পৃথিবীতে প্রতি দিন ঘটে চলে কত শত অদ্ভূত ঘটনা। মিডিয়ার কল্যাণে এর কিছু কিছু খবর আমাদের নজরে আসে ঠিকই, কিন্তু এর বেশির ভাগই ঢেকে যায় খবরের অন্তরালে। নইলে আপনি কি কখনো শুনেছেন ? একজন যৌনদাসীর নোবেল পুরষ্কার পাওয়ার খবর, তাও আবার শান্তিতে !
যদি না শুনে থাকেন তবে সৃজনশীল ব্লগ কালাক্ষরের আজকের প্রতিবেদন টি আপনার উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা হল। যাকে নিয়ে আমাদের আজকের প্রতিবেদন তার পুরো নাম ‘নাদিয়া মুরাদ বাসী তাহা’ ! যদিও সবাই তাকে নাদিয়া মুরাদ নামেই বেশি চেনে।
লেখাটিতে আরো যা জানতে পারবেন
ছোটবেলা থেকে নাদিয়ার স্বপ্ন ছিল সে একজন স্কুল শিক্ষিকা হবে এর পাশা পাশি সে নিজের একটা বিউটি পার্লার খুলবে। কিন্তু মাত্র 21 বছর বয়সে এসে তার স্বপ্নগুলোরই কেবল অপমৃত্যু ঘটেনি, বরং ধ্বংস হয়ে গেছে তার পুরো পৃথিবীও। অবস্থা এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌছিয়েছিল যে তার নিজের জীবনটাও শেষ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল।
নাদিয়া ইরাকের উত্তরাঞ্চলে সিরিয়া সীমান্তের খুব কাছাকাছি ছোট্ট একটি গ্রাম কোযো তে তার আপন ও সৎ ছয় ভাই এবং মা কে নিয়ে থাকতেন। মোটামুটি সাজানো গোছানো একটি সংসারই ছিল তাদের। কিন্তু সেই সাজানো সংসার ভেঙে তছনছ হয়ে যায় যেদিন তাদের গ্রামে IS (Islamic state) জঙ্গীরা আসে। দিনটি ছিল ২০১৪ সালের আগস্ট মাসের ৩ তারিখ।
কালাক্ষর ব্লগে আমার লেখা পুরাতন পোষ্ট গুলো পড়ার অনুরোধ রইল
নাদিয়ারা ছিলেন ইরাকের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ইয়াজিদির অন্তর্ভুক্ত। তাদের গ্রামের বেশিরভাগ মানুষই ছিলেন ইয়াজিদি। কিন্তু আইএস জঙ্গীরা এসে তাদেরকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করে। যারা এতে অস্বীকৃতি জানায়, তাদেরকে হত্যা করা হয়। আর এভাবে বেঘোরে প্রাণ হারান নাদিয়ার ছয় ভাই ও মা। নাদিয়া কম বয়সী হওয়ায় নাদিয়াকে বলা হয়, সে যদি ধর্মান্তরিত হয় তবে তাকে ছেড়ে দেওয়া হবে। কিন্তু নাদিয়া এতে রাজি না হওয়ায় তাকে অন্যান্য তরুণীদের সাথে একটি ট্রাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয় ইসলামিক স্টেটের তথাকথিত রাজধানী মোসুলে। সেখানে হাজী সালমান নামের একজন উচ্চপদস্থ মিলিটারি ব্যক্তির হাতে তাকে সপর্দ করা হয়। এরপর নাদিয়াকে জোর পূর্বক ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করিয়ে,পরিণত করা হয় আই এ এস এস জঙ্গিদের যৌনদাসীতে, তিন মাস ধরে উপর্যুপরি বেশ কয়েকবার তাকে বিভিন্ন খদ্দেরের কাছে বিক্রিও করা হয়।
প্রতীকী ছবি – সোর্স – facebook.com
এ বিষয়ে নাদিয়া বলেন, “একটা সময়ে অবস্থা নাদিয়ার অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছিল যে, নাদিয়ার প্রাত্যহিক রুটিন বলতে কেবল একটি জিনিসই করতে হত, আর তা হলো আই এস জঙ্গিদের কাছে নাদিয়ার ধর্ষিত হওয়া। বিষয়টা এমন, “শুধুমাত্র ধর্ষিত হওয়াই যেন আপনার একমাত্র কাজ।”
নাদিয়া প্রায় তিন মাস একটানা অত্যাচার, ধর্ষণ, সিগারেটের ছ্যাকা এবং মানসিক যন্ত্রণা সহ্য করার পর একপর্যায়ে পালাবার চেষ্টা করেন। তখন আই এস জঙ্গিদের চোখে ধুলো দিয়ে পালানোর চেস্টা করা ছিল খুবই কঠিন, রীতিমত দুঃসাধ্য, একটি কাজ। যা করতে গিয়ে নাদিয়া তাই স্বাভাবিকভাবেই আই এস জঙ্গিদের হাতে ধরা পড়ে যান।
পালানোর চেষ্টা করা যৌনদাসীদের ক্ষেত্রে আইএসের জঙ্গীদের বিশেষ একটি আইন ছিল, কোনো যৌনদাসী যদি পালাবার চেষ্টা করে, তবে তাকে একটি সেলে আটকে রেখে ওই কম্পাউন্ডের সকল পুরুষকে দিয়ে একসাথে গণধর্ষণ করানো হবে। আই এস জঙ্গিদের মতে, এর নাম ‘যৌন জিহাদ’! আর যেহুতু নাদিয়া পালাবার চেষ্টা করেছিল তার শাস্তিস্বরূপ এই বিশেষ যৌন জিহাদের শিকার হতে হয়েছিল।
যৌন জিহাদের শাস্তি ভোগ করার পর এক পর্যায়ে নাদিয়াকে মোসুলে এমন এক ব্যক্তির কাছে বিক্রি করে দেয়া হয়, যে একা বাস করতো। একদিন রাতে সে ভুলে দরজা তালা দিতে ভুলে যায়। সেইরাতেই নাদিয়া নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাতের অন্ধকারে দেয়াল টপকিয়ে বন্দিশালা থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হন। এবং প্রতিবেশী এক মুসলিম পরিবারে আশ্রয় নেন।
সৌভাগ্যক্রমে, নাদিয়াকে আশ্রয় দেওয়া মুসলিম পরিবারটি ছিল খুবই সহৃদয় সম্পন্ন এবং আইএস জঙ্গিদের সাথে পরিবারটির কোনো ধরণের যোগাযোগ ছিল না। পরিবার টির সদস্যরা নাদিয়াকে ছদ্ম পরিচয়ে নিজেদের কাছে নিরাপদে রাখেন এবং রোয়াঙ্গা ক্যাম্পে আশ্রয় নেওয়া পর্যন্ত নাদিয়া তাদের কাছেই থাকেন। এর কিছু দিন পর নাদিয়া ইউরোপে চলে যান।
বর্তমানে নাদিয়া জার্মানিতে শর্নার্থি হিসেবে বাস করেন। নাদিয়া মুক্ত পৃথিবীতে ফিরে আসার পরও, দীর্ঘদিন ধরে প্রচণ্ড শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণায় ভুগেছেন। ক্রমাগত পশুসুলভ পুরুষদের দ্বারা ধর্ষণের শিকার হওয়ার দুঃসহ স্মৃতি তাড়া করে বেড়িয়েছে নাদিয়াকে। এক পর্যায়ে নিজেকে পাগলের মত লাগতো। কিন্তু তার পরেও খুবই শক্তমনের মেয়ে হওয়ায় এত সহজে ভেঙে পড়েননি। এক সময়ে মনের সমস্ত সাহস ও শক্তিকে একত্র করে তিনি সিদ্ধান্ত নেন, তার অভিজ্ঞতার কথা বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরবেন তিনি। এ ব্যাপারে তিনি বলেন তখন আমার জীবনের গল্পটাই ছিল তাদের বিরুদ্ধে আমার একমাত্র হাতিয়ার। সেই থেকে আইএসের হাতে বন্দি ইয়াজিদি অসহায় মানুষদের রক্ষার জন্য কাজ করে চলেছেন তিনি। এছাড়াও বৃহৎ পরিসরে কাজ করছেন বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা রিফিউজি ও নারী অধিকার নিয়েও।
ইসলামিক স্টেট এর জঙ্গিরা ইয়াজিদিদের সাথে যে নির্মমতা চালিয়েছিল, নাদিয়া তার সুষ্ঠু বিচার চান। আর সেই জন্য নাদিয়া বিশ্ব জনমত গড়ে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। নাদিয়া নিজের জীবনের কাহিনী নিয়ে 2017 সালের 7 নভেম্বর “The Last Girl” নামে একটি আত্মজীবনীও প্রকাশ করেছেন। আত্মজীবনীর এমন নামকরণের পেছনের কারণটিও চমৎকার ভাবে নাদিয়া ব্যাখ্যা দেন। নাদিয়া চান, তার এমন করুণ অভিজ্ঞতা হওয়া মেয়ের উদাহরণ যেন পৃথিবীতে তিনিই শেষ হন। ২০১৯ সালের 19 অক্টোবর মুক্তি পেয়েছে তার জীবনের উপর ভিত্তি করে নির্মিত প্রামাণ্য চলচ্চিত্র- ‘On her shoulders” যা ইতিমধ্যে বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছে।
আই এস জঙ্গীদের বিচার চাইতে ছুটে চলেছেন নাদিয়া। এই ছুটে চলার পথে তার সহকর্মী হয়েছেন তার জীবনসঙ্গী আবিদ শামদীন। কিন্তু নাদিয়ার এই ছুটে চলা কি কোনো বিজয় নিশান উড়তে থাকা গন্তব্যের উদ্দেশে? নাকি দুঃস্বপ্নের মতো আসা তার অতীত জীবন থেকে পালিয়ে বাঁচতে? নাদিয়া কি পারবেন তার অতীত কে ভুলে যেতে?
হয়ত পারবেন হয়ত পারবেন না,তবে তিনি যে অসীম সাহসিকতা দেখিয়ে চলেছেন, তার কোনো তুলনা হয় না। তিনি তার জীবনে যে ধরণের নৃশংসতার শিকার হয়েছেন, তাতে মনুষ্যত্বের উপর থেকে তার ভালোবাসা উঠে যাওয়া অস্বাভাবিক কিছু ছিল না। কিন্তু তিনি এখন তার জীবনকে উৎসর্গ করেছেন সেই মানুষের কল্যাণের স্বার্থেই।
যৌনদাসী থেকে নোবেল বিজয়ী নাদিয়ার এই ছুটে চলা যেন চিরকাল অব্যাহত থাকে। নাদিয়া যেন তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে সমর্থ হন এটাই সকল বিবেকবান মানুষের চাওয়া। তাহলে সেই সাফল্য কেবল ব্যক্তি নাদিয়াতেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, জয় হবে গোটা মানবতার ও। ভাল থাকবেন।
Leave a Reply