন্ঠিত হয়। এই ঘটনায় ক্লাইভ ইংরেজ জাতির কাছে আরো অধিক মাত্রায় সম্মানিত ও খ্যাতিমান হলেও ভারতীয়দের কাছে ঘৃণিত ও খল হিসেবেই চিহ্নিত হয়ে যান। রবার্ট ক্লাইভ দক্ষিণ ভারতে ধারাবাহিকভাবে বিজয়ী হলেও সম্পদশালী হতে পারেননি। কিন্তু বাংলা বিজয়ের পর লুন্ঠিত ও প্রাপ্ত অংশের অর্থে তিনি বাংলার সব নবাব অপেক্ষা ধনী বনে যান। অবশেষে ১৭৬০ সালে ক্লাইভ অবসর গ্রহণের পর এই দেশ থেকে আহরিত বিপুল অর্থবিত্ত জাহাজ ভর্তি করে লন্ডন চলে যান।
ইংল্যান্ডে গেলে রবার্ট ক্লাইভ জাতীয় বীরের সম্মানে ভুষিত করে ’, ‘নাইট অব দ্য বাথ’, ‘ব্যরন ক্লাইভ অব পলাশী,দিলার জং’, ‘সাইফ জং’ ‘সাবদাতুল মুলক’ ‘মামিরুল মামালিক’,ইত্যাদি উপাধি ও খেতাবে ভুষিত করা হয়। এর বেশ কয়েক বছর পর বাংলায় কোম্পানি শাসন পরিচালনার অপরিহার্য প্রয়োজনে আবার ক্লাইভের ডাক পড়ে। তিনি ১৭৬৫ সালে কলকাতায় আসেন। এইবার বাংলায় এসেই তিনি ষড়যন্ত্র আর ভয় ভীতি দেখিয়ে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার দিওয়ানি লাভ করেন। এই ঘটনায় ক্লাইভের রাজনৈতিক দুরদর্শিতার পরিচয় মেলে।
তিনি দ্বৈতশাসন ব্যবস্থার প্রচলন করার মাধ্যমে ক্লাইভ ইংরেজ দের এদেশে বিনিয়োগ ছাড়া মুনাফা লাভ এবং দায়িত্ব ছাড়া রাজস্ব আদায়ের ব্যাবস্থা করে দ্যায়। যা ব্রিটিশদের অর্থনৈতিকভাবে ও রাজনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হবার পথ সুগম করে। এই কৃতিত্বের কারণে ইংরেজদের কাছে ক্লাইভ জাতীয় বীরে পরিণত হন তিনি। তাঁর পূর্ণাবয়ব ও আবক্ষমূর্তি বানিয়ে ইংরেজরা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর অফিস ও পার্লামেন্ট ভবনসহ বিভিন্ন স্থানে স্থাপন করে। এইভাবে ক্লাইভ ভারত উপমহাদেশে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেন।
কিন্তু ইংরেজদের কাছে ব্যাপক ভাবে সমাদ্রিত রবার্ট ক্লাইভ তার কর্মক্ষেত্র বাংলার জনগণের কাছে সব সময় ঘৃণিতই থেকে গেছেন। জনগণ-মনে খল হিসেবে পরিচিত হয়েছেন। একজন নিচ ও ষড়যন্ত্রকারী, শঠ ও প্রতারক হিসেবে বিবেচিত হয়েছেন চিরকাল। যাইহোক লর্ড ক্লাইভ ভারতবর্ষের দায়িত্ব পালন শেষে ফিরে যান লন্ডনে। সেখানে তিনি নিঃসঙ্গ অবস্থায় অবসর জীবনযাপন করেন। ওই নিঃসঙ্গ সময়ে বিগত জীবনের সমুদয় নিচুতা, অতীতের গ্লানি ও পাপ চিন্তায় তার মানসিক ভারসাম্য নষ্ট হয়।
ক্লাইভের জীবনীকার ম্যালকম ক্লাইভের জীবনের শেষ দিন গুলো ক্যামন ছিল সে প্রসঙ্গে বলেন−ক্লাইভ শৈশব থেকেই বিষন্নতাজীয় এক ধরণের মানসিক রোগে আক্রান্ত ছিলেন। তার জীবনের শেষ দিন গুলোতে এই মানষিক সমস্যা প্রকট আকার ধারন করে। যা তাকে মৃত্যুর দিকে টেনে নিয়ে যায়।
তবে ভারতবাসী বিশ্বাস ছিল ক্লাইভের জীবনীকার ম্যালকম সম্পুর্ন উল্টো , প্রত্যেক ভারতবাসী ক্লাইভের অসুস্থতাকে তার কৃত কর্মের শাস্তি হিসেবে বিশ্বাস করে। ক্লাইভের পাপই তাঁকে মানসিক ভাবে অসুস্থ করে দিয়েছিল । ১৭৭৪ সালের ২২ নভেম্বর নিজের করা পাপের চিন্তায় জর্জরিত ও অভিশপ্ত লর্ড রবার্ট ক্লাইভ নিজ গৃহে নিজের পিস্তলের গুলিতে আত্মহত্যা করেন। ক্লাইভের মৃত্যুতে অনেক ইংরেজই বেদনার্ত হয়ে কেঁদেছে। তবে একজন ভারতবাসীও কি সেদিন কেঁদেছে? নাকি গোপনে আনন্দ উল্লাস করেছে? তা আপনাদের কাউকেই বলে দিতে হবে না।
Leave a Reply