তার নাম শোনেন নি এমন মানুষের সংখ্যা খুজে পাওয়া দুষ্কর। ছোটবেলা থেকে তিনি কখনো গণিতে ফেইল করেননি। এক কথায় তিনি ছিলেন অংকের জাহাজ! তার গণিতের পারদর্শিতা দেখে খোদ শিক্ষকরাও অবাক বনে যেতেন। পাঠক বলছি পৃথিবীর সেরা বিজ্ঞানীদের একজন অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের কথা।
অ্যালবার্ট আইনস্টাইন ১৮৭৯ সালে জার্মানির উলমে জন্মগ্রহণ করেন। অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের বাবা একটি তড়িৎরাসায়নিক কারখানা পরিচালনা করতেন। ছোটবেলা থেকেই আইনস্টাইন পদার্থবিদ্যার প্রতি আগ্রহী ছিলেন। পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি তিনি পদার্থবিদ্যার বইও পড়তে শুরু করেন।
আইনেস্টাইন ছোট বেলা থেকেই উদ্ভট সব কান্ড কারখানা করে বেড়াতেন। একবার নিউটনকে অনুকরণ করার চেষ্টায় আইনস্টাইন নিজের বাগানে ঘাসের উপর টানা ১০ ঘণ্টা শুয়ে ছিলেন শুধু মাত্র আইজ্যাক নিউটন কি ভাবে আপেল দেখে মধ্যাকর্ষন সুত্র আবিস্কার করলো তা জানতে। ছেলের এমন কাণ্ড দেখে আইনস্টাইনের মা বলেন, বাবা আমাদের বাগানে কোনো আপেল গাছই তো নেই। এভাবেই নানা পরীক্ষা-নীরিক্ষার মধ্য দিয়ে ছেলেবেলা কাটিয়েছেন অ্যালবার্ট আইনস্টাইন।
কিছুটা উদ্ভট হলেও তার জ্ঞানের কথা কারও অজানা নয়। এই নোবেল পুরষ্কার বিজয়ী মহান পদার্থ বিজ্ঞানী মূলত পদার্থের ‘আপেক্ষিকতা তত্ত্ব’ আবিষ্কারের জন্য বিখ্যাত। পদার্থের ‘আপেক্ষিকতা তত্ত্ব’ আবিষ্কারের জন্য আইনেষ্টাইন কে ১৯২১ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়। তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানে তার বিশেষ অবদান এবং আলোক-তড়িৎ ক্রিয়া সম্পর্কিত গবেষণার জন্য তিনি সারা দুনিয়ার সব চেয়ে কাঙ্ক্ষিত পুরস্কারটি লাভ করেন।
আল্বার্ট আইনস্টাইন পদার্থবিজ্ঞানের বিভিন্ন বিভিন্ন বিষয়ে প্রচুর গবেষণা করে নতুন উদ্ভাবন ও আবিষ্কার করেছেন। তার গবেষণা লব্ধ বুদ্ধি ও জ্ঞান আপমার জন সাধারন মানুষের মনে কৌতূহল বাড়িয়ে তুলত, তার ব্রেইন এত তীক্ষ্ণ কেন? কেন তিনি সব মানুষের চেয়ে বেশি মেধাবী এই নিয়ে কৌতূহল দমন করতেই মানুষের মনে কৌতূহল জাগতো আইনেষ্টাইনের মস্তিস্কে কী আছে তা দেখার। আর তার ধারাবাহিকতায় ই বিখ্যাত এই বিজ্ঞানীর মারা যাওয়ার পর চুরি হয়ে যায় তার মাথার মগজ।
১৯৫৫ সালে ৭৬ বছর বয়সে অ্যালবার্ট আইনস্টাইল মৃত্যুবরণ করেন। ড. থমাস হার্ভের নামক এক ডাক্তারের উপর পোস্টমর্টেমের ভার পড়েছিল। থমাস হার্ভে আইনেস্টাইনের দেহ কাটাছেঁড়ার পর এই মহাবিজ্ঞানীর মগজ সরিয়ে রাখেন । ড. থমাস কাজটা করেছিলেন অতি গোপনে। থামাস আইনস্টাইনের মস্তিষ্ক খুলি থেকে বের করে সেটাকে ফরমালিনের জারে চুবিয়ে রাখেন ।
এর পর থমাস প্রিন্সটন হাসপাতাল থেকে মহাবিজ্ঞানীর মগজটি বাড়ি নিয়ে যান। অতি সতর্কতার সহিত মগজসহ জারটি বাক্সবন্দি নিজের ঘরে রেখে দ্যান। এরপরই শুরু হয় থমাসের জীবনে উল্টো যাত্রা। পারিবারিক জীবনে কোন দিন থমাস সুখী ছিলেন না। একের পর এক সম্পর্কে জড়িয়েছেন আর বিচ্ছেদ করেছেন। বার বার স্ত্রী বিচ্ছেদ করেছেন কিন্তু তিনি যক্ষের ধনের মত আগলে রেখেছেন আইনেষ্টাইনের মহামূল্য মগজ। শুরু কি আগলে রাখা? তিনি বিষয় টি বেমালুম চেপেও রেখেছিলেন বলেই আইনেষ্টাইনের মৃত্যুর ২৫ বছর এই খবর সকলের কাছে গোপন ই থেকে যায়। তবে মাসিক নিউজার্সি পত্রিকার একজন রিপোর্টার স্টিভেন লেভি ১৯৭০ সালে হুট করেই আইনেষ্টাইনের এই মগজ চুরীর ঘটনা জানতে পারেন। তিনি তখন স্টিভেন লেভী ড. টমাস হার্ভের সঙ্গে দেখা করে এর সত্যতা যাচাই করেন। জনাব স্টিফেন লেভী ট্মাস হার্ভের বাসায় গিয়ে দেখেন যে, আইনস্টাইনের ব্রেইনটি কাঠের দু’টি বক্সে রাখা আছে,আর বক্স দুইটির উপরে লেখা আছে ‘কোস্টা সাইডার’ ।
আইনেষ্টাইনের মস্তিষ্কের সেরেবেলাম অর্থাৎ মাথার একেবারে পিছনে ঘাড়ের কাছে থাকে সেই অংশ কেটে স্লাইস করা হয়েছে। এ ছাড়া ব্রেইনের ওপরের অংশে; সেরেব্রাল কর্টেক্স যেখানে থাকে সেটিও কেটে পাতলা স্লাইস করা হয়েছে গবেষণার জন্য। এগুলো দিয়েই আইনস্টাইনের মস্তিষ্ক নিয়ে গবেষণা পরিচালনা করেন ড. থমাস হার্ভে। ডঃ থমাসের গবেষণাপত্র বের হয় ১৯৮৫ সালে।
স্নায়ুবিজ্ঞানীরা মানুষের মস্তিষ্ককে মোট ৪৭ টি ভাগে চিহ্নিত করেছেন, যাকে বলে ব্রডম্যান ম্যাপ। এ ম্যাপ অনুসারে মানুষের ব্রেইনের ৯ ও ৩৯ নম্বর এরিয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মস্তিস্কের এরিয়া ৯ মানুষের প্ল্যানিং, স্মৃতি আর মনযোগ নিয়ে কাজ করে। অন্যদিকে ভাষা আর জটিল সমস্যা নিয়ে কাজ করে মস্তিস্কের এরিয়া ৩৯ নম্বর অংশটি । ড. টমাস হার্ভের দল গবেষণা করে দেখেন, এই দুই এরিয়ার নিউরন এবং গ্লিয়াল সেল এর অনুপাত নিয়ে। তারা আইনস্টাইনের মস্তিষ্কের এই অনুপাতকে তুলনা করেছিলেন গড় বয়স ৬৫ বছরের ১১ জন মৃত ব্যক্তির ব্রেইনের সঙ্গে।
ছবি – আইনেস্টাইনের মগজ। ইমেজ সোর্স – i.pinimg.com
দেখা যায়, আইনস্টাইনের মস্তিষ্কের একমাত্র বাম দিকের ৩৯ নম্বর এরিয়াতে একটি নিউরনের জন্য একাধিক গ্লিয়াল সেল বিদ্যমান ছিল, যা অন্য ১১ টি মানুষের মস্তিষ্কে ছিল না। এই ফলাফলের ভিত্তিতে ব্যাখ্যা করা হয়- যেহেতু অন্য মানুষের চেয়ে আইনেষ্টাইনের মস্তিস্কের এরিয়া ৩৯ তে বেশি গ্লিয়াল সেল বিদ্যমান, তার মানে দাঁড়ায় আইনস্টাইনের মস্কিষ্ক অন্য মানুষের চেয়ে বেশি শক্তি ব্যয় করত। এর কারণেই হয়তোবা বিজ্ঞানী আইনেষ্টাইনের চিন্তা শক্তি ও তাত্ত্বিক জ্ঞান অন্য সব সাধারণ মানুষের চেয়ে অনেক বেশি ছিল।
আইনেষ্টাইনের মস্তিস্ক নিয়ে ২০০৬ সালে আরো একটি গবেষণা প্রকাশিত হয়, যেখানে উল্লেখ করা হয় বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের মস্তিষ্কের গ্লিয়াল সেল এর গঠন (যেমন বড় এস্ট্রোসাইট প্রসেস) অন্য মানুষের চেয়ে একেবারে আলাদা ছিল।
আরও এক গবেষণায় জানা যায়, আইনস্টাইনের মস্তিষ্কের ওজন ১ হাজার ২০০ গ্রাম। যেখানে সাধারণ মানুষের মস্তিষ্কের ওজন থাকে ১৪০০ গ্রাম। এ ছাড়াও তার মস্তিষ্কের এরিয়া ৯ অন্যদের তুলনায় পাতলা এবং নিউরনবহুল ছিল।
১৯৯৯ সালে প্রকাশিত এক গবেষণা অনুসারে, আইনস্টাইনের মগজের প্যারাইটাল লোবের খাঁজগুলো অন্যদের চেয়ে আলাদা। আশেপাশের খাঁজগুলো ছোট ছিল। পাশপাশি তার ব্রেইন ১৫ শতাংশ বেশি প্রশস্ত ছিল। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, এর ফলে বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের মস্তিষ্কের নিউরনগুলো কাজ করার জন্য যথেষ্ঠ জায়গা পেত। আর এই কারনেই আইনেষ্টাইনের গাণিতিক ও স্থানিক চিন্তা শক্তি অন্য মানুষের চেয়ে বেশি ছিল।
Leave a Reply