প্রখ্যাত গজল সম্রাট মেহেদি হাসান খান যাকে ‘শাহেনশাহ-ই-গজল’ উপাধি দেওয়া হয় । সেই মহান গজলশিল্পী একটা বড়সড় সেরিব্রাল স্ট্রোকে প্যারালাইজড হয়ে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছেন,তার হাত-পা অসাড়। ধিরে ধিরে তাঁর কাছ থেকে সরে যাচ্ছে পৃথিবীর যাবতীয় স্মৃতি। তাঁর শরীরের সাথে সাথে সুমধুর কণ্ঠও বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। থমথমে হাসপাতাল করিডোরের একঘেয়েমি ভেদ করে হঠাৎ হৈচৈ শুরু হয় কেবিনের বাইরে। এমন সময় একজন লম্বা, অত্যন্ত সুন্দরী ভদ্র মহিলা রাজকীয়ভাবে কেবিনের দিকে আসতে দেখা যায়। সুন্দর মুখশ্রী আর তাঁর চলনভঙ্গি মাথা ঘুরিয়ে দিচ্ছিল সকলের। তাঁকে ঘিরে তখন একটা মোহময় বাতাবরণ তৈরি হয় । তিনি এক সময় কেবিনে প্রবেশ করে মেহেদি হাসানের সামনে এসে দাঁড়ান। জনাব মেহেদি হাসান তাঁর দিকে তাকান এবং সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর মুখের অভিব্যক্তি পাল্টে যায়। সামনে দাঁড়ানো মেয়েটিকে ততক্ষণাৎ তিনি চিনতে পেরেছিলেন । মেয়েটির হল এই উপমহাদেশের প্রথম সুপারস্টার- ঝর্ণা বসাক ওরফে ‘শবনম’ । তিন দশক পাকিস্থান/ পুর্ব পাকিস্থান ও পশ্চিম পাকিস্থানে সেরা নায়িকার আসনের পদ যে নায়িকা অলংকৃত করে রাখেছিলেন। আমাদের বর্তমান প্রজন্ম যাকে নায়ক মান্না অভিনিত সুপার ডুপার হিট ছবির আম্মাজান সিনেমার আম্মাজান বলে চিনি সেই শবনম। সৃজনশীল ব্লগ “কালাক্ষর” এ আমাদের আজকের আয়োজন এই উপমহাদেশের প্রথম সুপারস্টার- ঝর্ণা বসাক ওরফে ‘শবনম’ নামের মহান অভিনয়শিল্পী কে ঘিরেই।
১৭ আগস্ট ১৯৪৬ সালে ঢাকায় জন্মগ্রহণকারী ঝর্ণা বসাক ছোট বেলা থেকেই বুলবুল ললিতকলা একাডেমিতে নাচ শিখতেন। একজন নৃত্যশিল্পী হিসেবে বিভিন্ন কালচারাল প্রগ্রাম গুলোতে নৃত্য পরিবেশন করতেন। তেমন একটি নৃত্যের অনুষ্ঠানে এহতেশাম তার নাচ দেখে এদেশ তোমার আমার চলচ্চিত্রের নৃত্যে অভিনয়ের সুযোগ করে দেন। তিনি আরও কিছু ছবিতে অতিরিক্ত শিল্পী হিসেবে অভিনয় করেন। কিন্তু এহতেশামের পাশাপাশি পরিচালক মুস্তাফিজের নজর কাড়তে সক্ষম হন অতিরিক্ত শিল্পী হিসেবে অভিনয় করেই।মুস্তাফিজ পরিচালিত ‘হারানো দিন‘ ছবিতে অভিনয়ের মাধ্যমে ১৯৬১ সালে নায়িকা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। এ ছবিতেই পরিচালক মুস্তাফিজ তাঁর ঝর্ণা বসাক নামটি পরিবর্তন করে তাঁর একটি ফিল্মি নাম দেন শবনম। শবনম নামের অর্থ দাঁড়ায় ফুলের মধ্যে বিন্দু বিন্দু শিশির ঝরে পড়া। পাকিস্তান ও বাংলাদেশে শবনম নামে চলচ্চিত্রে অভিনয় করে ঝর্ণা বসাক ব্যাপক সাফল্য পান। তিনি ধর্মীয় ভাবে একজন হিন্দু ধর্মের অনুসারী। ফিল্মে তাঁর নাম শবনব রাখলেও কখনো তিনি তাঁর ধর্ম বিশ্বাস পরিবর্তন করেন নি। শবনম নামেই অভিনেত্রী হিসেবে তিনি পাকিস্তানের চলচ্চিত্র শিল্পে বা ললিউডে অত্যন্ত জনপ্রিয়তা পান।
শবনম ১৯৬১ সালে বাংলা চলচ্চিত্র হারানো দিনের মাধ্যমে তদানন্তিন পুর্ব পাকিস্থানে (বর্তমানে বাংলাদেশ) ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। ১৯৬২ সালে উর্দু চলচ্চিত্র চান্দা ছবির মাধ্যমে শবনম নামের নায়িকাটি তৎকালীন সমগ্র পাকিস্তানে রাতারাতি তারকাখ্যাতি পান। এ দু’টি ছবিই তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) ঢাকা থেকে মুক্তি পেয়েছিল। পরবর্তী বছরে তালাশ সমগ্র পাকিস্তানে মুক্তি পেলে ঐ সময়ের সর্বাপেক্ষা ব্যবসা সফল ছবির মর্যাদা লাভ করে। ১৯৬০-এর দশক থেকে ১৯৮০’র দশক পর্যন্ত একাধারে সক্রিয় অভিনয় চর্চা করে গেছেন উপমহাদেশের প্রথম সুপারস্টার- ঝর্ণা বসাক ওরফে ‘শবনম’। পেশাগত কারণে ১৯৬৮ সালে পাকিস্তানে চলে যা এবং ১৯৯৭ সালে ঢাকায় ফিরে আসেন। ১৮০ টি উর্দু এবং বাংলা চলচ্চিত্রে অভিনয় করে তাক লাগিয়ে দেওয়া নায়িকা শবনম ৩১ বছর ধরে পাকিস্তান ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে শির্ষ নায়িকার আসনে রাজত্ব করে একটি ক্রিতৃত্ব অর্জন করেন। যা উপমহাদেশে তাঁর সমসাময়িক দেবিকা রানি, কানন দেবী, সুচিত্রা সেন, সুপ্রিয়া চৌধুরী সহ ভারতীয় সিনেমার স্বর্ণযুগের বহু ‘সুপারস্টার’ নায়িকা/অভিনেত্রীদের মাঝে দেখা যায় না।
চলচিত্রের ধ্রুব তারাদের নিয়ে আমার লেখা গুলো পড়ে আসতে পারেন
নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে ঝর্ণা বসাক ওরফে শবনম পাকিস্তান এবং সেখানকার ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি থেকে পুরোপুরি অবসর নিয়ে বাংলাদেশে চলে আসেন। ঢাকায় ফিরে দু’বছর বিরতি দেওয়ার পরে ঝর্ণা বসাক ওরফে শবনম কাজী হায়াত পরিচালিত ‘আম্মাজান’ ছবিতে অভিনয় করেন। ছবিটি ১৯৯৯ সালে মুক্তি পায়। ছবিটি সুপারহিট হয় এবং বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইতিহাসের অন্যতম সফল সিনেমার মাইল ফলক হিসেবে জায়গা করে নেয়।
১৯৯৭ সাল থেকে বাস করা শবনম কে ২০১২ সালে পাকিস্থান সরকার আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। এবং পাকিস্থান সরকারের আমন্ত্রণে ঝর্ণা বসাক তার স্বামীর সঙ্গে ১৩ বছর পর পাকিস্তান সফরে যান, সেখানে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানির অংশগ্রহণে আয়োজিত অনুষ্ঠানে ঝর্না বসাক ওরফে শবনমের হাতে আজীবন কৃতিত্বের (লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট) পুরস্কার তুলে দেওয়া হয়।
ঝর্ণা বসাক ওরফে শবনম এর স্বামীর নাম ছিল রবিন ঘোষ। তাদের এক সন্তান রনি ঘোষ। সুরকার রবিন ঘোষ ২০১৬ সালে শ্বাস প্রশ্বাস জনিত কারণে মারা যান। বর্তমানে তিনি ঢাকায় নিজ বাড়িতে বসবাস করছেন।
Leave a Reply