কালের বিবর্তনে এক সভ্যতা বিকশিত হয়,আর এক সভ্যতা পত ঘটে-পতিত সভ্যতা নিয়ে মানুষ তখন রচনা করে ইতিহাস, আর সেই ইতিহাসের জোরে সভ্যতার নানান ঘটনা মানুষের মাঝে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম বেঁচে থাকে,পাঠক কুল, সৃজনশীল ব্লগ কালাক্ষর এর ইতিহাস বিভাগে আজ আমরা তেমন এক সভ্যতার কথা বলতে যাচ্ছি-
প্রাচীন পৃথিবীতে যে কয়টি সভ্যতা তাদের উন্নতির চরম শিখরে আহরন করেছিল তার ভিতর মায়ান সভ্যতা একটি, মায়া সভ্যতা, গঠিত হয়রছিল দক্ষিন আমেরিকার গুয়াতেমালার গ্রীষ্মপ্রধান নীচু অঞ্চল কে কেন্দ্র করে।মায়ান সাম্রাজ্য বা মায়া সভ্যতা যিশু খ্রিস্টের জন্মের ছয়শো বছর আগে অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতকের কাছাকাছি সময়ে মায়ান সভ্যতা শক্তি, শৌর্য এবং প্রভাবে সফলতার শীর্ষে উঠে। মায়ানরা কৃষি, মৃৎশিল্প, হায়ারোগ্লিফিক লিখন, ক্যালেন্ডার বা পঞ্জিকা তৈরি, গণিতশাস্ত্র ইত্যাদিতে ব্যাপক উন্নতি সাধিত করে এবং আধুনিক পৃথিবীর জন্য নানা রকম চিত্তাকর্ষক এবং দৃষ্টিনন্দন বিভিন্ন স্থাপত্য ও প্রত্নতাত্ত্বিক শিল্পকর্ম রেখে গেছেন।
আধুনিক যুগে মায়ায় খননকাজে আবিষ্কৃত হয় বিভিন্ন প্লাজা, মন্দির, প্রাসাদ, পিরামিড, এমনকি একটিখেলার কোর্ট যেখানে বল দিয়ে খেলা হত । প্রত্নতাত্তিকদের ধারনা এই কোর্টটি মায়া সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। তবে মায়া সভ্যতার সবচেয়ে বড় বড় পাথুরে নগরীগুলো ৯০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যেই পরিত্যক্ত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ঠিক কি কারনে চরম শিখরে থাকা মায়া সভ্যতার নাটকীয় পতন ঘটে তার কারন সম্পর্কে আজও পন্ডিতরা দ্বিধান্বিত এবং বিতর্কিত মতবাদ দিয়ে আসছেন ।
মায়া সভ্যতা
মেসো আমেরিকার সবচেয়ে প্রভাবশালী আদিবাসী সমাজগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল মায়া সভ্যতা , (মেসোআমেরিকা: শব্দ টি ১৬ শতকে স্প্যানিশ বিজয়ের আগে মেক্সিকো এবং মধ্য আমেরিকা বর্ননা করতে ব্যাবহার করা হত )। মেসোআমেরিকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অন্যান্য আদিবাসী জনগোষ্ঠীর থেকে ভিন্ন এই মায়ানদের সভ্যতা ছিলো ইউক্যাটান উপদ্বীপ এবং পুরো গুয়াতামালা নিয়ে গঠিত ভৌগলিক ব্লকের কেন্দ্রবিন্দু। এই ব্লকের আরো কিছু অংশ হলো বেলিজ এবং মেক্সিকোর তাবাস্কো ও চিয়াপাস রাজ্য, হন্ডুরাস এবং এল সালভাদর এর পশ্চিম অংশ।
এই মানচিত্র দেখে প্রত্নতাত্ত্বিকরা ধারনা করেছেছেন যে, মায়া সভ্যতা অন্যান্য মেসোআমেরিকান সম্প্রদায়ের দ্বারা আক্রমণ থেকে তুলনামূলকভাবে নিরাপদেই ছিল। আর এই বিস্তৃতির মধ্যেই মায়ানরা স্বতন্ত্র পরিবেশ ও সাংস্কৃতিক পার্থক্য সহ ৩টি ভিন্ন ভিন্ন উপ-এলাকায় বসবাস করত। যারমধ্যে উত্তরের ইউক্যাটান উপদ্বীপ এবং মেক্সিকো, বেলিজ ও হন্ডুরাসের সংলগ্ন অংশ অপেক্ষাকৃত নিচুভূমি এবং দক্ষিণাংশ উচুভূমি যা গুয়াতেমালালার পাহাড়ী অঞ্চল। নিচু অঞ্চলের এই মায়ানরা খ্রিস্টপূর্ব ২৫০ থেকে ৯০০ সালের মধ্যে সাফল্যের চূড়ায় আরোহন করে এবং এই সময় টাতেই মায়ান রা তাদের বিখ্যাত পাথুরে স্থাপত্যগুলো নির্মাণ করে ফেলে যা এই অঞ্চলে আগত অভিযাত্রী এবং বিদ্বানদের আজও আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে আছে ।
মায়ান সাম্রাজ্যে মনুষ্য জনবসতির সূত্রপাত যীশু খ্রিস্টের জন্মের ১৮০০ বছর পূর্বে। একে মায়া সভ্যতার প্রি-ক্লাসিক বা প্রাতিষ্ঠানিক সময়কাল বলা হয়। প্রথম দিকে মায়ারা ছিলো কৃষিনির্ভর। তারা বিভিনরন শষ্য যেমন: ভুট্টা, মটরশুঁটি, স্কোয়াশ এবং কাসাভা। মধ্যপ্রাচ্যকালীন সময়ে অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব ৩০০ অব্দে, মায়ান কৃষকরা উচু এবং নিচু উভয় অঞ্চলেই তাদের উপস্থিতি জানান দেয়। আর এই মধ্যপ্রাচ্যকালীন সময়েই দেখা যায় মেসো আমেরিকার প্রথম বড় কোন সভ্যতা যার নাম ওলমেক সভ্যতা। জাপোটেক, টটোন্যাক, টিওটিহুকান এবং অ্যাজটেকদের মত মায়া সভ্যতার মানুষেরাও ওলমেক সভ্যতা থেকে অনেক ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে এসেছে।এমনকি ওলমেক সভ্যতা থেকেই তাদের সংখ্যা ব্যবস্থা এবং বিখ্যাত মায়া ক্যালেন্ডারেরও উৎপত্তি হয়েছিল।
কালাক্ষর ব্লগে আমার লেখা পুরাতন পোষ্ট গুলো পড়ার অনুরোধ রইল
কৃষি কাজ ছাড়াও এই প্রি-ক্লাসিক মায়া যুগেই সংস্কৃতির অনেক উন্নতি সাধিত হয়। এসময়ই তারা পিরামিড তৈরি, শহর নির্মান সহ পাথুরে বিভিন্ন স্মৃতিসৌধ নির্মান করে। এ পর্যায়ের শেষে নির্মিত হয় মিরাডোরের শহর যা উত্তরীয় পিটেনে অবস্থিত এবং এটি প্রি-কলম্বিয়ান আমেরিকান ইতিহাসের অন্যতম বড় শহর। আকারে এই শহর মায়া সাম্রাজ্যের রাজধানী তিকাল কেও ছাপিয়ে গেছে। আর এর অস্তিত্ব প্রমাণ করে যে ক্লাসিক মায়া সভ্যতার শত বছর আগে থেকেই মায়া সভ্যতা ছিলো অলংকৃত।
ক্লাসিক মায়া সভ্যতার শুরু ২৫০ খ্রিস্টাব্দে, যা ছিলো মায়া সভ্যতার স্বর্ণযুগ (Golden Age)। এসময়ে তিকাল, উয়াক্সাকটুন, কোপান, বোনাম্পাক, ডস পিলাস, কালাকমুল, পালেঙ্ক, রিও বেক ইত্যাদি সহ প্রায় ৪০ টির মতো শহর গড়ে উঠেছে। আর এসব শহরে জনসংখ্যা ছিলো ৫০০০-৫০০০০ পর্যন্ত। মায়া সভ্যতায় তখন প্রায় ২০০০০০০ জন মানুষের বসবাস ছিলো।
মায়ারা ছিলো খুবই ধার্মিক প্রকৃতির। তারা প্রকৃতির বিভিন্ন জিনিসকেই পূজা করতো যার মধ্যে ছিলো সূর্য, চাঁদ, বৃষ্টি, শষ্য ইত্যাদি। মায়া সাম্রাজ্যের শীর্ষস্থানে ছিলেন রাজা বা “কুহুল আযা” নামে কোন পবিত্র প্রভু, যিনি দেবতাদের সাথে সম্পর্কযুক্ত ছিলেন এবং এই “কুহুল আযা” বা রাজা নির্বাচন ছিলো পারিবারিক ভাবেই। তারা দেবতা এবং পৃথিবীর মানুষদের মধ্যে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে বিবেচিত হয়েছিলো। আরা তারাই মায়া সভ্যতার বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও রীতিনীতি গুলো যথাযথ ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে পালন করতো।
মায়া সভ্যতার প্রাচীন মায়ান জনগন। ছবি – সংগ্রইত
ক্লাসিক মায়া সভ্যতা কালেই বেশিরভাগ মন্দির ও রাজপ্রসাদ নির্মিত হয় যা দেখতে অনেকটা পিরামিডের মত এবং কারুশিল্প ও শিলালিপি দ্বারা সুসজ্জিত। আর এই দৃষ্টিনন্দন স্ট্রাকচার এর কারনেই মায়ারা মেসোআমেরিকার অন্যতম গ্রেট আর্টিস্ট হিসেবে সুনাম অর্জন করেছে। ধর্মীয় অনুশাসন দ্বারা পরিচালিত মায়ারা গনিত এবং জ্যোতির্বিদ্যায় উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছিলো। বিশেষ করে শূন্যের ব্যবহার এবং ৩৬৫ দিনের উপর ভিত্তি করে একটি জটিল ক্যালেন্ডার পদ্ধতির উন্নয়ন। প্রাথমিক পর্যায়ে গবেষকরা মায়াদের একটি লেখক এবং পুরোহিতদের শান্তিপূর্ন সমাজব্যবস্থা মনে করলেও পরবর্তীতে তাদের বিভিনরন কাজকর্ম, শিলালিপি ইত্যাদি পরীক্ষা করে জানা যায় প্রতিদ্বন্দ্বী মায়াদের যুদ্ধ, নিপীড়ন এবং ধর্মের জন্য মানুষ আত্মত্যাগ সম্পর্কে।
মায়া সভ্যতার মানুষদের অন্যতম বিখ্যাত ও বিস্ময়কর ক্ষমতা হলো বনাঞ্চলের মধ্যেও মায়া সভ্যতার মত এতো বড় একটি সভ্যতা গড়ে তোলা। ঐতিহ্যগতভাবে, প্রাচীন এই জনগোষ্ঠী শুষ্ক জলবায়ুতেই উন্নতি লাভ করেছে, যেখানে পানি সম্পদ কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনা সমাজের ভিত্তি তৈরি করেছে। দক্ষিণের নিচু ভূমিতে ছিলো বাণিজ্য ও পরিবহনের জন্য কিছু নৌচলাচলযোগ্য নদী। ফলে সেখানে সেচ ব্যবস্থারও তেমন প্রয়োজন ছিলো না।
২০ শতকের শেষের দিকে এসে, গবেষকরা একমত হয়েছেন যে, তখন নিচু ভূমির জলবায়ু ছিলো আসলে পরিবেশগতভাবে খুবই বৈচিত্র্যময়। যদিও বিদেশী আগ্রাসকরা এ অঞ্চলে সোনা ও রূপার সল্পতায় হতাশ হয়েছিলো, তবে মায়ানরা গ্রহন করেছিলো প্রাকৃতিক সম্পদ থাকার সুবিধা যারমধ্যে ছিলো চুনাপাথর (নির্মাণের জন্য), আগ্নেও শিলা (সরঞ্জামাদি ও অস্ত্রের জন্য) এবং লবন। পরিবেশগত ছাড়াও এখানে আরো অনেক মূল্যবান সম্পদ ছিলো যেমন: কুয়েৎজাল পালক (মায়া ধার্মিকে পোশাকে ব্যবহারের জন্য), জেড, সামুদ্রিক খোলক (Shell, যা বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও যুদ্ধে শিঙ্গা হিসেবে ব্যবহার করা হতো) ইত্যাদি।
ক্লাসিক মায়া সভ্যতা সম্পর্কে ২০ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে আরো অনেক কিছু জানা যায়। যেমন: তাদের হায়ারোগ্লিফিক লেখা এবং গাছের বাকল থেকে কাগজ তৈরি এবং কাগুজে লেখা। কাগুজে লেখাগুলো কোড নামে পরিচিত। আর ঐ কোডগুলোর মধ্যে চারটি কোড পাওয়া গেছে।
খ্রিস্টপূর্ব আট শতকের শেষ দিক থেকে নবম শতকের মাঝামাঝি সময়ে মায়া সভ্যতায় এমন এক অজানা কিছু ঘটেছে যা এই সভ্যতার ভত্তিকে নাড়িয়ে দিয়েছে। ৯০০ খ্রিস্টাব্দের আগেই এক এক করে দক্ষিনের নিম্নভূমিতে অবস্থিত ক্লাসিক শহরগুলি পরিত্যক্ত হয়, ফলে ঐ অঞ্চলে মায়া সভ্যতার মৃত্যু হয়। আর এই রহস্যজনক পতনের কারন এখনো অজানা যদিও অনেক পন্ডিতই নিজেদের মত করে বিভিন্ন তত্ত্ব দিয়েছেন।
মায়া সভ্যতার প্রাচীন মায়ান বাড়ি ঘর। ছবি – সংগ্রহিত
তবে এর মধ্যে তিনটি তত্ত্ব গ্রহণযোগ্য বলে ধরে নেওয়া যায়। কেউ বিশ্বাস করতো যে, মায়ার জনসংখ্যা খুব বেশি হয়ে গিয়েছিলো। আর যা মায়ার পরিবেশ সহ্য করতে পারেনি। আবার অনেক পন্ডিত মনে করেন, প্রতিনিয়ত পরস্পরের সাথে যুদ্ধের ফলেই মায়া ধংস হয়েছে। আর আরেকটি তত্তব হলো পরিবেশের বিপর্যয়। হয়তো মায়া সভ্যতায় এমন কোন খরা, বন্যা বা অতিকায় শক্তিশালী প্রাকৃতিক কিছু আঘাত হেনেছিলো যার ফলে প্রাচীন এই মায়া সভ্যতা ধংস হয়।
তবে হয়তোবা মায়া ধংসের কারন এই তিনটির মিলিত কারনই: মাত্রাতিরিক্ত জনসংখ্যা, নিজেদের সাথেই যুদ্ধ আর কোন প্রাকৃতিক বিপর্যয়। আর স্প্যানিশ আক্রমনকারীরা মাা সভ্যাতায় আসার আগেই মায়া সভ্যতা চাপা পড়ে যায় সবুজ বনাঞ্চলের নিচে।
পোস্টটি ধর্য্য নিয়ে পড়ার জন্য ধন্যবাদ। লেখাটি আপনাদের ভালো লাগলে কমেন্ট এবং শেয়ার করতে কার্পণ্য করবেন না। পাঠকের কমেন্টস এবং শেয়ার আমাদেরকে আরো বেশি লিখতে অনুপ্রেরণা যোগাবে। ধন্যবাদ
Leave a Reply