মশা, ছয় পা বিশিষ্ট এই ছোট্ট প্রাণীটি ঢাকায় বাস করা মানুষের কাছে এক আতঙ্কের নাম। মশার জালাতন শুধু আজ নয় ঢাকা শহরের গোড়াপত্তনের পর থেকেই ঢাকা বাসি সয্য করে আসছে। আর তাই ঢাকা শহরের গোড়াপত্তন যাদের হাতে সেই মুঘলদের কাছে এটি পরিচিত ছিলো মশার শহর হিসেবে। শুধু কি তাই, মোঘলরা তাদের রাজধানী ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদ স্থানান্তর করার পিছনে অন্যতম একটি কারণ হিসেবে এই মশাকে দায়ী করা হয়। ঢাকা শহর থেকে মশার উৎপাত বন্ধ করতে অনেকেই অনেক কিছু করেছেন। তার কোন টা মানুষের মনে দাগ কেটে আছে আবার কোন টা বিসৃতির আড়ালে হারিয়ে গেছে। সেই বিসৃতির আড়ালে হাড়িয়ে যাওয়া একটি ঘটনা আজ আমরা আপনাদের সামনে হাজির করবো। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ইতিহাস ঘাটলে এক ব্যাক্তির নাম খুঁজে পাওয়া যায়,যিনি কিনা ঢাকা শহরের মশা মারতে এক প্রকার কামান দাগিয়েছিলেন। আর যে ব্যাক্তিটি এহেনো কর্ম করেছিলেন তাঁর নাম হাবিবুল্লাহ বাহার চৌধুরী !
১৯০৬ সালে ফেনী জেলার গুথুমা গ্রামে একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন হাবিবুল্লাহ বাহার চৌধুরী । চট্টগ্রাম মিউনিসিপাল স্কুল থেকে ১৯২২ সালে এস এস সি এবং চট্টগ্রাম কলেজ থেকে ১৯২৪ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে ১৯২৮ সালে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ থেকে বিএ পাশ করেন।
শিক্ষা জীবন শেষ করে তিনি রাজনিতিতে জরিয়ে পরেন এবং তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম স্বাস্থ্যমন্ত্রী পদ অলঙ্কৃত করেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী হবার পরেই হাবিবুল্লাহ বাহার চৌধুরী তার অন্যতম প্রধান অভিযান মশা নিধন অভিযানে নেমে পড়েন ! এসময় হাবিবুল্লাহ বাহার চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২০ হাজার ‘মশার ওষুধ ছিটানোর যন্ত্র’ এনেছিলেন। রাস্তার পাশে গভীর ড্রেন খনন করিয়ে বর্জ্য ব্যবস্থা আধুনিক করার প্রক্রিয়া তিনিই প্রথম চালু করেন। ঢাকা শহরের সকল খাল ডোবা পরিষ্কার করা হয় তার নির্দেশে। ইস্পাহানির সাহায্যে মশার ওষুধ ছিটানোর জন্য তিনি দুইটি বিমান পর্যন্ত কিনেছিলেন। তাঁর এই মশা নিধনের প্রক্রিয়াটি প্রায় দুবছর যাবৎ চলত থাকে। ঢাকার বুকে মশার প্রকোপ তখন তিনি সম্পূর্ণরূপে নির্মুল করতে পেরেছিলেন। তাঁর গৃহীত কার্যক্রম এতটাই ফলদায়ক ছিলো যে, সেগুলো সম্পন্ন হওয়ার দশ বছর পরেও মানুষ মশারী না টানিয়ে ঘুমাতে পারত ! ১৯৪৯-১৯৫০ সালের দিকে রোম, কায়রো ও জেনেভায় অবস্থিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সম্মেলনে তিনি পাকিস্তানের প্রতিনিধি দলের অন্যতম প্রধান সদস্য ছিলেন। জেনেভা সম্মেলনে তিনি সভাপতিত্ব করেন।
শুধু তাই নয় সাহিত্যমনষ্ক এই রাজনীতিবিদটি ১৯৪৫-৪৬ সাল পর্যন্ত বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৪৮ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলনের অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতি ছিলেন। কিন্তু ১৯৫৩ সালে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার পর হাবিবুল্লাহ বাহার চৌধুরী তার মন্ত্রীত্ব থেকে ইস্তফা দিয়ে রাজনীতি থেকে অবসর নেন। হাবিবুল্লাহ বাহার চৌধুরী রাজনীতির পাশাপাশি বেশ কিছু গ্রন্থ রচনা করেছেন। তার লেখা গ্রন্থগুলোর মধ্যে “পাকিস্তান”, “মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ”, “ওমর ফারুক”, “আমির আলী” অন্যতম।
আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামেরও সাথে তার বেশ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান ছিলো। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর “সিন্ধু হিন্দোল” কাব্যগ্রন্থটি হাবিবুল্লাহ বাহার চৌধুরী ও তাঁর বোন শামসুন্নাহারকে উৎসর্গ করেছিলেন।
অনন্য রাজনৈতিক আদর্শ এবং দূরদর্শিতা সম্পন্ন হাবিবুল্লাহ বাহার চৌধুরী ১৯৬৬ সালের ১৫ই এপ্রিল মৃত্যু বরণ করেন। বাংলাদেশে চলমান মশার দুর্যোগের সময় তাঁর দেখানো পথ ধরে মশা নিধন কার্যক্রম পুনরায় বাস্তবায়ন করার মাধ্যমেই আমরা ঢাকা শহরকে মশার প্রকোপ থেকে রক্ষা করা যায় বলে আমার ব্যাক্তিগত অভিমত ৷
Leave a Reply