মানসুর আল–হাল্লাজ (ফার্সি: منصور حلاج Mansūr-e Ḥallāj; পুরো নাম আরবি: “أبو عبد الله حسين بن منصور الحلاج” আবু আব্দুল্লাহ হুসাইন ইবনে মানসুর আল-হাল্লাজ) (জন্মঃ ৮৫৮ খ্রিস্টাব্দ – ইরানের ফারস প্রদেশ। মৃত্যুঃ মার্চ ২৬, ৯২২ খ্রিষ্টাব্দ) মানসুর আল–হাল্লাজ ছিলেন একজন ইরানী মরমি সুফী, বৈপ্লবিক সাহিত্যিক এবং সুফিবাদ-এর একজন দিকদর্শি। তিনি মুসলিম জগতে আলোচনার সাথে সাথে বিতর্কিত হয়েছিলেন তার চরম বিতর্কিত বক্তব্য “আনাল হাক্ক” (“আমিই পরম সত্য”) এর ফলে। তদানন্তিন কালে মানসুর আল–হাল্লাজ এর এই বক্তব্য শুনে তখনকার মুসলিম আলেম সমাজের ভিতর মানসুর আল–হাল্লাজ এর উপর চরম অসন্তোস ছড়িয়ে পরে এবং আব্বাসীয় খলিফা আল মুকতাদির দরবারে মানসুর আল–হাল্লাজ এর বিচারের দাবি জানায় । লম্বা বিচার-প্রক্রিয়ার পর আব্বাসীয় খলিফা আল মুকতাদির মানসুর আল–হাল্লাজ এর মৃত্যুদন্ডের আদেশ দেন।
মনসুর আল-হাল্লাজ এর পিতা এবং তার বংশের লোক জন ছিলেন একজন সুতা-প্রস্তুতকারক। তাই তার নামের সাথে তাদের পারিবারিক ব্যাবসার নাম হাল্লাজ জুড়ে যায়। হাল্লাজ শব্দের অর্থ সুতা প্রস্তুতকারক। বিষ্ময় আর বিতর্কে ভরা মানসুর আল হাল্লাজকে নিয়ে মানুষের কৌতুহলের কমতি নেই৷ যুগ যুগ ধরে মনসুর আল হেল্লাজের প্রসঙ্গে মানুষের ভিতর তার কর্ম নিয়ে বহু আলোচনা হয়ে আসছে। ইতিহাসের আলোচিত এই সুফিসাধকে নিয়ে হয়ে আসছে তর্ক বিতর্ক। শুধু সাধারন মানুষ নয় উলামায়ে কেরামের মধ্যেও তাকে নিয়ে রয়েছে নানান মতভেদ। কেউ তাকে বলে দরবেশ আবার কেউ বলে কাফের৷ হাক্বিমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানবী (রহঃ) এর একটি বক্তব্যে তাকে দরবেশই বলা হয়েছে।
মনসুর হাল্লাজের পিতামহ ছিলেন ইরানীদের আদী ধর্ম যরথুস্থের অনুসারী অর্থাৎ যরথুস্থরা ছিল অগ্নিপূজক। পরবর্তীতে মনসুর হাল্লাজের পিতামহ ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন। যে সময়ের কথা বলছি সেই সময়ে পারস্যে মুসলমানদের অনেকেই ধর্মাচরণের জন্য সুফি-সাধনার পথ বেছে নিতেন। নানান জায়গায় সুফিদের নিয়ে মজলিশ হত। এই সূত্রে শৈশব থেকেই সুফিদের মজলিশে মনসুর হাল্লাজ আসা-যাওয়া করার সুযোগ পেয়েছিলেন। আর তার ভিতর মুলত তখন থেকেই সুফিবাদ বিকশিত হয়। ফলে বয়স বারার সাথে সাথে তাঁর ভেতরে আল্লাহর সাথে নৈকট্য লাভের আকাঙ্ক্ষা তীব্রতর হয়ে উঠতে থাকে। মানসুর আল হেল্লাজ মাত্র ১২ বছর বয়সে তিনি কুরআনের হাফেজ হন।
১৮ বছর বয়সে মানসুর আল–হাল্লাজ তুস্তারে যান এবং সেখানকার সুফি সাহল আল-তুস্তারির শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। দুই বছর এই গুরুর কাছে শিক্ষা গ্রহণ করার পর মানসুর আল–হাল্লাজ আব্বাসিয় খিলাফতের রাজধানী বাগদাদ হয়ে বসরায় চলে আসেন। বসরাতে তিনি আমর ইবনে ওসমান আল-মক্কির শিষ্যত্ব গ্রহণ করে গুরু আমরের সাহচর্যে প্রায় দুই বছর অতিবাহিত করেন।
তরুণ আল-হাল্লাজ বিয়ে করেন বিয়ের পর মক্কায় হজ করতে যান, সেখানে তিনি এক বছর সময় অতিবাহিত করেন, এরপর মানসুর আল–হাল্লাজ মক্কা নগরী ত্যাগ করেন, লম্বা এক সফরে সময় ব্যয় করেন আর পথিমধ্যে শিক্ষাদান এবং লেখালেখি করেন।
বাগদাদে বিখ্যাত ওলি জুনায়েদ বাগদাদির শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন এর পর তিনি হেজাজ হয়ে হজ্জের জন্য মক্কা নগরিতে চলে যান। সেখানে তিনি সর্বদা ধ্যান মগ্ন অবস্থায় সময় অতিবাহিত করতেন। এ সময় প্রতিদিন এক ব্যক্তি কয়েকটি রুটি ও এক পাত্র পানি তাঁর সামনে রেখে যেতেন। হাল্লাজ কদাচিৎ রুটির কিছু অংশ খেতেন বা সামান্য পানি পান করতেন। ফলে তাঁর শরীর শুকিয়ে হাড্ডি সর্বস্ব হয়ে যায়। মুনসুর হাল্লাজের ‘আনাল হক’ মতবাদই তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। যার কারনে তিনি মুসলিম জাহানে বিতর্কিত ব্যক্তিতে পরিনত হন।
হজ্জের পর মনসুর আল হাল্লাজ বাগদাদে ফিরে আসেন এবং ২৭০ হিজরিতে বিভিন্ন দেশে ভ্রমন করতে বের হন। এবং এক সময় মানসুর আল–হাল্লাজ ভারতবর্ষে সফর করেন। ভারতবর্ষে সফর করার সময় তার অনেক ভক্ত তৈরি হয়৷ ভারতবর্ষে মানসুর আল–হাল্লাজ এর মুরিদদের মধ্যে অনেকেই সে সময় তার ২য় এবং ৩য় হজ্বের সফরে সফরসঙ্গী হন। তার এই সফরকালীন সময় অতিবাহিত করার পরে তিনি বাগদাদের প্রাণকেন্দ্র আব্বাসিদ এ অবস্থান শুরু করেন। মানসুর আল–হাল্লাজ প্রাথমিক যুগে জুনায়েদ বাগদাদী এবং আমর-আল-মক্কীর শিষ্য ছিলেন, কিন্তু পরে তার বিতর্কিত কিছু কর্মকান্ডের দরুন তারা দুজনেই মানসুর আল–হাল্লাজ কে পরিত্যাক্ত করেন। কথিত আছে সাহল আল-তাশতারিও আল-হাল্লাজের একজন প্রাথমিক যুগের উস্তাদ ছিলেন।
বিতর্কে মোড়ানো মনসূর হাল্লাজ সম্পর্কে কথিত আছে একদিন মানসুর আল–হাল্লাজ ধ্যানরত অবস্থায় এক জ্যোতির্ময় পুরুষকে দেখতে পান। মানসুর আল–হাল্লাজ তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন, কে তুমি ? ওই জ্যোতির্ময় পুরুষ তখন মানসুর আল–হাল্লাজ কে উত্তর দেন ‘আনাল হক’ অর্থাৎ ‘আমিই পরম সত্য’। উল্লেখ্য ’আল-হক’ হচ্ছে আল্লাহ তায়ালার ৯৯টি নামের একটি। আল্লার এই রূপ এবং বাণী দ্বারা তিনি এতটাই অভিভূত হয়ে পড়েন যে, তিনি মন্ত্রমুগ্ধের মতো উচ্চারণ করতে থাকেন ‘আনাল হক’। এই থেকে তিনি ‘আনাল হক’ নামে পরিচিতি লাভ করেন। আর সে কারনেই তিনি মুসলিম জাহানে এত বেশি সমালোচিত হয়েছেন।
সে সময় বেশিরভাগ আলেম মনসুর আল হাল্লাজের এমন আরচণের বিরোধিতা করেছিলেন। এর কারণ আনাল হক বা ‘আমিই পরম সত্য’ এক অর্থে তা আল্লাহ বিবেচনা করে,যা ইসলাম ধর্মে চরম শিরকের পর্যায়ে পড়ে। তাই তারা মনসুর আল হাল্লাজের এভাবে নিজেকে আনাল হক বলাকে অমার্জনীয় অপরাধ হিসেবে গণ্য করেছিলেন । কেউ কেউ তাঁকে ফেরাউনের সাথে তুলনা করেছিলেন।
কিন্তু অনেক সুফি মনে করতেন তিনি নিজেকে আল্লাহ দাবি করার অর্থে আনার হক বলেন নি। সুফিরা জানতেন, কেন ? আর কোন অর্থে মনসুর আল হাল্লাজ নিজেকে আনাল হক বলছেন। আল্লাহ পাকের প্রেমে মনসুর হেল্লাজ এতটাই মশগুল হয়ে গিয়েছিলেন যে, আল্লাহর সাথে তাঁর নৈকট্য খুব গভীর হয়ে উঠেছিল,তাই তিনি নিজের নাম পর্যন্ত ভুলে গিয়েছিলেন। তিনি নিজেকে আল্লাহ ছাড়া অন্য কিছু ভাবতেন না।
মানসুর হাল্লাজ বিশ্বাস করতেন যে, একমাত্র আল্লাহ-তাআলাই পারেন আল্লাহ্ পাকের নিজের একত্বের ঘোষণা দিতে; অপরপক্ষে, মানুষের ইবাদত শুধুমাত্র তার হুকুমের প্রতিফলন মাত্র, আর তার আদেশের সামনে মাথা নত করা। “ভালবাসা মানে প্রিয়জনের পাশে দাড়িয়ে থাকা, নিজের আমিত্বকে পুরোপুরি অস্বীকার করা আর নিজেকে তার(খোদার) রঙে রাঙিয়ে নেয়া” ((Massignon, পৃ:৭৪)। তিনি আল্লাহর ব্যপারে উল্লেখ করতেন নিজের “প্রেমাস্পদ”, “বন্ধু”, “তুমি” ইত্যাদির মাধ্যমে, আর অনুভব করতেন যে “তার একমাত্র স্বত্তাই তিনি(আল্লাহ)”. “ব্যপারটা এতদুর গড়িয়েছিল যে মানসুর আল হেল্লাজ অনেক সময় নিজের নামটি পর্যন্ত স্মরণ করতে পারতেন না” ((Mason, পৃ:২৬)।
হাকিমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানবী রহঃ মনসুর হেল্লাজ এর উপর একটি গ্রন্থ “সিরা্তে মনসুর হাল্লাজ ” রচনা করেন,এই গ্রন্থে তিনি লিখেছেন, “অনেকেই মনসুর হাল্লাজের এমন কিছু কথার কারণে ধোঁকায় নিপতিত হয়েছে, মনসুর যা ভ্রমগ্রস্থ অবস্থায় বলেছিলেন৷ আর তার সেই কথাগুলোই এতটা আলোচিত হয় যে, তিনি সুস্থ মস্তিষ্কে তাওহিদের যেই ঘোষণা দিয়েছেন মানুষ আর সেইদিকে ভ্রুক্ষেপ করে নাই।”
মনসুর হাল্লাজ সেসময় একটি গ্রন্থ ‘কিতাবুত তাওয়াসিন’ রচনা করে মুসলিম সমাজে হৈ চৈ ফেলে দেন৷ তখন তার বিরোধিরা বাধ্য হয়ে আইনের আশ্রয় নেয় এবং তৎকালীন আব্বাসীয় খলিফা মুকতাদির বিল্লাহ’র কাছে বিচারের আবেদন করেন। পরবর্তীতে দেশের প্রধান বিচারপতি কাজি আবু উমর মুহাম্মাদ ইবন ইউসুফ আল-মালেকি রহ.-সহ সে সময়ে বাগদাদের সর্বোচ্চ বিদ্বানমণ্ডলীর মতামত ও বিচারকদের রায়ে তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।
যদিও মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার পূর্বে মানসুর হেল্লাজ যে অনেকবার তার মতবাদ থেকে ফিরে আসতে বলা হয়েছিল, কিন্তু তিনি তা গ্রহণ করেনি। দীর্ঘ ৯ থেকে ১১ বছর কারাভোগের পর মানসুর হেল্লাজ কে জনসম্মুখে হাত-পা কেঁটে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়। মৃত্যু দন্ড কার্যকর করার পর তারা মনসুর হেল্লাজের মাথা কেটে ঝুঁলিয়ে দেওয়া হয় এবং লাশ পুঁড়িয়ে ফেলা হয়।
কথিত আছে, তৎকালীন আব্বাসিয় খেলাফতের অধিন বহু উলামায়ে কেরাম মানসুর আল হেল্লাজের মৃত্যুদণ্ডের কালে এই বলে কেঁদেছিলেন যে, যদি ফেতনার আশংকা না থাকত, তাহলে আমরা মনসুর হাল্লাজের মৃত্যদণ্ডের পক্ষে মত প্রদান করতাম না।
তথ্যসূত্রঃ
১. মেসোন, পৃঃ নঃ ২৬
২. মেসোন পৃঃ নঃ ৭৪
৩. ফাতেহ সংখ্যা/বিস্ময় বিতর্কের মনসুর হাল্লাজঃ
৪. The Tawasin of Mansur Hallaj
Leave a Reply