মিস্টার পারফেকশনিস্ট খ্যাত বহুমুখী প্রতিভা আমির খান বলিউডের সিনেমার এক জ্বলজ্বলে নক্ষত্রের নাম। কোন সিনেমা ইন্ড্রাস্টি তে জনপ্রিয় আর নামকরা তারকা অনেক আসে আবার চলে যায়, কিন্তু নিজেকে আমির খানের মতো নিখুঁত হয়ে ওঠার পর্যায়ে খুব কম মানুষ ই নিয়ে যেতে পারেন? কতজন নিজের অভিনয়কে শুধুমাত্র বিনোদনের সীমানা থেকে বের করে মানুষের চিন্তাধারায় প্রভাব ফেলার মতো পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারেন? তার অভিনীত, প্রযোজিত প্রত্যেকটি সিনেমাই যেন সমাজের একেকটি আয়না, কোনো না কোনো জীবনের গল্প বলে। তার নিজের জীবনেও যে চড়াই-উৎরাই ছিল না তা নয়, কিন্তু তিনি পৃথিবীর সেসব মানুষদের মধ্যে একজন, যারা নিজেদের জীবনের গল্পটা নিজে লেখে, তাদের জীবনে ঘটে যাওয়া ভালো-খারাপ সকল ঘটনাকেই জীবনের অনুপ্রেরণার প্রথম উৎস বানিয়ে ফেলে আর সেখান থেকে শুরু করে তাদের চলার পথের নতুন গল্প।
‘অন্তক হি অন্তক’ (১৯৯৫) সিনেমাটিতে কাজ করার সময় আমির খান তার অভিনয় সম্পর্কে গভীর অনুধাবন করতে শুরু করেন। যাতে আমির খানের অভিনয় প্লাস তাঁর ক্যারিয়ার নিয়ে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গী পালটে যায়। হলিউডের সিনেমা ‘দ্য গডফাদারের’ অনুকরণে তৈরি এই সিনেমায় আমিরের অভিনয় ও মাইকেল কর্লিওনির চরিত্রে উপস্থাপনের ক্ষেত্রে নিজের ব্যর্থতা যখন তার সামনে আসে, তখন তিনি নিজেই বলেন,
“সিনেমাটি মুক্তি পাওয়ার পর আমি চমকে গিয়েছিলাম। আমার মনে হলো এই সিনেমাটিতে অভিনয় করাটাই আমার মস্ত বড় ভুল ছিলো। আমরা ভারতীয় দর্শকদের কথা মাথায় রেখে সিনেমাটি বানিয়েছিলাম, কিন্তু আমরা ভারতীয় প্রেক্ষাপটে ছবিটি ফুটিয়ে তুলতে পারিনি। কিন্তু পুরো সিনেমাটিতে আমাকে কোট পরা অবস্থায় দেখা গেছে। এখানকার গরমে কেউ কোট কেন পরবে?”
আমির খান তাঁর নিজের ভুলের প্রতি এই অনুধাবন তার পরবর্তী প্রতিটা সিনেমাকে শিল্পের এক অসাধারণ বাস্তব রূপ দান করে। আমির খান যেন মানুষের সত্যিকারের জীবন থেকে সত্য আর বাস্তবতাকে নিংড়ে নিয়ে তার ক্যারেক্টর গুলো তাঁর করা পরবর্তী প্রত্যেকটা সিনেমায়, তাঁর চরিত্র আর চরিত্রের গল্প সাজাতে থাকেন, তা দেখে মনে হয় যেন অভিনয়ের শিল্পীর এ এক অন্যরকম সাধনা। আমির খান ‘অন্তক’ সিনেমায় অভিনয় করার পর বলেছিলেন,
“ ঐ সিনেমাটি দেখার পর আমি এতটা হতাশা গ্রস্থ হয়েছিলাম যে সেই হতাশা থেকে আমি প্রায় তিন থেকে চার সপ্তাহ ঘুমাতে পারিনি। শুধু ভাবতাম যে আমার সাধারণ বোধবুদ্ধি লোপ পেয়েছে?”
মিস্টার পারফেকশনিস্ট: আমির খান Source: suchanapatal.com
মূলত এর পর থেকেই আমির খানের ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প শুরু। বিষয় টি নিয়ে আমির খান বলেন
“এটি ছিল আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া অনুধাবন। এরপর থেকে আমি আমার সর্বোচ্চ আন্তরিকতা আর স্বচ্ছতার সাথে সিনেমা আর চরিত্র বাছ বিচার করতে শুরু করি। বেছে নেওয়া চরিত্রটি সিনেমায় ফুটিয়ে তুলতে আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকে। যা আমার অভিনীত সিনেমা গুলোতে আমার করা চরিত্রগুলোকে এতটা বাস্তব আর গ্রহণযোগ্য করে তোলে।”
মূলত এর পর থেকেই আমির খান একশান কাহিনী নির্ভর তথাকথিত মাল মসলাদার নাচ-গান আর নাটকীয়তা পূর্ণ ও আইটেমগান যুক্ত বাণিজ্যিক সিনেমার বাইরে কাহিনীনির্ভর, বাস্তবধর্মী ও অনুপ্রেরণামূলক অসাধারণ সব সিনেমা উপহার দিয়ে যাচ্ছেন।
চলচিত্রের ধ্রুব তারাদের নিয়ে আমার লেখা গুলো পড়ে আসতে পারেন
বলিউডের সেই সকল তারকাদের মধ্যে আমির খান একজন, যে সব তারকারা শুধুমাত্র নিজের জাঁকজমক বা সৌন্দর্য দিয়েই নয়, নিজের প্রতিভা আর সাধনা দিয়ে বিনোদনের জগতে প্রতিনিয়ত নিজের স্বাক্ষর রেখে যাচ্ছেন। আমির খান নিজের সাধনা আর পরিশ্রমের ফলস্বরূপ পেয়েছেন উপযুক্ত স্বীকৃতি ও সম্মান। তার ঝুড়িতে এসেছে ভারতের তৃতীয় ও চতুর্থ সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মাননা পুরষ্কার ‘পদ্মভূষণ’ (২০১০) ও ‘পদ্মশ্রী’ (২০০৩)।
মিস্টার পারফেকশনিস্ট খ্যাত বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী আমির খান তাঁর ক্যারিয়ারের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত নিজের অভিনয় সক্ষমতা দিয়ে সমালচকদের প্রসঙ্গসা পেয়েছেন সর্বত্র। ‘কেয়ামত সে কেয়ামত তাক’, ‘লাগান’,পিকে, থ্রি ইডোয়েট ‘ম্যাডনেস ইন দ্য ডেজার্ট’ ও ‘তারে জামিন পার’- আমির খানের করা এই অনন্য সিনেমাগুলোর জন্য পেয়েছেন ছয়টি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার। চলচ্চিত্রের সবচেয়ে বড় পুরস্কার ‘অস্কারের’ জন্য ‘লাগান’ মনোনীত হয়েছিল শ্রেষ্ঠ বিদেশী ভাষার চলচ্চিত্রের ধারাতে। এ পর্যন্ত আমির খান অর্জন করেছেন নয়টি ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড। ‘বলিউড চলচ্চিত্র অ্যাওয়ার্ড’ ও ‘আন্তর্জাতিক ভারতীয় চলচ্চিত্র একাডেমি অ্যাওয়ার্ড’ এর মতো আরো অসংখ্য পুরষ্কার তার প্রতিভাকে সম্মান জানিয়েছে। তার অভিনীত ‘তারে জামিন পার’, ‘থ্রি ইডিয়টস’ ও ‘পি কে’ এর মতো সিনেমাগুলো মানুষের চিন্তার জগত ও দৃষ্টিভঙ্গীকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করতে পারে। তাই ২০১৩ সালে ‘দ্য টাইমস’ ম্যাগাজিন তাকে অন্তর্ভুক্ত করেছে বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী ১০০ ব্যক্তির তালিকায়। আর ‘ফোর্বস’ ম্যাগাজিন এশিয়ার প্রেক্ষাপটে, বিশেষ করে বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দুটি দেশ চীন ও ভারতে তার আকাশতুল্য জনপ্রিয়তাকে মাথায় রেখে তাকে ‘তর্কসাপেক্ষে বিশ্বের সবচেয়ে বড় চলচ্চিত্র তারকা’ উপাধিও দিয়েছে।
হিউম্যান সাইকোলিজি নিয়ে আমার লেখা পুরাতন পোস্ট গুলো পড়ে আসতে পারেন
আমির খান ব্যাপক জনপ্রিয় ও প্রভাবশালী এই অভিনেতার জন্ম ১৯৬৫ সালের ১৪ই মার্চ মুম্বাইয়ের বান্দ্রার ‘হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে’ রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারে। আমির খানের পুরো নাম আমির হুসেইন খান। আমির খানের বাবা তাহির হুসেইন খান ছিলেন চলচ্চিত্র প্রযোজক ও পরিচালক। আমির খানের মা জিনাত হুসেইন খান ছিলেন গৃহিণী। আমির খানের দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে সবার চেয়ে বড়। আমির খান ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের উত্তরসূরি এবং ভারতের এক সময়ের রাষ্ট্রপতি ড. জাকির হুসেইনের বংশধর। আমির খানের পুর্বসুরীরা আফগানিস্তান থেকে এসে ভারতে বাস করা শুরু করেন। ভারতের বিখ্যাত প্রযোজক, পরিচালক ও চিত্রনাট্য লেখক নাসির হুসেইন ছিলেন আমির খানের বংশের সন্তান। মায়ের দিক থেকে অগ্রগামী রাজনীতিবিদ মওলানা আবুল কালাম আজাদ আমির খানের পূর্বপুরুষদের একজন। আমির খানের বাবা তাহির হুসেইন খানের নেওয়া ঋণ ও প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ার জন্য আমিরের শৈশবে তার পরিবার আর্থিক অস্বচ্ছলতার সম্মুখীন হয়। এমনকি প্রায়ই আমির খানের বাবা আমির খাঁকে যথাসময়ে স্কুলে ভর্তির টাকা দিতে পারতেন না। মূলত তাদের অর্থ কষ্টের কারণেই আমির খানের উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলেই (দ্বাদশ শ্রেনী) শিক্ষা জীবনের সমাপ্তি ঘটে।
আমির খান
Source: banglatribune.com
আমির খান ১৯৭৩ সালে ‘ইয়াদো কি বারাত’ সিনেমাতে শিশুশিল্পী হিসেবে প্রথম অভিনয়ের জগতে পা রাখেন। এরপর আমির খান ‘হোলি’ (১৯৮৪) সিনেমাতে তিনি প্রথম কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেন। ১৯৮৮ সালে মুক্তি প্রাপ্ত আমির খানের প্রথম বাণিজ্যিকভাবে সফল সিনেমার নাম ‘কেয়ামত সে কেয়ামত তাক’। কেয়ামত সে কেয়ামত তাক সিনেমার জন্য আমির খান ১৯৮৮ সালে শ্রেষ্ঠ নতুন মুখ হিসেবে ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড পান। তারপর থেকে এখন পর্যন্ত আমির খানের সফলতার জয়যাত্রা কখনো থামেনি। আমির খান ‘রাখ’ সিনেমাতে অভিনয়ের জন্য ৩৬তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার অনুষ্ঠানে পান ব্যপক প্রশংসা। আমির খানের করা অসাধারণ সিনেমাগুলো মধ্যে আরও আছে দিল, লাগান: ওয়ান্স আপন এ টাইম ইন ইন্ডিয়া, হাম হে রাহি পেয়ার কে, রাজা হিন্দুস্তানী, আর্থ, তারে জামিন পার, গাজনি, তালাশ, পি কে, জো জিতা ওহি সিকেন্দার, দাঙ্গাল, রাং দে বাসান্তি, থ্রী ইডিয়টস এবং সর্বশেষ মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমা সিক্রেট সুপারস্টার।
আমির খান ব্যক্তিগত জীবনে সন্তানের জনক। আমির খান ১৯৮৬ সালের ১৮ এপ্রিল প্রযোজক রিনা দত্তের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। হতাশা গ্রস্থ আমির খানের ক্যারিয়ারকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে তাঁর স্ত্রী রিনা দত্তের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। বহুল চর্চিত “লাগান” সহ আমির খানের জীবনের করা প্রথম দিকে অভিনয় করা আরো অনেক সিনেমার প্রযোজক ছিলেন তাঁর স্ত্রী রিনা দত্ত। আমির ও রিনা দম্পতির জুনাইদ আমির ও ইরা আমির নামের দুই সন্তান আছে। ২০০২ সালে তাদের বিচ্ছেদ হয়। এ সময় দুই সন্তানের অভিভাবকত্ব পান রিনা দত্ত। ২০০৫ সালে আমির খান কিরণ রাওকে বিয়ে করেন এবং এখন প্রতিনিধি মায়ের মাধ্যমে তাদের আজাদ রাও খান নামের এক পুত্র সন্তান আছে। কিরণ রাও বলিউডের একজন চলচ্চিত্র প্রযোজক, পরিচালক ও চিত্রনাট্য লেখক। লাগান সিনেমাতে তিনি সহকারী পরিচালক ছিলেন। এই সিনেমার শুটিং করার সময়ই তাদের মাঝে আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কিরণ তার পুরো জীবনব্যাপীই একজন নিরানিষভোজী, স্ত্রীর প্রভাবে আমির খানও সাম্প্রতিককালে আমিষকে বিদায় দিয়ে নিরামিশভোজী হয়ে গেছেন।
pk film poster – source – en.wikipidia.com
আমির খানের জীবনের গল্প বলতে গেলে আরেকটি কথা বলতেই হয়- ব্যাপক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত এই অত্যন্ত প্রতিভাবান অভিনেতা কখনো কোনো পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে যান না। তার মতে, কেবলমাত্র জাতীয় পুরষ্কার ব্যাতীত অন্য সকল পুরস্কারই নিরপেক্ষ হওয়ার সম্ভাবনা বেশ কম। উল্লেখ্য যে, ১৯৯০ সালে ‘দিল’ সিনেমার জন্য ফিল্মফেয়ার অনুষ্ঠানে তিনি শ্রেষ্ঠ অভিনেতার জন্য মনোনীত হলেও পরবর্তীতে সানি দেওল তার ‘ঘায়েল’ সিনেমার জন্য পুরস্কারটি পান। এরপর থেকেই আমির খান পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়া বন্ধ করে দেন।
মিস্টার পারফেকশনিস্ট খ্যাত বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী আমির খানের প্রিয় বন্ধুদের তালিকায় আছে আরেক বলিউড তারকা সালমান খানের নাম,বন্ধুত্ব আছে ভারতের ক্রিকেটরত্ন ক্রিকেটের মহাতারকা শচীন টেন্ডুলকারের সাথে। আমির খান তাঁর অবসরে পুরনো দিনের গান শোনা ও ক্রিকেট খেলা দেখতে খুব পছন্দ করেন, আর সব চেয়ে অপছন্দ করেন মিথ্যা বলা ও দুর্নীতি। কালো রঙ আমির খানের প্রিয় রং। বর্তমানে আমির খান পারিশ্রমিক নেন সিনেমা প্রতি ৬০ কোটি রুপি। তার ‘আমির খান প্রোডাকশন’ নামে একটি প্রযোজনা সংস্থা আছে।
লাগান সিনেমায় আমির খান ; Source: wallpapers.yah.in
আমির খান সামাজিক দায়িত্ব পালন ও মানবাধিকার নিয়ে কাজ করার জন্যও সবার কাছে ব্যাপক পরিচিত। ২০১২ সালে আমির খান ‘সত্যামেভ জয়তে’ নামক একটি টেলিভিশন টক শো অনুষ্ঠান তৈরি ও উপস্থাপনা করেন।‘সত্যামেভ জয়তে’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আমির খান ভারতের কন্যা ভ্রুণ হত্যা, ধর্ষণ, সড়ক দুর্ঘটনা, দুর্নীতির মতো সংবেদনশীল সামাজিক বিষয়গুলো মানুষের সামনে তুলে আনেন এর মাধ্যমে দেশ ব্যাপী আমির খান ব্যাপক আলোচিত ও প্রশংসিত হন। এছাড়া ২০১১ সালে ইউনিসেফ শিশু অপুষ্টিরোধে প্রচারণায় আমির খান কে নিযুক্ত করে।
আমির খান তাঁর প্রতিভার অনন্য স্বাক্ষর রেখে যাচ্ছেন তাঁর অভিনয় করা চলচ্চিত্র গুলোতে, নিজের মুন্সিয়ানার ছাপ রেখে যাচ্ছেন প্রযোজিত সিনেমা গুলোতে, অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করে যাচ্ছেন সমাজ সেবার ক্ষেত্রে। ৫২ বছর বয়সী ভারতের এই রত্ন আমির খান বর্ত্মানে মুম্বাইয়ের পশ্চিম বান্দ্রাতে হিল ভিউ অ্যাপার্টমেন্টসে পরিবার সহ বসবাস করছেন।
Read This Bangla Article Biography Of Amir Khan in kalakkhor.com
সোর্স –
Leave a Reply