এক সময়কার প্রবল পরাক্রমাশালী রোমান সম্রাজ্য তখন দুই ভাগে ভাগ হয়েছে। এক অংশের শাসন ব্যাবস্থা রোম কেন্দ্রিক আর এক অংশের শাসন ব্যাবস্থা কনস্ট্যান্টিনোপল (বর্তমানের ইস্তাম্বুল) কেন্দ্রিক। কনস্ট্যান্টিনোপল কেন্দ্রিক শাসন ব্যাবস্থা কে তখন বাইজেন্টাইন সম্রাজ্য বলা হত। আর আমাদের আজকের আলোচনার প্রেক্ষাপট এই বাইজেন্টাইন সম্রাজ্যে ঘটা এক বিদ্রোহ/ দাঙ্গাকে ঘিরে রচিত হয়েছে। বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের সহস্রাধিক বছরের ইতিহাসে শত শত দাঙ্গা-বিদ্রোহের ঘটনা ঘটেছে, এই দাঙ্গা বা বিদ্রোহ গুলোর একেকটির প্রভাব ছিল একেক রকম। কোনো কোনোটি ছিল সম্রাজ্যের প্রজাদের বিভিন্ন দাবি আদায়ের লক্ষে, আবার কোনোটি ছিল নির্দিষ্ট কোনো সম্রাটের সিংহাসন দখলের লক্ষ্যে। যাই হোক,পুরো সাম্রাজ্যেরই ভিত কাঁপিয়ে দিতে সক্ষম হওয়া এক বিদ্রোহের ঘটনা ঘটে ৫৩২ খ্রিস্টাব্দে,তখন বাইজেন্টাইন সম্রাট জাস্টিনিয়ান ছিলেন ক্ষমতায়। বাইজেন্টাইন সম্রাজ্যের তৎকালীন রাজধানী কনস্ট্যান্টিনোপলে (বর্তমান ইস্তানবুল) একটি চ্যারিয়ট রেস থেকে শুরু হওয়া সেই বিদ্রোহের ব্যাপকতা এতটাই প্রকট হয়েছিল যে,ইতিহাসের পাতায় ‘নিকার দাঙ্গা’, বা ‘নিকা বিদ্রোহ’ নামে পরিচিত এই বিদ্রোহটি কাঁপিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল জাস্টিনিয়ানের সিংহাসন। জাস্টিনিয়ানের শাসনামলের ভবিষ্যত ঘটনাবলীতে এই বিদ্রোহের প্রভাব লক্ষ্যণীয়। প্রাচীন যুগের সবচেয়ে রক্তাক্ত দাঙ্গার ঘটনা গুলোর মধ্যে সম্ভবত ‘নিকার দাঙ্গা’, বা ‘নিকা বিদ্রোহ’ কেই প্রথম হিসেবে দেখা হয়।
লেখাটিতে আরো যা জানতে পারবেন
৫২৭ খ্রিস্টাব্দে চাচা প্রথম জাস্টিনের সাথে সংযুক্তভাবে সম্রাট জাস্টিনিয়ান বাইজেন্টাইন স্ম্রাজ্যের মসনদে বসেন। কিন্তু এই রাজ অভিষেকের ৪ মাস পরেই জাস্টিন মারা গেলে জাস্টিনিয়ানই এককভাবে সাম্রাজ্যের সিংহাসনের অধিকারী হন। কিন্তু একক ভাবে সিংহাসনে বসার পর জাস্টিনিয়ান কিছু সিনেটরের অসন্তোষে পড়ে যান, এই সিনেটররা তুলনামূলক কম অভিজাত বংশে জন্ম হওয়ার জন্য জাস্টিনিয়ানকে বাইজেন্টাইন সম্রাজ্যের সম্রাট হিসেবে যোগ্য মনে করতেন না, শুধু তাই নয়, এরা তাদের কাছ থেকে সম্মান পাবার ক্ষেত্রে জাস্টিনিয়ান কে যোগ্যও মনে করতেন না ।
বাইজেন্টাইন সম্রাজ্যের রাজ সিংহাসনে সদ্য বসা সম্রাট জাস্টিনিয়ানের ইচ্ছে ছিল রাজধানীর উন্নতি করার, সেখানকার বসবাসরত জনগণের উন্নতি করার। এর ফল সরূপ জাস্টিনিয়ান চেষ্টা করেন বিচার ব্যবস্থা এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থার পরিবর্তনের। কিন্তু তৎকালীন অভিজাত শ্রেণী একে খারাপভাবে নেয়। এছাড়াও প্রথম থেকেই তার মূল লক্ষ্য ছিল পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের হারানো অঞ্চলগুলো পুনরুদ্ধার করার, সেই সাথে পারসিয়ান সাসানিদদের সাথে যুদ্ধে যথেষ্ট রসদ যোগানোর। ফলে সৈন্যবল বৃদ্ধির লক্ষ্যে জাস্টিনিয়ান বাড়িয়ে দেন শহরে করের পরিমাণ। এই করবৃদ্ধিকে কনস্ট্যান্টিনোপলের অভিজাত শ্রেণী কিংবা সাধারণ জনতা- কেউই ভালোভাবে নেয়নি। ফলে দুই শ্রেণীরই রোষানলে পড়েন সম্রাট জাস্টিনিয়ান।
তাছাড়াও, জাস্টিনিয়ানের স্ত্রী, সম্রাজ্ঞী থিওডোর বিয়ের পূর্বে একজন নর্তকী ছিলেন বলে তার প্রতিও বিত্তশালী সিনেটরদের ক্ষোভ ছিল। সিনেটর দের ক্ষোভের মাত্রা আরো বেড়ে যায় যখন থিওডোর সম্রাটের রাজসভার নামমাত্র একজন সদস্য হয়ে থাকার বদলে সাম্রাজ্য পরিচালনার সক্রিয় ভূমিকায় অংশ গ্রহণ করেন, যা অভিজাত শ্রেণী ভালো চোখে দেখেনি।
অসন্তষ্টের ধ্রম্রজাল আরো খারাপের দিকে চলে যায়, যখন সম্রাট জাস্টিনিয়ানের নিয়োগকৃত কর কর্মকর্তা জন অব কাপ্পাদোসিয়ার কর আদায়ের জন্য খুব কড়াকড়ি শুরু করেন। এতে অতিষ্ট হয়ে জনতা ছোট আকারের একটি দাঙ্গার সুত্রপাত করে। কিন্তু সেই দাঙ্গা কড়া হাতে দমন করা হয়, এবং দাঙ্গায় অংশগ্রহণকারী অনেককে ধরে কারাদন্ড দেয়া হয়,মৃত্যুদন্ড দেয়া হয় দাঙ্গার মূল হোতাদের। এর ফলে সাধারণ জনতার মধ্যে অসন্তোষ আরো বেড়ে যায়, এবং সময়ের সাথে সাথে ক্রমাগত ভাবে তা বাড়তে থাকে।
ইতিহাস বিখ্যাত এই নিকার দাঙ্গা বা নিকা বিদ্রোহের মূল ঘটনায় যাবার আগে তৎকালীন রোমানদের চ্যারিয়ট রেস সম্পর্কে আপনাদের কিছু জেনে নেয়া প্রয়োজন। তখনকার সময়ে রোমান ও বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যে চ্যারিয়ট রেস ছিল খুবই জনপ্রিয় একটি খেলা। চ্যারিয়ট রেস হত মূলত দুই বা ততোধিক ঘোড়াচালিত প্রাচীন আমলের একপ্রকার গাড়ির মাধ্যমে।
রোমান স্ম্রাজ্যের অধিনস্ত শহরগুলোতে রোমান অভিজাত শ্রেণী এবং সাধারণ নাগরিকদের আমোদ-প্রমোদের জন্য বিভিন্ন ধরনের খেলা অনুষ্ঠিত হতো তার ভিতর চ্যারিয়ট রেসের জনপ্রিয়তা ছিল তুঙ্গে। চ্যারিয়ট রেস খেলাটি যে স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হতো তাকে বলা হতো হিপোড্রোম। চ্যারিয়টিয়ার্সরা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে খেলতেন এবং তাদের দলগুলোকে ভিন্ন রঙ, যেমন- লাল, সবুজ, নীল ইত্যাদি অনুযায়ী বিভক্ত করা হতো। তখন মূলত সবুজ দল ও নীল দল- এই দুটি দলেরই প্রভাব ও জনপ্রিয়তা তুঙ্গে ছিল। তাদের প্রভাব তখন শুধুমাত্র হিপোড্রোমেই না, বরং শহুরে সমাজ ও রাজনীতির বিভিন্ন স্তরেও বিদ্যমান ছিল। সাধারণ জনতার সাথে অভিজাত শ্রেণী, এমনকি সম্রাট নিজেও স্টেডিয়ামে খেলা উপভোগ করতেন।
হিপোড্রোম। ইমেজ সোর্স – arkeofili.com
রোমান ঐতিহ্য অনুযায়ী, রোমান সম্রাটকে যেকোনো একটি দলকে প্রকাশ্য সমর্থন দিতে হতো। সিংহাসনে আরোহনের প্রথম দিকে সম্রাট জাস্টিনিয়ান নীল দলের সমর্থক থাকলেও এই দাঙ্গার সময়ে কোনো দলের প্রতিই প্রকাশ্য সমর্থন জ্ঞাপন করেননি, যেটা পরে মারাত্মক ভুল হিসেবে পরিগণিত হয়।
দমন কৃত কর নিয়ে ঘটা দাঙ্গায় রাজবন্দীদের মধ্যে যে সব বন্দীদের মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়, সেই সব বন্দীদের ভিতর একজন ছিলেন নীল দলের সমর্থক,আর একজন ছিলেন সবুজ দলের সমর্থক। যদিও মৃত্যুদণ্ডের দিন তারা পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। কিন্তু দুই দলের সব সমর্থকই চেয়েছিলেন যেন তাদের যেন সম্রাট ক্ষমা করে দেয়।
তাই ৫৩২ খ্রিস্টাব্দের ১৩ জানুয়ারি, শিডিউল মেনেই শুরু হওয়া চ্যারিয়ট রেসের দৌড় যখন শুরু হয়, তখন হিপোড্রোমে দৌড় দেখতে আসা নীল এবং সবুজ দুই দলেরই সমর্থকরা সম্রাটের নিকট আকুতি জানাতে থাকে সম্রাট যেন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুজনকেই ক্ষমা করে দেওয়ার জন্য। কিন্তু তাদের মিনতি জাস্টিনিয়ানের মন গলাতে পারেনি, সম্ভবত প্রথম দাঙ্গায় অংশগ্রহণকারীদের প্রতি ক্ষোভ থেকেই হোক, অথবা ক্ষমাশীলতাকে দুর্বলতা হিসেবে দেখার আশংকা থেকেই হোক- নীল ও সবুজ সমর্থকদের অনুরোধের কোনো উত্তর দেয়া থেকে জাস্টিনিয়ান নিজেকে বিরত রাখেন।
স্ম্রাটের এহেনো আচরণে আগে থেকেই ক্ষুব্ধ জনতা এবার ধৈর্যহারা হয়ে যায়। ফলে তারা রেসের শুরুতে তাদের নিজ নিজ দলের পক্ষে দেয়া স্লোগানের বদলে “নিকা! নিকা!” ধ্বনিতে স্লোগান দিতে থাকে। নিকা অর্থ হল “জয় কর!”। নিজ নিজ দলের সমর্থন ছেড়ে যেন তারা একতাবদ্ধ হন অজনপ্রিয় সম্রাটকে সিংহাসন থেকে সরিয়ে দিতে তার বিরুদ্ধে জয়লাভ করাকে।
হিপোড্রোমে শুরু হওয়া দাঙ্গা ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে বাইজেন্টাইন সম্রাজ্যের রাজধানী কনস্ট্যান্টিনোপোলের রাস্তায় রাস্তায়। শহরের জেলখানায় একসময় দাঙ্গাকারীরা উপস্থিত হয়,জেলখানায় গিয়ে প্রথমেই তারা জেলবন্দীদের মুক্ত করে দিয়ে জেল ভবনে আগুন ধরিয়ে দেয়। দাঙ্গাকারীদের সেই আগুনের ব্যাপকতা এতটাই ছিল যে, এই আগুন থেকে সৃষ্ট অগ্নিকান্ডে শহরের অন্যান্য অনেক ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়,এই ভবন গুলোর ভেতর ঐতিহ্যবাহী উপাসনালয় আয়া সোফিয়াও ছিল।
অজনপ্রিয় কর্মকর্তাদের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দিলে হয়ত জনতাকে শান্ত করা যাবে এই ভেবে সম্রাট জাস্টিনিয়ান অজনপ্রিয় কর্মকর্তাদের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেন। কিন্তু তাতেও কোন লাভ হয়নি। জনতা কে শান্ত করা যায় নি। ফলে দাঙ্গা চলতেই থাকে। তারপর জাস্টিনিয়ান তার বিশ্বস্ত জেনারেল বেলিসারিয়াসকে নির্দেশ দেন কিছু সৈন্যনিয়ে দাঙ্গা থামাতে। কিন্তু ততদিনে বিশৃঙ্খলা এতই প্রবল হয়ে পড়ে যে দাঙ্গা থামাতে ব্যর্থ হন বেলিসারিয়াসও।
তখন সম্রাট তার সভাসদদের নিয়ে প্রাসাদে আশ্রয় নেন। তারপর ১৮ জানুয়ারী, পাঁচ দিনব্যাপী দাঙ্গা চলার পর সম্রাট আবারও দেখা দেন হিপোড্রোমে। সম্রাট দাঙ্গাকারীদের উদ্দেশ্যে একের পর প্রস্তাব পেশ করেন। কিন্তু স্ম্রাটের প্রতিটি প্রস্তাবকেই দাঙ্গাকারীরা একে একে প্রত্যাখ্যান করে ।
তারপর দাঙ্গাকারীরা সেখানেই তাদের নতুন সম্রাট মনোনীত করে। হাইপাটিয়াস, যিনি ছিলেন সাবেক সম্রাট প্রথম আনাস্টাসিয়াসের ভ্রাতুষ্পুত্র, যিনি ছিলেন সিংহাসনে উপবিষ্ট সম্রাট জাস্টিনিয়ান অপেক্ষা বেশি অভিজাত বংশের, তাকেই দাঙ্গাকারীরা মনোনীত করে নতুন সম্রাট হিসেবে। প্রথমে সায় না দিলেও পরদিনই নিজের অনিচ্ছা সত্ত্বেও উপস্থিত জনতার জোরাজুরিতে হিপোড্রোমেই সম্রাটের পদ গ্রহণ করেন হাইপাটিয়াস। ফলে স্রেফ দাঙ্গা থেকে এটি রূপ নেয় ক্যু তথা অভ্যুত্থানে।
সম্রাট জাস্টিনিয়ান হাইপাটিয়াস-কান্ডের পর তার সকল সভাসদকে নিয়ে হিপোড্রোম ত্যাগ করে তার প্রাসাদে অবস্থান নেন। ওদিকে বিদ্রোহ চলতেই থাকে। বিদ্রোহ থামার কোনো লক্ষণ না দেখা গেলে এবং ক্রমাগত তীব্রতা বাড়তে থাকার কারণে একপর্যায়ে হাল ছেড়ে দিয়ে জাস্টিনিয়ান তার সহ
কারীদের সাথে আলোচনা শুরু করেন কিভাবে রাজধানী ছেড়ে পালানো যায় সেই বিষয় নিয়ে।
আর ঠিক তখনই সম্রাজ্ঞী থিওডোরা দৃঢ়তা নিয়ে ভীতসন্ত্রস্ত সম্রাটকে বোঝাতে শুরু করেন,এ ভাবে কাপুরুষের মত শহর ছেড়ে না পালিয়ে বরং বিদ্রোহ দমন করা যায় সেই বিষয়ে আবার ভাবতে। সম্রাজ্ঞী থিওডোরা সম্রাটের উদ্দেশ্যে বলতে থাকে, যদিও পালিয়ে যাওয়াই সহজ রাস্তা এবং তাদের জন্য পালানো কোনো ব্যাপারই না, তবুও সম্রাট যদি আজ তাঁর সিংহাসন ফেলে শহর ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার রাস্তাই বেছে নেন, প্রাণে বেঁচে গেলেও একসময় তিনি এ নিয়ে অনুশোচনা করবেন। তিনি আরও বলতে থাকেন, পালিয়ে যাওয়ার থেকে রাজপোশাকে মৃত্যুকে বরণ করাকেই তিনি শ্রেয়তর মনে করেন।
স্ত্রীর এরূপ দৃঢ়তায় লজ্জিত হন জাস্টিনিয়ান। এতে যেন তিনি নবউদ্যম ফিরে পান। সিদ্ধান্ত নেন নিজের যেটুকু ক্ষমতা অবশিষ্ট আছে, তা দিয়েই এই বিদ্রোহ দমনের।
সম্রাট জাস্টিনিয়ান তখন শহরে অবস্থান করা তার বিশ্বস্ত দুই সেনাপতি বেলিসারিয়াস এবং নারসেসকে নির্দেশ দেন যে কোন মুল্যে বিদ্রোহ থামাতে। তখন দুই সেনাপতি সেনাশক্তির মাধ্যমে বিদ্রোহ থামানোর পরিকল্পনা করেন। বিদ্রোহকারী নীল ও সবুজ দলের সমর্থকরা আগে থেকেই হিপোড্রোমে অবস্থান করছিলেন। বিদ্রোহীরা যাতে পালাতে না পারে এই জন্য প্রথমে সেনাপতি নারসেস তার সৈন্য নিয়ে হিপোড্রোমের গেট ব্লক করে দ্যান। অপরদিকে স্ম্রাটের আরেক সেনাপতি বেলিসারিয়াস বিদ্রোহীদের উপর ভারী পদাতিক সৈন্য নিয়ে আক্রমণ শুরু করেন। বিদ্রোহীদের সংখ্যা রাজসৈন্যদের থেকে অনেক বেশি হলেও রাজ সৈন্যরা ছিল ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত, প্রশিক্ষিত ও যুদ্ধের ময়দানে অভিজ্ঞ। এছাড়াও হিপোড্রোমে বিদ্রোহীদের ঘনত্ব অনেক বেড়ে যাওয়ায় সাবলীলভাবে নড়াচড়া করাও কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। বিদ্রোহীরা রাজ সেনার রূপ দ্বিমুখী আক্রমণের ফলে আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। ফলে সবার কচুকাটা হতে হয়।
ইংরেজ ঐতিহাসিক জন জুলিয়াস নরউইচ স্ম্রাট জাস্টিনিয়ানের এই প্রতি-আক্রমণ বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন,
হিপোড্রোমে অবস্থিত গ্যালারিতে থাকা জনতার রাগান্বিত বিদ্রোহী কন্ঠসর অল্পকিছুক্ষণের মধ্যেই রূপ নেয় আহত মৃত্যুপথগামী মানুষের কান্না ও আর্তনাদে, এবং তার কিছুক্ষণ পর সেটিও থেমে যায়, তখন পুরো গ্যালারি জুড়েই বিরাজ করছিল সুনসান নীরবতা।
প্রথমবার ব্যর্থ হলেও বেলিসারিয়াসের এই দ্বিতীয় অভিযানে প্রাণ যায় প্রায় ত্রিশ হাজার বিদ্রোহীর। বেচারা হাইপাটিয়াস, যিনি অনিচ্ছাসত্ত্বেও ঝামেলায় জড়াতে বাধ্য হন, তাকেও হত্যা করা হয়। নীল বা সবুজ দলের সমর্থক, বিদ্রোহে অংশগ্রহণকারী কিংবা নিরপেক্ষ, কেউই ছাড় পায়নি নির্মম রোমান সেনার রোষানল থেকে। এই বিদ্রোহের প্রায় সকল হোতার মৃত্যুদন্ড নিশ্চিত করা হয় ফলে খুব দ্রুত পুরো পরিস্থিতি সম্রাটের অনুকূলে চলে আসে। যে দাঙ্গা হিপোড্রোমে শুরু হয়েছিল, তার পরিসমাপ্তি হিপোড্রোমেই শেষ হয়।
নিকার দাঙ্গা বা নিকা বিদ্রোহ সফলতার সাথে দমনের পর সম্রাট জাস্টিনিয়ানের কনস্ট্যান্টিনোপল শহর এবং গোটা সাম্রাজ্যে নিজের প্রভাব আবারও বিস্তার করতে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি। এই বিদ্রোহে অংশ গ্রহণ কারী সকল বিদ্রোহীর সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হয়। জন অব কাপ্পাদোসিয়াকে পুনরায় তার পূর্বের পদে হিসেবে বহাল করা হয়।
এর পর জাস্টিনিয়ান বাইজোন্টাইন স্ম্রাজ্যের আরও ৩৩ বছর শাসক হিসেবে ছিলেন। এছাড়াও জাস্টিনিয়ান অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক এবং সামরিক খাতে অনেকগুলো আইনগত পরিবর্তন আনেন। এর পাশাপাশি সেনাপতি বেলিসারিয়াস কে দায়িত্ব দেন পুরনো পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের হারানো অঞ্চলগুলো আবারও দখলে আনার জন্য, যাতে বেলিসারিয়াস অনেকাংশেই সফল হন। ফলে উত্তর আফ্রিকা, সিসিলি এবং ইতালিয়ান উপদ্বীপ আবারও রোমানদের অধীনস্থ হয়।
কনস্ট্যান্টিনোপলে ঘটা এই নিকা বিদ্রোহ কাঁপিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল পরাক্রমশালী বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের ভিত, সম্রাট জাস্টিনিয়ানকে করতে ধরেছিল রাজ সিংহাসনের গদি চ্যুত, সেই বিদ্রোহ শক্ত হাতে দমন করে সম্রাট জাস্টিনিয়ান শত্রু-মিত্র সকলের সমীহ অর্জন করতে সক্ষম হন। যা তার শাসনামলের দীর্ঘস্থায়ী এবং প্রায় অন্তর্কোন্দলমুক্ত হবার পেছনে বড় একটি কারণ বলে মানা হয়।
Leave a Reply