টাই এর অর্থ গলাবন্ধনী। ফ্যাশন বলুন আর সামাজিক অবস্থার প্রদর্শন বলুন টাই খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি টপিক হিসেবে ফ্যাশন জগতে খুব সমাদৃত হয়ে আসছে বহুকাল ধরেই। বর্তমানে ফরমাল পোশাকের সাথে হাল ফ্যাশনের গলাবন্ধনী ব্যবহার যেন স্টাইলের ষোলো কলা পুর্ন করে । যদিও টাই শব্দটা খুবই গুরুগম্ভীর হিসেবে আমাদের সাথে ছোট বেলা থেকেই পরিচিত হয়েছিল। কারন আমরা যারা মফস্বলে বড় হয়েছি তারা ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি, একজন গ্র্যাজুয়েটের নিদর্শন হল টাই মানে গলাবন্ধনী। কারো গলায় যদি দেখা যায় গলাবন্ধনী আটা রয়েছে, ধরে নিতে হবে সে একজন গ্র্যাজুয়েট, স্নাতক সম্পন্ন করেছে। তুমিও যেদিন স্নাতক সম্পন্ন করবে। সেদিন থেকে গলাবন্ধনী পড়া শুরু করতে পারবে। যদিও আজকাল সবাই টাই পড়ে,তাই এখন আর এই কথা বলা যাবে না যে এটা স্নাতক/গ্র্যাজুয়েট এর নিদর্শন। ফ্যাশন হিসেবে টাই খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে । সৃজনশীল ব্লগ কালাক্ষর এ আজ আমরা জানবো, কীভাবে আমরা এই টাই এর ব্যাবহারের সাথে পরিচিত হলাম।
টাইয়ের ব্যাবহারে উৎপত্তি এর সাধারন ঘটনা প্রসঙ্গে যে কারন মনে এই প্রশ্ন ই চলে আসবে যে, শীতের হাত থেকে গলা বাঁচাতে একটুকরো একটা কাপড়, গলায় বেঁধে দিয়ে দিলে কেমন হয়? আর যদি তা দেখতেও খারাপ না লাগে, আর এই দেখতে খারাপ না মনে হওয়াটাই টাই এর উৎপত্তি হিসাবে গণ্য করা যেতে পারে।
সপ্তদশ শতাব্দীতে ফ্রান্সের মাটিতে ৩০ বছর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ (১৬১৮-১৬৪৮) হয়েছিল, এই যুদ্ধের এক পক্ষের নেতৃত্বে ছিলেন রাজা ত্রয়োদশ লুই। মুলত তার কারনেই বর্তমানে টাইয়ের বহুল ব্যাবহার শুরু হয়। ওই সময় হঠাৎ করেই সৈনিকদের গলায় এক টুকরো কাপড় শোভা পেতে দেখা যায়। অন্তত টাইগুলোর উৎপত্তি সম্পর্কে গবেষকদের নানা গবেষনায় এই ধারণা ই ব্যাপক আকারে শোনা যায়। তখনকার সময়ে একদেশ অন্যদেশ থেকে সৈনিক ভাড়া করত,ভারাটিয়া সৈনিকরা অর্থের বিনিময়ে যুদ্ধ লড়ত। এর ধারাবাহিকতায় রাজা ত্রয়োদশ লুই ও তার সপক্ষের নিতিনির্ধারকরা তাদের পক্ষে যুদ্ধ করার জন্য প্রচুর সেনা ভাড়া করা শুরু করে। এর ধারাবাহিকতায় তারা ক্রোয়েশিয়া থেকে কিছু ক্রোয়েশিয়ান সৈনিক ভাড়া করে নিয়ে আসে। ক্রোয়েশিয়ান সেই যোদ্ধাদের সকলের গলায় এক টুকরো করে কাপড় আটকে রাখতো।ক্রোয়েশিয়ান সৈনিকরা যুদ্ধের সময় জ্যাকেট পরতে হতো,তারা তাদের জ্যাকেটকে গলা পর্যন্ত আটকিয়ে রাখতে গলার সাথে কাপড়ের টুকরো বেঁধে রাখতো, লম্বা গলার অধিকারী ক্রোয়েশিয়ান সৈনিকদের তাতে দেখতেও ভাল লাগতো।
ক্রোয়েশিয়ান সৈনিকদের গলায় এমন টুকরো কাপড় দেখে মোহিত হয়ে যান রাজা ত্রয়োদশ লুই । তার কাছে ভাল লেগে যাওয়ায়, তিনি রাজকীয় সভাগুলোতে তার সকল সভাসদদের জন্য গলায় টুকরো কাপড় বেঁধে আসার আইন জারি করেন। আর যেহেতু, ক্রোয়েশিয়ানদের থেকে এমনটা শুরু হয়েছে, ত্রয়োদশ লুই তাদের সম্মানে এর নাম দেন “La Cravate”।
গলাবন্ধনীর আরো পুরনো এক গল্প পাওয়া যায় চৈনিক সভ্যতায়। ২১০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে চীনের সম্রাট ছিলেন শিহ্ হুয়াং তি। সম্রাট শিহ্ হুয়াং তি এর সময়কালীন প্রত্যেক সৈনিকের গলায় সিল্কের তৈরি এক ধরনের টুকরো কাপড় পেঁচিয়ে রাখার রেওয়াজ চালু ছিল বলে জানা যায়।খ্রিষ্টপূর্ব ১১৩ তে রোমান সাম্রাজ্যেও পাওয়া যায় এক নিদর্শন।রোমান সাম্রাজ্যে, চাকর আলাদা করে চিহ্নিত করে রাখার কাজে তাদের গলায় একটুকরো কাপড় পেঁচিয়ে রাখতে হতো,তখন কার দিনে এই পেঁচানো কাপড় দেখে মালিকেরা তাদের চাকরকে আলাদা করতে পারতেন । একে বলা হয় Bolo Tie।
গত দু’শ বছরে টাই পরিধানে পরিবর্তন এসেছে অনেকবার। ক্রোয়েশিয়ান সৈনিকেরা যে টাই পরিধান করতো, তার সামান্যই বর্তমানে রয়েছে, টাই পরিধানের আইডিয়া টা ছাড়া পুরো ফ্যাশনেই চলে এসেছে আমূল পরিবর্তন। সবথেকে বড় পরিবর্তনটি এসেছে ১৯২০ এর দশকে। টাই ই মনে হয় একমাত্র ফ্যাশনের বস্তু, যেটা গত দু’শ বছর ধরে টিকে রয়েছে। অন্য যতসব ফ্যাশন পোষাকজগতে এসেছে, সবই প্রতি দশকে পরিবর্তিত হয়ে পুরনো হয়ে গেছে। বর্তমানে আমরা যে টাই ব্যবহার করি, সেটি মূলত গত শতাব্দীতেই উৎপত্তি ঘটে।
গত শতাব্দীতে এই টাই পুরুষদের সাজপোষাকের প্রধান বস্তুতে পরিণত হয়। ১৯২০ সালের দিকে এই টাইয়ের বিবর্তনে চলে আসে আমূল পরিবর্তন, তাও আবার ভুলক্রমে। ইতিহাসে অনেকগুলো মজার ভুল রয়েছে, যেগুলো আমাদের জন্য বিপদের পরিবর্তে নিয়ে এসেছে বিপ্লব।
জেসি ল্যাংসডর্ফ নামের নিউইয়র্কের একজন টাই মেকার ছিলেন। জেসি ল্যাংসডর্ফ একদিন একটা টাই তৈরির কাজ করতে গিয়ে ভুল করে টাই এর কাপড়টির মাঝ বরাবর কেঁটে ফেলেন। অনুতপ্ত জেসি ল্যাংসডর্ফ তখন দেখেন যে, এই মাঝ খান দিয়ে কাটা টাই পড়ে আবার সেটা খুলে ফেলা যায়। তখন তার করা ভুলটি তার জন্য শপেবর হয়ে দেখা দ্যায়। কারন আগে ব্যাবহার করা টাইগুলো ছিল ফিক্সড,একবার বানিয়ে ফেললে শুধু ঐ একই স্টাইলে টাই গুলোকে বারবার পড়া যেত। কিন্তু জেসি ল্যাংসডর্ফ এর মাঝ খান দিয়ে কাটা টাই গুলো নানা ভাবে স্টাইল করে পড়া যায়।
ব্যাস শুরু হয়ে গেল জেসি ল্যাংসডর্ফ এর ডিজাইন করা টাই গুলোর প্রচলন। আর তাই বর্তমানে জেসি ল্যাংসডর্ফ এর হাতে তৈরি ডিজাইনের টাই ই ব্যাবহার করা হয়। এই ধরনের টাই পরা শেষে, গিঁট খুলে ফেলা যায়, পছন্দানুযায়ী গিঁট পরিবর্তন করা যায়। গিঁট যখন নিজের ইচ্ছামতো দেয়া যাচ্ছে, নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী পড়া যাচ্ছে বলে মানুষের মধ্যে এর ব্যাপক চাদিহা লক্ষ্য করা যায় ।
গত শতাব্দীর পুরো সময় জুড়েই টাই এর বিবর্তন হয়েছে। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়টুকু ছাড়া। যুদ্ধের দশকে মানুষ জীবন নিয়ে শঙ্কিত ছিল, তাই টাই এর উল্লেখযোগ্য কোনরকম পরিবর্তন আসেনি। বর্তমানে অনেক ধরণের টাই পাওয়া যায়। দৈর্ঘ্যভেদে, কাপড়ের নমনীয়তা, আকার-আকৃতি ইত্যাদি ভেদে। পুরুষদের নিজস্ব স্টাইলকে প্রকাশ করার জন্যই এত ব্যতিক্রমী টাই পাওয়া যায় আজকাল। তবে স্ট্যান্ডার্ড টাই এর প্রস্থ হবে ৩.২৫-৩.৫ ইঞ্চি। তবে গত কয়েকবছরে আমাদের চোখের সামনেই টাইয়ের ফ্যাশনে একটা পরিবর্তন এসেছে, হয়তো সবার কাছে আগের বড় প্রস্থের টাইগুলো বর্তমানে দৃষ্টিকটু লাগতে পারে। আজকাল সবাই অল্প প্রস্থের (২.৭৫-৩ ইঞ্চি) টাই ই পরিধান করে থাকে।
টাই পরিধানের পেছনে হাজার বছরের পুরনো আরো একটি গল্প প্রচলিত রয়েছে। গলায় এক টুকরো কাপড় বেঁধে দেয়াকেই যদি, টাই বলে মানা হয়, তাহলে সেই গল্পটিও সমর্থযোগ্য। ঠান্ডা-সর্দিতে বাঁচতে, গলায় এক টুকরো কাপড় পেঁচিয়ে রাখাটা হাজারো বছরের বেশি সময় ধরে চলে আসছে। কিন্তু সেই কাপড় কে হরেক রকমের টাইয়ের ফ্যাশন হিসেবে এসেছে সেই ৩০বছরের ফরাসী যুদ্ধ থেকেই।
টাই অনেক গুরুত্বপূর্ণ এক সাজপোশাক আমাদের জন্য। কোন ফর্মাল পোশাকে, পুরুষ হিসেবে আমরা হয়তো রঙিন কিছু পরিধান করিনা, সেটা শোভা দেয় না আমাদের। সবসময় কালো কিংবা প্রুশিয়ান ব্লু ব্যবহার করে থাকি, সাদা শার্টের সাথে কাল স্যুট, আমাদের সার্বজননীন সাজ। কাল জুতো, কাল প্যান্ট। এতকিছু সঙ্গে রঙ বয়ে নিয়ে আসার একমাত্র উপায় হল এই আমাদের টাই। আমাদের একমাত্র সুযোগ। তবে কেউ কেউ মনে করেন, টাই আমাদের শার্টের বোতামকে ঢেকে রাখছে। তবে টাই প্রধানত আমাদের গলায় শার্টকে এঁটে রাখে, গলাকে উষ্ণ রাখে।
Leave a Reply