হ্যামেলিনের বাঁশিওয়ালার কাহিনী সত্য নাকি রুপকথা? এই নিয়ে লেখার শুরুতেই আমি হ্যামিলনের নাম সংক্রান্ত বিতর্ক নিয়ে বলে নিচ্ছি। হ্যামেলিনের বাঁশিওয়ালা কে নিয়ে যে গল্পটি সবার মাঝে জনপ্রিয়তা পেয়েছে, সেই গল্পটি গড়ে উঠেছে জার্মানীর একটি শহর যার নাম hamelin কে ঘিরে। hamelin এর উচ্চারন কোথাও হ্যামিলিন কোথাও হ্যামিলন দেয়া হয়েছে। আবার বেশকিছু যায়গায় দুটো উচ্চারনই দেয়া আছে। কিন্তু যেহেতু আমাদের ছোটবেলার গল্পের বইয়ে হ্যামিলন লেখা ছিল। এই জন্য আমরা সবাই সে কম বেশি হ্যামিলন শব্দের সাথেই পরিচিত হয়েছি বিধায় এখানে আমি হ্যামিলিন না লিখে হ্যামিলন লিখছি। আপনি হয়ত জানেন না, আমাদের ছোটবেলায় পড়া সেই হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা গল্পটি বেশ কয়েকটি রুপে রয়েছে । তবে এই গল্প গুলোকে কিছুটা ঘষা মাজা করলে সব গল্পের মূল ভিত্তি একই রকম এসে দাঁড়ায়। শুনলে অবাক হবেন, হ্যামেলিনের বাঁশিওয়ালার কাহিনীটি বাস্তবে ঘটা কোন সত্য ঘটনা নাকি রুপকথা তা নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। আর তা জানাতেই আমার আজকের লিখতে বসা।
লেখাটিতে আরো যা জানতে পারবেন
হ্যামিলনের বাশিওয়ালা গল্পের হ্যামিলন শহর টি জার্মানির ওয়েসার নদীর তীরে লোয়ার স্যাক্সনি প্রদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থিত। আজকের জার্মানীর মত এতটাও উন্নত তখনকার জার্মানী ছিল ছিলনা। যাই হোক প্রায় ৭০০ বছরেরও বেশী সময় আগে সুন্দর ছিমছাম হ্যামিলন গ্রামে খুব ইঁদুরের উপদ্রব শুরু হয়েছিল। ঐ সময় সেখানে ইদুরের পরিমাণ এতটা বেড়ে গিয়েছিল যে বাসার ড্রয়ার, টেবিলের নিচে, চুলায় এমনকি চায়ের পাত্রেও ব্যাপক হারে ইদুরের দেখা মিলত। ইঁদুর গুলোর আকারে এত বড় আর সংখ্যায় এত অধিক ছিল যে, বিড়ালরাও এই সব ইদুরের পাল দেখে ভয় পেয়ে পালিয়ে যেতে শুরু করেছিল। এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ইদুরের আক্রমনে হ্যামেলিনের লোকজন দুঃচিন্তায় পড়ে গেল। শেষ পর্যন্ত সব লোকজন একত্র হয়ে সিদ্ধান্ত নিল তারা মেয়র মল্ডিন এর কাছে যাবে। মেয়রের নেতৃত্বে সবাই মিলে একজোট হয়ে ঠিক করলেন, শহরকে ইঁদুরের হাত থেকে যে বাঁচাতে পারবে তাকে মোটা অঙ্কের পুরস্কার দেওয়া হবে। সেই ঘোষণায় সাড়া দিয়ে শহরে এসে হাজির হলো রহস্যময় এক বাঁশিওয়ালা। ভাল পারিশ্রমিকেই তাকে দায়িত্ব দেয়া হলো। লোকটি বাইরে বের হয়ে নিজের রঙিন আলখাল্লাটার মধ্য থেকে দারুণ একটি বাঁশি বের করলো। সেই বাঁশি বাজাতে বাজাতে ঘুরতে থাকলো হ্যামিলনের পথে৷ সে বাঁশির এক অচেনা সুরের আকর্ষণে শহরের হাজার হাজার ইঁদুর দলবেঁধে ছুটছে লোকটির পেছনে পেছনে৷। বাশিওয়ালা হাটতে হাটতে গেলো শহরের পাশের ওয়েজার নদীর বাঁকে। ইদুর গুলো ঝাপিয়ে পড়লো নদীতে। শহর হলো ইঁদুর মুক্ত।
ইমেজ সোর্স -steemit.com
পারিশ্রমিক দেবার বেলায় বেকে বসলো শহরবাসী। রেগে গেলো বাঁশিওয়ালা। বের করলো এক নতুন বাঁশি। বাজাতে বাজাতে হেটে চললো শহরের বাইরে। সেই বাঁশির সুরে শহরের ঘর গুলো থেকে এবার বেড়িয়ে এলো ছোটবাচ্চারা। সবাই যেন সম্মোহিত। বাবা মা কারো ডাক শুনল না সবাই আনন্দে ছুটলো বাঁশিওয়ালার পেছনে। পাহাড়ের ওখান থেক সব বাচ্চা নিয়েই বাঁশিওয়ালা যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো। ফিরে এলো মাত্র দুইজন। একজন ছিলো বোবা যে সব দেখলেও কিছু বলতে পারলো না। অন্যজন ছিল অন্ধ যার বলার ক্ষমতা থাকলেও কোথায় গেল তা দেখতে পারলো না। কোনদিন আর বাঁশিওয়ালাকে দেখা যায়নি আর।
হ্যামেলিনের বাঁশিওয়ালা কে নিয়ে ঘটা ইতিহাস বিখ্যাত ঘটনাটির ভিত্তি নিয়ে যদিও বিতর্কের শেষ নেই। তার পরেও বলা হয়ে থাকে যে, ১২৮৪ সালের ২২ জুলাই ঘটনাটি সত্যই ঘটেছিল। আর অমীমাংসিত এই রহস্যের সত্যতা নিয়ে দীর্ঘদিন বিস্তর গবেষণা হয়েছে। বর্তমানে হ্যামিলনে যে পৌরসভার বিল্ডিং রয়েছে,সেই বিল্ডিং এর নামের অর্থ দাঁড়ায় ‘ইঁদুর ধরা লোকের বাড়ি’। এই বিল্ডিংটি ১৬০২ সালে নির্মিত হয়। বিল্ডিংটির দেয়ালে বিশ্ববিখ্যাত হ্যামেলিনের বাঁশিওয়ালা কাহিনীটির ছবি আঁকা আঁকা রয়েছে। জার্মানির হ্যামিলিন শহরে হ্যামেলিনের বাঁশিওয়ালা কাহিনী সংক্রান্ত একটি জাদুঘরও রয়েছে। ওই জাদুঘরে সঞ্চিত পঞ্চদশ শতাব্দীতে লেখা কয়েকটি বইয়ে এ রহস্যময় কাহিনীর বর্ণনা রয়েছে। ফ্রাউ ভন লিউড নামের এক ১৩ বছরের বালিকার ১২৯৪ সালের রেকর্ডে লিপিবদ্ধ আছে যে সুদর্শন এ লোকটির বয়স ছিল আনুমানিক ৩০। তার বাঁশিটি ছিল রুপোর তৈরি। এক নথিতে পাওয়া যায় ১৩০০ শতাব্দীতে হ্যামিলনের বাজারে এক কাঠের ফলক ছিল। সেখানে এক বংশীবাদক ও অনেক শিশুর ছবি ছিল। সেটা ১৭০০ সালে ঝড়ে ধ্বংস হয়ে যায়। ১২৮৪ সালের ঘটনার পরেই চার্চে Stained-glass জানালা লাগানো হয় ১৩০০ সালের দিকে। সেখানে এই করুণ ঘটনা লেখা ছিল। জানালাটা বানাবার উদ্দেশ্যই ছিল শিশুদের স্মরণ করা। জানালাটা ধ্বংস হয়ে যায় ১৬৬০ সালে, পরে ইতিহাসবিদ হ্যান্স ডবারটিন ঐতিহাসিক লেখনী থেকে এই জানালা পুনঃনির্মাণ করেন। সেখানে দেখা যায় বাঁশিওয়ালা আর সাদা পোশাকে শিশুদের ছবি!
ইমেজ সোর্স -steemit.com
আপনি যদি বর্তমানের হ্যামেলিন শহরে যদি কোন দিন বেড়াতে যান তবে সেখানে দেখবেন, বাঁশিওয়ালার মূর্তি, সাথে ইঁদুর। ২০০৯ সালে জার্মানিরা এক টুরিস্ট ফেস্ট আয়োজন করে শিশুদের প্রস্থানের করুণ ঘটনার ৭২৫তম বার্ষিকীতে। যে বাড়িতে খোদাই করা ছিল ইতিহাসটি, সেটিকে এখন “র্যাট ক্যাচার” এর বাড়ি বলে। প্রতি বছর ২৬ জুন পালন করা হয় র্যাট ক্যাচার দিবস। এবার একটি আকর্ষনীয় তথ্য দেয়া যাক, যে রাস্তায় সর্বশেষ বাঁশিওয়ালাকে দেখা গিয়েছিল বলে দাবী করা হয়, সে রাস্তার নাম হচ্ছে Bungelosenstrasse বা ‘নো ড্রাম স্ট্রিট’। এ রাস্তায় কোন মিউজিক বাজানো নিষিদ্ধ। প্রায় ৭০০ বছর ধরেই এমনটি চলে আসছে বলে জানা যায়।
হ্যামেলিনের বাঁশিওয়ালা এর কাহিনিটি অনেকে মিথ্যা দাবি করে থাকেন , কারন পুথিগত বা ইতিহাস সংক্রান্ত কোন নথি বা পত্রতে হ্যামেলিনের বাঁশিওয়ালাকে নিয়ে ঘটা কোন কিছু খুজে পাওয়া যায়নি। আর তাই এই সম্পর্কে কোন যুক্তি সংগত ব্যাখ্যাও আসলে দেয়া কষ্টকর দাঁড়ায়। তবে প্রাচীন নথিগুলোতে আগেও হ্যামেলিন শহরে ছেলে ধরার অস্তিত্ব ছিল বলে জানা যায়। তাই ধারনা করা হয় হ্যামেলিনের বাঁশিওয়ালার গল্পটি সেই সময়কার ছেলে ধরার কাহিনীর সাথে গল্প যুক্ত করে গল্প ফাদা হয়েছে।
তাছাড়া ১২৮৪ এর দিকে জার্মানীতে প্লেগ রোগের প্রাদুর্ভাব ব্যাপক আকারে বেড়ে যায়। প্লেগ রোগের বাহক হল ইঁদুর ছিল । তাই সেই সময় প্লেগের প্রাদুর্ভাব কমাতে ইঁদুর মারার প্রচলন গড়ে ওঠে। সে সময় শহরে ইঁদুর ধরার বিশেষ লোক ছিল যারা বাঁশি বাজিয়ে ইঁদুর ধরতো। এমন বাঁশি জার্মান জাদুঘরেও রয়েছে। সেসময় প্লেগে অনেক শিশু মারা যায়। তাই অনেকের দাবি করেন যে, গীর্জার দেয়ালে বা পুথির পাতায় বর্নিত হ্যামেলিনের বাঁশিওয়ালার ঘটনা গুলো আসলে রূপক অর্থে তুলে ধরা হয়েছে।
আজ লেখায় আমি হ্যামেলিনের বাঁশিওয়ালা গল্পের সত্যতা নিয়ে গড়ে ওঠা বিতর্ক নিয়ে দুপক্ষের বিচার বিশ্লেষন তুলে ধরেছি। সত্যমিথ্যা বিশ্বাস সম্পূর্নটাই ব্যাক্তিগত। কালের বিবর্তনে সাধারন ঘটনা যেমন অসাধারন রূপ লাভ করে ঠিক তেমনি দুনিয়াতে ঘটে অমিমাংশিত অনেক ঘটনা। তবে যাই হোক হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার ঘটনাটি জার্মান জনপ্রিয় একটি গল্প বা ঘটনা। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে জার্মানবাসী এটি ধারন করে রেখেছে।
তথ্য সুত্রঃ
Leave a Reply