প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সুভাষ দত্ত ১৯৬৪ সালে তাঁর প্রথম ছবি ‘সুতরাং’এ ‘পরানে দোলা দিলো এই কোন ভোমরা’ শিরোনামের গানের মাধ্যমে মাত্র ১৩ বছরের মিনা পাল নামক এক কিশোরীর নাম পাল্টিয়ে কবরী রেখে তাঁকে নায়িকা হিসেবে দর্শকদের কাছে পরিচিতি করেছিলেন। এই ১৩ বছরের কিশোরী তার করা প্রথম ছবিতেই দর্শকের মনে বেশ পোক্ত ভাবে জায়গা করে নিয়েছিলেন। সে সময় মিস্টি মেয়ের খেতাব প্রাপ্ত কিশোরী মিনা পাল যার নাম পালটে করবী রাখা হয় এবং যাকে আমাদের বর্তমান প্রজন্ম অভিনেত্রী কবরী হিসেবে জানি। তার কর্মময় বর্নিল জীবনকে ঘিরেই সৃজনশীল ব্লগ “কালাক্ষর” এর আজকের আয়োজন।
চলচ্চিত্রকার সুভাষ দত্ত ‘সুতরাং’ সিনেমাটি নির্মাণের সব কিছু চুরান্ত। চলছে নায়িকা নির্বাচনের পালা। একদিন হুট করেই চট্টগ্রাম থেকে মিনা পাল নামের ১৩ বছরের এক কিশোরীকে নিয়ে আসলেন। সবাইকে বলে দিলেন তার সুতরাং ছবিতে নায়িকা হিসেবে এই মেয়েটি কাজ করছে। সেদিন অনেকেই নেগেটিভ মন্তব্য করলেও সুভাষ দত্তের জহুরী চোখ ট্যালেন্ট চিনতে ভুল করে নি। সুভাষ দত্ত মিনা পালের নাম পাল্টিয়ে ফিল্মি নাম কবরী রাখেন। এর পরের ইতিহাস আমাদের সবার জানা।
সুতরাং সিনেমাটি সেই সময় ব্যাপক প্রশংসা পায়। আর সেই প্রশংসার ঢেউ দেশের গন্ডি পেড়িয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ছড়িয়ে পরে। ১৯৬৪ সালে সুভাষ দত্ত নির্মিত ‘সুতরাং” সিনেমা টি প্রথম কোন বাংলাদেশী ( তখন কার পুর্ব পাকিস্থান) সিনেমা যা আন্তর্জাতিক সম্মাননা লাভ করেছিল। কারণ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের কোনো বাংলা ছবি হিসেবে তাসখন্দ চলচ্চিত্র উৎসবে ‘সুতরাং’ ব্যাপক সম্মান পায়। মানে ‘সুতরাং’ দিয়েই বাংলাদেশি ছবির আন্তর্জাতিক সম্মাননা প্রাপ্তি শুরু।’ সুতরাং সিনেমার নায়িকা হিসেবে কবরীও দেশ-বিদেশে প্রশংসিত হন।
এর পর থেকেই দুর্বারগতিতেজন প্রিয় নায়িকা হিসেবে চলচ্চিত্র দুনিয়ায় কবরীর শুধুই এগিয়ে চলার পালা। একদিকে তার দক্ষ অভিনয় অন্যদিকে মনকাড়া ভুবন ভুলানো হাসি দিয়ে সহজেই তিনি দর্শকমন হরণ করেন। তাই দর্শকরা তাঁর নামের আগে ‘মিষ্টি মেয়ে’ জুড়ে দেয়।
চলচিত্রের ধ্রুব তারাদের নিয়ে আমার লেখা গুলো পড়ে আসতে পারেন
তখন সময়টি ছিলউর্দু ছবির বাজার। এ সময় পাকিস্থানী নায়ক নায়িকাদের ভিড়ে বাংলা চলচ্চিত্রের নায়িকা হিসেবে দর্ষকের কাছে আস্থাভাজন হয়ে উঠেন কবরী। কবরি অভিনিত জনপ্রিয় সিনেমা সাত ভাই চম্পা,নীল আকাশের নীচে, অরুন বরুন কিরণমালা, ঢেউয়ের পরে ঢেউ, আবির্ভাব, দর্পচূর্ণ, দ্বীপ নিভে নাই, বিনিময়, ময়নামতি,আপন পর, কত যে মিনতি, সিনেমা দিয়ে স্বাধীনতা পূর্ব বাংলা চলচ্চিত্রে হয়ে উঠেন সবচেয়ে জনপ্রিয় নায়িকা। খ্যাতনামা পরিচালক জহির রায়হানের উর্দু ছবি ‘বাহানা’-তেও নায়িকা হিসেবে কবরী কে কাস্ট করেছিলেন ।
সম্প্রতি না ফেরার দেশে ফেরা এই জনপ্রিয় অভিনেত্রী তার মৃত্যুর আগে এক সাক্ষাৎকারে নিজের সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছিলেন, তখন আমি ক্লাস সিক্সের ছাত্রী। আমার বয়স ছিল মাত্র ১৩ বছর। পরিচালক সুভাষ দত্ত একটা কিশোরীর ভূমিকার জন্য খুঁজে আমাকে তার সিনেমায় নিয়ে নেন। আমি সাংস্কৃতিক পরিবারে মানুষ হয়েছি। আমার মা পুঁথি পড়তেন, ভাইবোনেরা নাচ-গানের সাথে আগে থেকে যুক্ত ছিল, ছোট ভাই তবলা বাজাতেন। আমি নাচ করতাম। তবে সিনেমায় অভিনয়ের আগে কখনো অভিনয় করিনি। যখন অফার পেলাম, তখন বাবা খুবই উৎসাহিত হলেন। মা প্রথমে মেয়েকে সিনেমায় দিতে চাননি। তিনি বললেন, এতে ওর পড়াশোনা নষ্ট হয়ে যাবে। আমার মায়ের ছোটবেলায় বিয়ে হয়ে যায়। তিনি বেশি পড়াশোনা করতে পারেননি। তাই তাঁর খুব শখ ছিল মেয়েকে পড়া লেখা করাবেন। আমি মুলত সিনেমায় কাজের সুবাদে সুভাষ দত্ত,খান আতা, ফজলে লোহানী, জহির রায়হান প্রমুখ পরিচালকদের কাছ থেকে অভিনয় শিখেছি।
ছবি – নায়ক রাজ রাজ্জাক এবং কবরী। সোর্স – shatakantha.com
বলা হয়, নায়করাজ রাজ্জাক বাংলা চলচ্চিত্রের নীল আকাশের নীচে সদর্পে বিচরণ করতে পেরেছিলেন কবরীর মতো নায়িকাকে সহ শিল্পী হিসেবে পেয়েছিলেন বলেই, মিঞা ভাই খ্যাত ফারুক চলচ্চিত্রের নীল দরিয়ায় নাও চালিয়ে সফল হয়েছিলেন কবরীকে পাশে পেয়েছিলেন বলে। বুলবুল আহমেদের ক্যারিয়ারেও সবচেয়ে জনপ্রিয় নায়িকা কবরী। চিত্রনায়ক রিয়াজের কাছে তিনি চিরসবুজ নায়িকা। উপমহাদেশের প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক ঘটকের ছবি ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ সিনেমার নায়িকা হয়েছিলেন। কবরী দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ঢাকায় ফিরে এসে আবারও চলচ্চিত্রে অভিনয় শুরু করেন।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে চিত্রনায়িকা কবরী প্রথমে তার পরিবারের সদস্যদের সাথে ঢাকা থেকে চট্রগ্রামের গ্রামের বাড়ি চলে যান তিনি। সেখান নিরাপদ না মনে হলে পাড়ি জমান ভারতে। ভারতের কলকাতায় গিয়ে কবরী মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে মানুষের ভিতর জনমত সৃষ্টি করতে বিভিন্ন সভা-সমিতি ও অনুষ্ঠানে বক্তৃতা এবং বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগ দিতেন । তখনকার স্মৃতি স্মরণ করতে গিয়ে একবার কবরী তার সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, ‘সেখানকার এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের অবস্থার কথা তুলে ধরেছিলাম। কীভাবে আমি মা-বাবা, ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন সবাইকে ছেড়ে এক কাপড়ে পালিয়ে সেখানে পৌঁছেছি, সেই অভিজ্ঞতার কথা বলেছিলাম। সেখানে গিয়ে তাদের মাধ্যমে বিশ্ববাসীর কাছে পাকিস্থানী হানাদার বাহিনির বিপক্ষে আমাদের দেশকে সাহায্যের আবেদন করি। ’
শতাধিক সিনেমার নায়িকা কবরী বিংশ শতাব্দীর ষাট ও সত্তরের দশকের বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় চলচ্চিত্রের নায়িকা কবরী শেষ জীবনে চলচ্চিত্র পরিচালনার সাথে যুক্ত হন এবং রাজনীতিবিদ হিসেবে নাম লেখান। কবরীর বাবার নাম শ্রীকৃষ্ণ দাস পাল এবং মায়ের নাম ছিল শ্রীমতি লাবণ্য প্রভা পাল। ১৯৬৩ সালে মাত্র ১৩ বছর বয়সে নৃত্যশিল্পী হিসেবে মঞ্চে আবির্ভাব হওয়া কবরী ২০২১ সালে প্রান ঘাতি করনায় আক্রান্ত হয়ে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান।
Leave a Reply